রাতু রাজবাড়ির সূর্য-ঘড়ি। — নিজস্ব চিত্র
পুজোর পাঁচদিন ওঁরা হাতের ঘড়ি পনেরো মিনিট স্লো করে দেন। শুধু হাতের ঘড়িই নয়, বাড়িতে যেখানে যত ঘড়ি আছে, সব দেওয়াল ঘড়িও পনেরো মিনিট স্লো চলে। না হলে তো পুজোর সব আচার অনুষ্ঠানেই গড়বড় হয়ে যাবে।
পুজোর ক’টা দিন ওঁরা ভারতীয় সময়ের পরোয়াই করেন না। তখন এখানে সময় চলে রাতু রাজবাড়ির সূর্য-ঘড়ির সঙ্গে তাল মিলিয়ে। গত একশো বছরেরও বেশি সময় ধরে পুরনো এই সূর্য-ঘড়িকে কেন্দ্র করেই চলে রাতু রাজবাড়ির দুর্গোৎসব। এটাই প্রথা। সন্ধিপুজো থেকে শুরু করে কখন সপ্তমী পড়বে, কখন অষ্টমী, কখন দশমী, কখনই বা সন্ধিপুজো—সব ঠিক হয় এই সূর্য-ঘড়ির নির্ঘণ্ট মেনেই। রাতুর সাধারণ মানুষও এ ক’টা দিন এই সূর্য-ঘড়ি মেনেই চলেন। এটাও প্রথা।
রাঁচি থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে রাতু রাজবাড়ির চত্বরে একটি পাথরের টেবিলের উপর রাখা রয়েছে ব্রিটিশ আমলের এই সূর্য-ঘড়িটি। রাজবাড়ির ম্যানেজার দামোদর মিশ্রর কথায়, ‘‘আসলে অক্টোবর মাসে এই সূর্য-ঘড়ি মিনিট পনেরো স্লো চলে। তাই আমাদের পুজোর সব আচার অনুষ্ঠানই পনেরো মিনিট দেরিতে।’’
সারা বছর এই সূর্য-ঘড়িটি লোহার ঢাকনা পরানো থাকে। তাতে ঝোলে তালা। পুজোর সময় সেই ঢাকনা খোলা হয়। আগে অবশ্য সারা বছর এই ঘড়ি ধরেই রাজবাড়ির কাজকর্ম চলত। শুধু রাজবাড়ি কেন, রাতুর সময় নির্ধারণ করত রাজবাড়ির সূর্য-ঘড়ি। এখন শুধু পুজোর সময়ই ঘড়ি খোলা হয়। ঢাকনা খুলে দামোদরবাবু দেখান, ‘‘দেখুন ঘড়ির ডায়ালকে ঘিরে ঘন্টা ও মিনিটের দাগ হিসেবে শুধু এক, দুই, তিনই নয়, ওই ডায়ালের ওপরে মাসও উল্লেখ করা আছে। ভিন্ন ভিন্ন মাসে ওই ঘড়ির মধ্য-দণ্ডের ছায়া পড়ার সময়ে কিছুটা হেরফের হয়। তাই কোনও মাসে ঘড়ি ভারতীয় সময়ের থেকে দ্রুত চলে। কোনও মাসে ধীরে।’’
হাত ঘড়িতে দেখা গেল এখন সময় সকাল সাড়ে ন’টা, ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ড টাইম। কিন্তু সূর্য-ঘড়ির সময় বলছে, সময় এখন ন’টা বেজে পনেরো মিনিট। এ ঘড়ি সেকেন্ডের হিসেব রাখে না। দামোদরবাবুরা জানালেন, ষষ্ঠীর দিন থেকে শুরু হয় সূর্যঘড়ি দেখা। রাজবাড়ির কেয়ারটেকার কিশোর মুখোপাধ্যায় বংশ পরম্পরায় রাতু রাজবাড়ির সঙ্গে যুক্ত। কিশোরবাবু জানালেন, তাঁর পিতামহ, প্রপিতামহরা এই রাজবাড়ির পুরোহিতের কাজ করতেন। প্রাচীন প্রথা অনুযায়ী, ষষ্ঠীর দিন দুপুর বারোটায় সবাই এই সূর্য-ঘড়ির সামনে হাজির হয়ে দেখেন, সূর্য-ঘড়ির সময় তখন ঠিক কটা? ঘড়ির কাঁটার ছায়া যেখানে পড়ছে সেই সময়কেই তারা নিজেদের ঘড়ির সঙ্গে মিলিয়ে দেন। প্রায় দশ থেকে বারো একর জমির ওপর রাতু রাজার বিশাল তিন মহলা প্রাসাদ। প্রাসাদ চত্বরে জোর কদমে চলছে পুজোর প্রস্তুতি। রাতুর মহারাজা চিন্তামনি শরণনাথ সহদেও মারা গিয়েছেন কয়েক বছর আগে। তাঁর ছেলে যুবরাজ গোপাল শরণনাথ সহদেও-ও মারা গিয়েছেন। বেঁচে আছেন তাঁর স্ত্রী প্রিয়দর্শনী সহদেও। বেঁচে আছেন চিন্তামনির চার মেয়ে মাধুরী মঞ্জরী, কল্পনা কুমারী, তৃপ্তিদেবী ও গায়ত্রী দেবী। এঁরা কেউই এখন এই রাজবাড়িতে থাকেন না। তবে পুজোর সময় হাজির হন বাপের বাড়িতে। কিশোরবাবু বলেন, ‘‘সারা বছর এই রাজবাড়ি কার্যত ফাঁকাই পড়ে থাকে। আমরাই দেখভাল করি। মাঝেমধ্যে রাজার মেয়ে বা বৌমা এসে দিন কয়েক থেকে যান। তবে সবাই মিলে আসেন পুজোয়।’’
দামোদরবাবু জানান, এই তো ষষ্ঠীর দিন সবাই চলে আসবেন। তখন খুব হইহই হবে। বাড়ির
বাচ্চারা প্রাসাদের বাগানে, বারান্দায় খেলা করবে। হুটোপুটি করবে। পুজো মণ্ডপ জমে উঠবে খুব। পুজোর পাঁচদিন রাতুর বাসিন্দা থেকে রাজপরিবারের সদস্য, সবাই এক সঙ্গে মিলে পুজোয় মেতে উঠবে। মনে হবে আবার যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে রাতুর প্রাসাদ।
পুজোর ক’দিন ওই সূর্যঘড়িও ফিরে পাবে তার প্রাণ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy