Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

চলে গেলেন ছিটমহলের মুখ

তখনও অন্ধকার কাটেনি। অস্ফুট গোঙানির শব্দে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল জাবেদা বিবির। কুপি জ্বেলে স্বামীর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন— ‘‘কষ্ট হচ্ছে?’’ দু’ চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে আজগরের। সঙ্গে শ্বাসকষ্ট। ডাক পড়ে ছেলে-মেয়ে, নাতি-পুতিদের।

আজগর আলি। ছবি: হিমাংশু রঞ্জন দেব

আজগর আলি। ছবি: হিমাংশু রঞ্জন দেব

নিজস্ব সংবাদদাতা
কোচবিহার শেষ আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০১৭ ০৩:০২
Share: Save:

তখনও অন্ধকার কাটেনি। অস্ফুট গোঙানির শব্দে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল জাবেদা বিবির। কুপি জ্বেলে স্বামীর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন— ‘‘কষ্ট হচ্ছে?’’ দু’ চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে আজগরের। সঙ্গে শ্বাসকষ্ট। ডাক পড়ে ছেলে-মেয়ে, নাতি-পুতিদের। সবাই এসে পৌঁছতে পারেননি। ভোর পাঁচটায় কোচবিহারের দিনহাটার সাবেক ছিটমহল মধ্য মশালডাঙার বাসিন্দা ১০৪ বছরের আজগর আলি মারা গেলেন নিজের বাড়িতেই। ।

ছিটমহল আন্দোলনের মুখ হিসেবেই পরিচিত ছিলেন আজগর আলি। তাঁর ইন্তেকালের খবরে রবিবার সকালে শ’য়ে শ’য়ে মানুষ ভিড় করেন ওই বাড়িতে।

চোখের জল মুছছিলেন আজগরের নাতি জয়নাল আবেদিন। আশেপাশে দাঁড়িয়ে প্রতিবেশী, আত্মীয়রা। উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী রবীন্দ্রনাথ ঘোষ বলেন, বার কয়েক আজগরের সঙ্গে কথা হয়েছে তাঁর। চেনেন তাঁকে। ছিটমহল আন্দোলনের নেতা দীপ্তিমান সেনগুপ্ত বলেন, “এই আন্দোলনের একটা মুখ ছিলেন লড়াকু আজগর আলি। এলাকায় আরও একটু উন্নয়ন দেখে গেলে খুশি হতেন।”

সাবেক ছিটমহলের সবাই আজগরকে সমীহ করতেন। তাঁর কাছেই জানা যেত, এক সময় কেমন ছিল ওই অঞ্চল। কোচবিহারের রাজার আমল থেকে শুরু করে ইংরেজ শাসনের সময়ই বা কী অবস্থা ছিল। তিনিই জানাতেন সেই সব দিনের কথা, যখন পুলিশ নেই, প্রশাসন নেই, আইন নেই, অন্যায় হলে কারও কাছে যাওয়ার নেই। অসুস্থ হলে ডাক্তার নেই। পড়াশোনার জন্য স্কুল নেই। ছিটমহল বিনিময়ের দাবিতে আন্দোলন শুরুর প্রথম দিন থেকেই সক্রিয় ভাবে যোগ দেন আজগর।

নাতি জয়নাল বলছিলেন, দীর্ঘ আন্দোলনের শেষে ভারতের নাগরিকত্ব পেয়ে খুব খুশি হয়েছিলেন আজগর। বিপুল উৎসাহ নিয়ে ভোটও দিতে গিয়েছিলেন। কিন্তু তার পর থেকে কিছুটা মন-খারাপ ছিল দাদুর। ভারতের সঙ্গে যোগ হওয়ার পরে এলাকায় দ্রুত রাস্তা-ঘাট হবে, স্কুল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র হবে— এমনটাই স্বপ্ন দেখতেন আজগর। ছিটমহল বিনিময়ের পরে বছর ঘুরেছে।

বাংলাদেশের যে সব ছিটমহল ও-দেশের সঙ্গে যোগ হয়েছে, সেখানে হইহই করে সে কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। স্কুল আর হাসপাতাল চালু হয়ে গিয়েছে বলেও খবর পেয়েছিলেন। কিন্তু এখানে কোথায় কী!

এখনও বিদ্যুৎ সংযোগটুকুও আসেনি সাবেক ছিটমহলগুলির অধিকাংশে। বৃষ্টি নামলে আজও জলে কাদায় রাস্তায় বেরোনো যায় না। জমির মালিকানার কাগজ তৈরির বিষয়েও প্রশাসনের গা নেই। নাতির কথায়, স্বপ্ন যেন কিছুটা ফিকে হতে শুরু করেছিল দাদুর। শেষ দিকে হাসিতেও যেন ঝরত বিষাদ। আক্ষেপ করে বলতেন, গ্রামে বিজলির আলো আর দেখে যাওয়া হল না!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Chitmahal Independence
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE