বইয়ের সংখ্যা নেহাত কম নয়। উপন্যাস, ছোট গল্পের ভিড়ে টেবিলটাই দেখা যাচ্ছে না। তবুও কোণের ভিড় থেকে ছিটকে এল —পাবলো নেরুদার কিছু এনেছেন?
প্রশ্নটা শুনে থমকে দাঁড়িয়েছিলেন গ্রন্থাগারের লোকজন। কেউ কেউ ফিসফিস করছিলেন, ‘‘বলে কী! পাবলো নেরুদা?’’
ওই যুবকের কিন্তু কোনও ভাবান্তর নেই। অত্যন্ত বিনীত ভাবে বলছেন, ‘‘অনুবাদ হলেই ভাল হয়। না হলে ইংরেজিও চলবে।’’
বছর ত্রিশের এক যুবক। পরনে সুতির প্যান্ট ও শার্ট। গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। গত কয়েক মাস ধরে কল্যাণী সংশোধনাগারে আছেন। বিচারাধীন বন্দি। বই পড়ার অভ্যেস তাঁর বহু দিনের। তবে সংশোধনাগারে তেমন বই মেলে কই!
বুধবার দুপুরে গ্রন্থাগারের লোকজনকে সামনে পেয়ে পাবলোর বইয়ের ‘আবদার’ করেছেন। গ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষও নিরাশ করেননি তাঁকে, ‘‘পরের বার নিশ্চয় আপনার জন্য নেরুদার বই নিয়ে আসব।’’
জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ৩১ অগস্ট থেকে নিজেদের পছন্দ মতো বই পড়তে পারবেন জেলার কৃষ্ণনগর, কল্যাণী, রানাঘাট ও তেহট্ট সংশোধনাগারের আবাসিকেরা। একই সুযোগ পাবেন জেলার সরকারি হোমের আবাসিকেরাও।
হোম ও সংশোধনাগারের আবাসিকদের বই পড়ার অভ্যাস তৈরি করতেই এমন উদ্যোগ বলে জানিয়েছেন জেলাশাসক সুমিত গুপ্তা। আবাসিকদের বই সরবরাহ করবেন স্থানীয় পাঠাগার কর্তৃপক্ষ।
দিনকয়েক আগে থেকেই আবাসিকদের কাছে কৃষ্ণনগর সংশোধনাগার কর্তৃপক্ষ জানতে চেয়েছিলেন তাঁরা কী ধরনের বই পড়তে চান। কেউ বলেছেন ‘সেই সময়’, কারও দাবি ছিল ‘আমি সুভাষ বলছি’। কারও অনুরোধ ছিল ‘রক্তকরবী’। সেই তালিকা সংশোধনাগার কর্তৃপক্ষ তুলে দিয়েছিলেন পাঠাগার কর্তৃপক্ষের হাতে। এ দিন কৃষ্ণনগরে সেই মতো বইও এসেছিল। তবে কল্যাণীতে আগে থেকে কোনও তালিকা করা হয়নি। স্থানীয় পাঠাগারের প্রতিনিধিরা সকালে পৌঁছে গিয়েছিলেন কল্যাণী উপ-সংশোধনাগারে। তাঁদের সঙ্গে ছিল বেশ কিছু উপন্যাস এবং ছোট গল্পের বই। গ্রন্থাগারের পরিচালন সমিতির সদস্য দেবজ্যোতি ঘোষ জানান, আবাসিকরা কী ধরনের বই পছন্দ করবেন সেই বিষয়ে কোনও ধারণা তাঁদের ছিল না।
কিন্তু, সংশোধনাগারে গিয়ে তাঁরা দেখেন, বই দেখে রীতমতো উচ্ছ্বসিত আবাসিকেরা। তাঁরা এ দিন কেউ চেয়ে নিয়েছেন ‘শরৎ রচনাবলী’, কেউলুফে নিয়েছেন, ‘ব্যোমকেশ সমগ্র’। কেউ কেউ বলেছেন, ‘‘হাসির কিছু পাওয়া যাবে?’’ টেনিদা, ফেলুদা-র চাহিদাও যথেষ্ট।
দু’জন আবাসিক আবার সটান বলে বসেছেন, ‘‘গল্প-টল্প পড়ে কিস্যু হবে না। বরং আইন-কানুনের কিছু বইপত্তর আনবেন তো। হতচ্ছাড়া উকিলকে পয়সা দিতে দিতে ফতুর হয়ে গেলাম।’’ দেবজ্যোতিবাবু জানান, ১৫ দিন পর পরে তাঁরা ফের সংশোধনাগারে আসবেন। পুরনো বই বদলে নতুন বই দিয়ে আসবেন। তখনই আবাসিকেরা তাঁদের পছন্দের বই পেয়ে যাবেন।
গ্রন্থাগারের এক সদস্য বলছেন, ‘‘যাঁরা বলেন বই বই বই আর কিছু না, তাঁরা ভুল বলেন। বই মানুষকে বদলেও দিতে পারে। আবাসিকদের এমন উচ্ছ্বাস আমার অনেকদিন মনে থাকবে।’’ যদিও সংশোধনাগার কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছেন, কোনও না কোনও অভিযোগে আবাসিকেরা সংশোধনাগারে আছেন। তার
মানে তো এই নয় যে, তাদের শিক্ষা, বোধ, বুদ্ধি সব লোপ পেয়েছে। ওঁদের অনেকেই বই পড়তে ভালবাসেন। বই পড়েন। জেলা প্রশাসন বই পড়ার এমন সুযোগ করে দেওয়ায় ওঁরা খুশি।
অন্য আবাসিকেরা ব্যস্ত নিজেদের কাজে। কনে দেখা আলোয় নিজের সেলে বসে এক আবাসিক একমনে পড়ে চলেছেন, ‘নিশিকুটুম্ব’। মাখনের মতো আশালতার গা থেকে একটার পর একটা গয়না সরিয়ে নিচ্ছে সাহেব। মুখে জ্বলছে নিদালি বিড়ি।
সেই আবাসিকেরও কি কিছু মনে পড়ে যাচ্ছে? স্মৃতি যে সবসময় সুখের হয় না, সে কথা ওই আবাসিকের থেকে আর কে ভাল জানে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy