দুর্দশা: মেলেনি জায়গা। তাই মেঝেতেই ঠাঁই রোগীদের। বারাসত হাসপাতালে। —নিজস্ব চিত্র।
এক শয্যায় ঠাসাঠাসি করে দু’জন। হাতে স্যালাইন। শয্যার নীচে, বারান্দাতেও শুয়ে রোগী। হাসপাতালের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি রাখা থাকে যে ঘরে, সেখানেও ভিড়। এক মাসের বেশি জ্বর ও ডেঙ্গির
প্রকোপ চলছে। যার জেরে এমনই হাল উত্তর ২৪ পরগনার জেলা হাসপাতাল বারাসতে।
মঙ্গলবার দুপুর। ‘‘এখন তো রোগী অনেক কম,’’ বললেন হাসপাতালের এক সেবিকা। তাঁর কথায়, ‘‘পরশু পর্যন্ত বারান্দায়, মেঝেতে, এমনকী হাসপাতালের বাইরেও শুয়ে ছিলেন রোগীরা। স্ট্যান্ড নেই, স্যালাইন ধরে রয়েছেন আত্মীয়েরা। বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে হাসপাতালের ভিতরে ঢোকার সে কী হুড়োহুড়ি।’’
বর্হিবিভাগে রোগীর সংখ্যা তো হাজার হাজার। তা হলে মঙ্গলবার হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা এত কম কেন?
প্রশ্ন শুনেই খেপে উঠলেন হাসপাতালের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা রোগীদের আত্মীয়েরা। তাঁদের অভিযোগ, বেশির ভাগ রোগীকেই সামান্য ওষুধ দিয়ে রক্ত পরীক্ষা করতে হবে বলে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। হাবরার বাসিন্দা মনোজ চাকলাদারের অভিযোগ, ‘‘সেই রিপোর্ট পেতে-পেতে দু’দিন লেগে যাচ্ছে। তার মধ্যে রোগীর অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে। দ্রুত প্লেটলেট নেমে যাচ্ছে।’’ মহিউদ্দিন মণ্ডলের অভিযোগ, ‘‘ভর্তি করার পরে সুস্থ না হলেও তড়িঘড়ি ছুটি দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। না হলে কলকাতা পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বাড়ি ফেরার পরে বা কলকাতায় নিয়ে যেতে গিয়ে মারা যাচ্ছেন রোগী।’’
মঙ্গলবার হাবরা হাসপাতালে মারা যান চাকলার মহব্বত আলি মল্লিক। দিন চারেক আগে বারাসত হাসপাতালে জ্বর নিয়ে ভর্তি হন তিনি। সুস্থ বলে রবিবার ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। সোমবার বাড়িতে ফের অসুস্থ হয়ে পড়লে হাবরা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। মঙ্গলবার সেখানেই মারা যান তিনি। তাঁর আত্মীয় সম্রাট মণ্ডলের প্রশ্ন, ‘‘প্লেটলেট ৬০ হাজারের
নীচে নেমে যাওয়ার পরেও কেন বারাসত হাসপাতাল সুস্থ বলে
ওকে ছেড়ে দিল?’’
সোমবার রাতে মারা যান চৌরাশির ঢালিপাড়ার নাসিরাবিবি। তিন দিন বারাসত হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন তিনি। রবিবার ছেড়ে দেওয়া হয়। সোমবার মারা যান তিনি। স্বামী নাসির হোসেন
মোল্লা বলেন, ‘‘সরকারি হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম। আর কোথায় ভরসা করব বলুন? শুধুমাত্র জ্বরে কত মানুষ মারা যাচ্ছে। কারও কোনও বিকার নেই!’’
উত্তর ২৪ পরগনায় জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা কয়েক লক্ষ। মৃতের সংখ্যা এক মাসেই প্রায় একশো ছুঁয়েছে। আজই মারা গিয়েছেন সাত জন। এ নিয়ে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে সরব হয়েছিলেন বারাসত হাসপাতালেরই চিকিৎসক অরুণাচল দত্ত চৌধুরী। বন্যার মতো রোগী আসছে আর তাদের সুচিকিৎসা হচ্ছে না বলে ক্ষোভ জানিয়েছিলেন তিনি। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে তিনি মন্তব্য করেন, ‘‘এমন ভয়ানক অবস্থায় জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল, হয়নি। পরিস্থিতি সামলাতে রোগীদের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। মৃত্যুর কারণ ডেঙ্গি হলেও তা না লেখার জন্য চাপ রয়েছে।’’
পরিকাঠামোর যে অভাব রয়েছে, তা মানছেন সবাই। তবে এ দিন হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেল, দিন-রাত পরিশ্রম করে পরিষেবা দিয়ে চলেছেন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। বারাসত ছাড়াও দেগঙ্গা, হাবরা, গাইঘাটা ও বসিরহাট থেকে স্রোতের মতো রোগী আসছেন। হাজারখানেক জ্বরের রোগী দেখছেন মাত্র ৩ জন চিকিৎসক। ‘‘দুর্গাপুজো, লক্ষ্মীপুজো কোন ফাঁকে বেরিয়ে গিয়েছে টেরই পাইনি,’’ বলছেন চিকিৎসক ও সোবিকারা। এ দিন বিকেলে প্রচণ্ড জ্বর নিয়ে স্ত্রী মনীষা ভট্টাচার্যকে হাসপাতালে ভর্তি করান সুমন্ত। বললেন, ‘‘ডাক্তার, নার্সরাই সব করছেন। ওঁরা না থাকলে ওকে বাঁচাতে পারতাম না।’’
হাসপাতাল সুপার সুব্রত মণ্ডল বলেন, ‘‘প্রচুর রোগী আসছেন। আমরাও সাধ্যমতো চিকিৎসা করে যাচ্ছি।’’ তাঁর কথায়, ‘‘কেউ মারা গেলে রোগীর পরিজনের কষ্ট, ক্ষোভ তো হবেই। কিন্তু এমন ভয়ানক পরিস্থিতিতে আমাদের অবস্থা দেখেও রোগী ও পরিজনেরা আমাদের পাশে রয়েছেন। এটাই বড় কথা।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy