Advertisement
১৭ এপ্রিল ২০২৪

বিনাযুদ্ধে তৃণমূলের দখলে তিন পুরসভা

কার্যত বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রাজ্যের তিনটি পুরসভার শাসন ক্ষমতা দখল করল তৃণমূল। এর মধ্যে নদিয়ার গয়েশপুর পুরসভা প্রায় বিরোধী শূন্য হল! সেখানে বিজেপি, বাম ও কংগ্রেস প্রার্থীরা প্রায় সকলেই একযোগে মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেন! বাকি দু’টি পুরসভা হুগলির আরামবাগ এবং তারকেশ্বরে নাম কা ওয়াস্তে কয়েকটি ওয়ার্ডে লড়ছেন বিরোধী প্রার্থীরা। সেগুলিতে ভোট হবে ঠিকই, কিন্তু তাতে পুরসভার দখলদারিতে কোনও হেরফের হবে না।

তারকেশ্বর পুরসভায় জয়ে আবির খেলা তৃণমূল নেতা-কর্মীদের। রয়েছেন স্থানীয় বিধায়ক তথা মন্ত্রী রচপাল সিংহও।—নিজস্ব চিত্র।

তারকেশ্বর পুরসভায় জয়ে আবির খেলা তৃণমূল নেতা-কর্মীদের। রয়েছেন স্থানীয় বিধায়ক তথা মন্ত্রী রচপাল সিংহও।—নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২৯ মার্চ ২০১৫ ০৩:৩৪
Share: Save:

কার্যত বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রাজ্যের তিনটি পুরসভার শাসন ক্ষমতা দখল করল তৃণমূল। এর মধ্যে নদিয়ার গয়েশপুর পুরসভা প্রায় বিরোধী শূন্য হল! সেখানে বিজেপি, বাম ও কংগ্রেস প্রার্থীরা প্রায় সকলেই একযোগে মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেন! বাকি দু’টি পুরসভা হুগলির আরামবাগ এবং তারকেশ্বরে নাম কা ওয়াস্তে কয়েকটি ওয়ার্ডে লড়ছেন বিরোধী প্রার্থীরা। সেগুলিতে ভোট হবে ঠিকই, কিন্তু তাতে পুরসভার দখলদারিতে কোনও হেরফের হবে না। শুধু তাই নয়, এর আগে বিরোধীরা মনোনয়ন প্রত্যাহার করায় ভাটপাড়া পুরসভায় দাপুটে তৃণমূল নেতা অর্জুন সিংহ ও তাঁর ভাই দু’জনেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছেন। সব ক্ষেত্রেই ভয় দেখিয়ে মনোনয়ন প্রত্যাহারে বাধ্য করানোর অভিযোগ করেছে বিরোধীরা। অভিযোগ অস্বীকার করে শাসক দলের বক্তব্য, হার অবশ্যম্ভাবী বুঝে বিরোধী দলগুলি নিজেরাই প্রার্থী তুলে নিয়েছে।

শনিবারই ছিল রাজ্যের ৯১টি পুরসভার মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন। শাসক দলের বিরুদ্ধে সীমাহীন সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলে বিরোধীদের একযোগে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার নিঃসন্দেহে বিরল ঘটনা। এ দিন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায়ের ডাকা সর্বদলীয় বৈঠকে শাসক দলের সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলে এক সুরে সরব হয় বিরোধীরা। যদিও বৈঠকের পরে রাজ্য নির্বাচন কমিশনার বলেন, “বিরোধীদের থেকে যে সব অভিযোগ পেয়েছি, সব ক্ষেত্রেই জেলাশাসক ও মহকুমা শাসককে বলা হয়েছে। তবে এখনও পর্যন্ত কোনও জেলাশাসক বা নির্বাচন কমিশন নিযুক্ত পর্যবেক্ষকরা কোথাও কোনও ধরনের গণ্ডগোলের রিপোর্ট কমিশনকে পাঠাননি।”

তৃণমূলের সন্ত্রাসে বাধ্য হয়েই তাঁরা প্রার্থী প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ জানিয়ে এ দিন রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠীর সঙ্গে দেখা করে তাঁর হস্তক্ষেপ দাবি করেন রাজ্য বিজেপির সভাপতি রাহুল সিংহ। আজ, রবিবার রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব এবং রাজ্য পুলিশের ডিজি-র সঙ্গে এই বিষয়ে তিনি কথা বলবেন বলে বিজেপি নেতৃত্বকে আশ্বস্ত করেছেন রাজ্যপাল। রাজ্য বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসুও এ দিন বলেন, “সর্বত্র তৃণমূল সন্ত্রাস সৃষ্টি করছে। ভয় দেখিয়ে, জবরদস্তি করে গয়েশপুর, আরামবাগ, তারকেশ্বর, ভাটপাড়া এই চার পুরসভা থেকে বাম প্রার্থীদের প্রত্যাহার করানো হয়েছে।”

তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় কিন্তু বিরোধীদের কোনও অভিযোগকে গুরুত্ব দিতে চাননি। মনোনয়ন জমাপর্ব থেকে শুরু করে গত কাল পর্যন্ত বিরোধীরা সন্ত্রাস নিয়ে সে ভাবে সরব হননি কেন, সেই প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, “এখানে বিরোধীরা সাংগঠনিক ভাবে দুর্বল। বিরোধীদের কেউ ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকার ভারে ন্যুব্জ! কেউ বা সাইন বোর্ডে পরিণত হয়েছে! আর কোনও বিরোধীর কুঁড়ি ফুটিয়ে ফুল করার ক্ষমতা নেই। তারা নিজেদের দুর্বলতা ঢাকতে সন্ত্রাস বলে চিৎকার করছে!” রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশের মতে, সন্ত্রাসের অভিযোগ কিছু ক্ষেত্রে যেমন সত্যি, তেমনই বিরোধীদের সাংগঠনিক দুর্বলতার দাবিটাও উড়িয়ে দেওয়ার নয়।

এ রাজ্যে ভোটের আগে সন্ত্রাস করে বিরোধীদের মনোনয়ন প্রত্যাহারের ঐতিহ্য দীর্ঘদিনের। বাম আমলে বেশ কিছু এলাকায় এটা প্রায় রীতিতে পরিণত হয়েছিল! যে আরামবাগ পুরসভা এ বার বিনাযুদ্ধে জিতল তৃণমূল, সেই আরামবাগ লোকসভা কেন্দ্রে ২০০৪ সালে পাঁচ লাখেরও বেশি ভোটে জিতেছিলেন সিপিএম প্রার্থী! বামেদেরই দেখানো পথ ধরেই ২০১৩-র পঞ্চায়েত ভোটে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার হেঁটেছিল বলে অভিযোগ বিরোধীদের। সেই ভোটে দুই মেদিনীপুর, বাঁকুড়া,

বীরভূম, দুই ২৪ পরগনা, হুগলি, হাওড়া, কোচবিহার, দক্ষিণ দিনাজপুর, বর্ধমান-সহ প্রায় সব জেলাতেই তৃণমূলের সন্ত্রাস নিয়ে সরব হয়েছিল বিরোধীরা। বীরভূমের সিউড়ি ব্লকে গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতির বেশির ভাগ আসনে তৃণমূল বিরোধী পক্ষকে মনোনয়নই দিতে দেয়নি বলে অভিযোগ উঠেছিল। অভিযোগ, তৃণমূলের সন্ত্রাসের জন্যই পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলা, খড়্গপুর গ্রামীণ ও ঝাড়গ্রাম মহকুমার অধিকাংশ ব্লক বিরোধীশূন্য ছিল। রাজ্যের অন্যত্রও এ ধরনের অসংখ্য অভিযোগ ওঠে। পঞ্চায়েতে বিনা যুদ্ধে জয়ের সংখ্যায় বামেদের ছাপিয়ে গিয়েছিল তৃণমূল।

কলেজ নির্বাচনেও সিংহ ভাগ জায়গাতেই বিনা ভোটে জয়ের ব্যাপারে বাম-ধারাই অক্ষুণ্ণ রেখেছে রাজ্যের শাসক দল!

ঘটনা হল, কলেজ নির্বাচন ছাড়া জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে বরাবরই সন্ত্রাস চালিয়ে মনোনয়ন প্রত্যাহারের সিংহ ভাগ অভিযোগ উঠেছে গ্রামাঞ্চলে। এ বারে যে ভাবে পুর এলাকাতেও তা ছায়া ফেলল এবং তিন পুরসভা কার্যত বিনা লড়াইয়ে শাসক দলের হাতে গেল, তাতে বিরোধী শিবির কিছুটা হতবাক। এ দিন বিরোধীরা মনোনয়ন প্রত্যাহার করার হুগলির যে দু’টি পুরসভা তৃণমূল কার্যত বিনা যুদ্ধে দখল করল, সেই আরামবাগ এবং তারকেশ্বর অবশ্য তাদের দখলেই ছিল। আরামবাগ পুরসভায় মোট আসন ১৯। বিরোধীরা ১৬টিতে মনোনয়ন প্রত্যাহার করেছে। ভোট হবে শুধু ১, ৬ এবং ১৯ নম্বর ওয়ার্ডে। তারকেশ্বর পুরসভায় মোট আসন ১৫। দু’টিতে মনোনয়নই জমা দেননি বিরোধীরা। আটটি থেকে তারা মনোনয়ন প্রত্যাহার করেছেন। ভোট হবে ১, ৩, ১৫, ১৩ এবং ১১ নম্বর ওয়ার্ডে। গয়েশপুর পুরসভার ১৮টি ওয়ার্ডে এ বার ভোট হচ্ছিল। তার মধ্যে ১৭টিতে বিজেপি, বামেরা ১৫টিতে, কংগ্রেস ১১টিতে এবং নির্দল ২টিতে প্রার্থী দিয়েছিল। তৃণমূল সবক’টিতেই প্রার্থী দিয়েছিল। ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের নির্দল প্রার্থী নিখিল গায়েন ছাড়া এ দিন বাকি সমস্ত ওয়ার্ডে বিরোধীদের প্রার্থীরা মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেন। নিখিল গায়েন আবার বিক্ষুব্ধ তৃণমূল। ফলে, গয়েশপুর বামেদের হাতছাড়া হল।

এ দিন আরামবাগে মহকুমা শাসকের দফতরে মনোনয়ন প্রত্যাহার করতে আসা বিরোধী প্রার্থীদের সঙ্গে দেখা গিয়েছে তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের। বিকেল ৪টে নাগাদ ১ নম্বর ওয়ার্ডের বিজেপি প্রার্থী অনুপ মালিকও মনোনয়ন প্রত্যাহার করতে এসেছিলেন। কিন্তু সময়সীমা আগেই শেষ হয়ে যাওয়ায় তিনি তা করতে পারেননি। অনুপবাবু পরে বলেন, “আমি ভোটে লড়তে চাই না। লিফলেট বিলি করে সে কথা প্রচারের কথা ভাবছি।” কেন লড়তে চান না, এই প্রশ্নের জবাব দেননি তিনি। তবে, এ দিন মনোনয়ন প্রত্যাহার করা ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের সিপিআই প্রার্থী রাঘব সিংহরায় বলেন, “তৃণমূলের সন্ত্রাস এবং পরিবারের কথা ভেবেই ভোটে লড়লাম না।” বিজেপি নেতা অলোক গুহরায়, প্রভাকর তিওয়ারির আবার অভিযোগ আরামবাগের মহকুমা শাসকের দিকে। তাঁরা জানান, ওই মহকুমা শাসকের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবছে বিজেপি।

মহকুমা প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, ভোটের দিন ঘোষণার পর থেকে এ পর্যন্ত বিরোধীদের তরফে সন্ত্রাসের কোনও লিখিত অভিযোগ দায়ের হয়নি। তারকেশ্বরের ক্ষেত্রে সিপিএমের তরফে দলগত ভাবে সন্ত্রাসের অভিযোগ করা হলেও বিরোধী দলের কোনও প্রার্থী এ পর্যন্ত তা করেননি বলে তারকেশ্বর থানা সূত্রের দাবি।

তৃণমূলের বিরুদ্ধে ভয় দেখিয়ে মনোনয়ন প্রত্যাহারের অভিযোগ উঠেছে দক্ষিণ দিনাজপুরের গঙ্গারামপুরেও। ওই পুরসভার ৭ এবং ১১ নম্বর ওয়ার্ড থেকে এ দিন আরএসপি, বিজেপি এবং কংগ্রেস প্রার্থীরা মনোনয়ন তুলে নেন।

বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতেন জেলা তৃণমূল সভাপতি বিপ্লব মিত্রের ভাই প্রশান্ত মিত্র (৭ নম্বর ওয়ার্ড) এবং এক তৃণমূল প্রার্থী। বিজেপি এবং সিপিআইয়ের প্রার্থীরা মনোনয়ন প্রত্যাহার করায় বনগাঁ পুরসভার ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল প্রার্থী

তথা বিদায়ী চেয়ারম্যান জ্যোৎস্না আঢ্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতেন। বামেদের দাবি, ভয় দেখিয়ে তাঁদের প্রার্থীকে মনোনয়ন প্রত্যাহার করতে বাধ্য করা হয়েছে। তৃণমূল অভিযোগ মানেনি। প্রশাসনের দাবি, তাদের কাছে এ ব্যাপারে কোনও অভিযোগ হয়নি।

কাটোয়া পুরসভার ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের কংগ্রেস প্রার্থী নাজমিনা খাতুন এ দিন মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। কংগ্রেসের অভিযোগ, তৃণমূল আশ্রিত সমাজবিরোধীদের প্রাণনাশের হুমকির জেরেই মনোনয়ন প্রত্যাহার। ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের কংগ্রেসের মহিলা প্রার্থী ও তাঁর পরিবারকেও তৃণমূল ক্রমাগত হুমকি দিচ্ছে বলে অভিযোগ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE