পাচারকারীদের কাছে তক্ষকের কারবারে ঝুঁকিও কম, লাভও বেশি। প্রতীকী ছবি।
কালিয়াচক, বৈষ্ণবনগরের নাম শুনলেই প্রথমে মনে আসে জাল নোটের কথা। গত কয়েক বছরে মালদহ জেলার এই সব এলাকা জাল নোট পাচারের আঁতুড়ঘর হিসেবে গোটা দেশে কুখ্যাত। জাল নোট পাচার রুখতে রুখতে ক্লান্ত গোয়েন্দাদের খেদোক্তি, “কাকে ছেড়ে কাকে ধরব। এখানে তো ঘরে ঘরে জাল নোটের কারবার!”
আর সেই মালদাতেই নাকি এখন জাল নোট ‘ক্যারিয়ার’-এর আকাল। অর্থাৎ এত দিন যারা জালনোটের একদম নিচু তলার বাহক ছিল, তারা নাকি এখন জাল নোট ছেড়ে তক্ষকে মন দিয়েছে। তাদের সোজা সাপ্টা যুক্তি, জাল নোট নিয়ে ধরা পড়লে ঝুঁকি বেশি। সিবিআই-এসটিএফ-এনআইএ টানা হ্যাঁচড়া করে। তার থেকে তক্ষকের কারবারে ঝুঁকিও কম, লাভও বেশি।
গত কয়েক বছরে আন্তর্জাতিক বাজারে এক বিশেষ ধরনের গিরগিটির, যার পোশাকি নাম টোকে গেকো, দাম বেড়েছে লাফিয়ে। উত্তরবঙ্গ, বাংলাদেশ, নেপাল ভুটানের জঙ্গলে এই তক্ষক প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। আর এক-একটা তক্ষক চিন-তাইওয়ানের বাজারে বিকোয় ৮০-৯০ লাখ টাকায়। চিনাদের একাংশের বিশ্বাস, এই গেকো থেকে ওষুধ তৈরি হয়। সেই ওষুধে এডস থেকে শুরু করে ক্যানসার সব নাকি সেরে যায়। আর যৌন উত্তেজনা বাড়ানোর ওযুধ বানাতেও নাকি এর জুড়ি মেলা ভার। বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের সঙ্গে যুক্ত জয়দীপ কুণ্ডুও জানাচ্ছেন, “গত কয়েক বছরে এ রাজ্যকে ব্যবহার করে গেকোর মত বিভিন্ন বন্যপ্রাণ পাচার বেড়ে গিয়েছে।”
নেপাল ও ভুটান সীমান্ত রক্ষার জন্য মোতায়েন সশস্ত্র সীমা বল (এসএসবি)-এর দাবি, ২০১৪ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে শুধু উত্তরবঙ্গেই তাঁরা উদ্ধার করেছেন ১২৫টির বেশি টোকে গেকো, যা পাচারের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। আর গত বছর নভেম্বর মাস থেকে এ বছরের এপ্রিল পর্যন্ত বিএসএফ এবং এসএসবি ৩০টির বেশি এই তক্ষক উদ্ধার করেছে পাচারকারীদের হাত থেকে। এই উদ্ধার হওয়া তক্ষকের অধিকাংশই পাচার হচ্ছিল মালদহের সেই করিডর দিয়ে, যা এত দিন ছিল জাল নোট পাচারের জন্য কুখ্যাত।
মে মাসেই বনদফতর ও সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর যৌথ তল্লাশিতে ধরা পড়ে মালদার বামনগোলার হারান বিশ্বাস ও শিবা বিশ্বাস। ধৃতদের কাছ থেকে উদ্ধার হয় দুটি টোকে গেকো। এর আগে একই রকম অভিযানে পাকড়াও করা হয়েছিল মালদহর মহম্মদ নাসিরুদ্দিনকে। তার কাছ থেকেও মিলেছিল দুটি গেকো। মার্চ মাসেও মালদা থেকে পাচারের সময় উদ্ধার হয় এই তক্ষক। ধৃতদের জেরা করতে গিয়েই তদন্তকারীরা জানতে পারেন যে— এখন জাল নোট ছেড়ে অনেকেই গেকো পাচারের ব্যবসায়ে নেমেছে মালদায়। ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিসার কৌশিক সরকার বললেন, “উত্তরবঙ্গের অনেক জায়গা দিয়ে এই পাচার চলছে। তবে এটা ঠিক, কয়েক মাসে মালদহের বেশ কয়েকটি উদ্ধারের ঘটনা ঘটেছে। এই সীমান্ত দিয়ে পাচারের প্রবণতা বাড়ছে। আমরাও বিএসএফের সঙ্গে সমন্বয় রেখে পাচারকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছি।”
আরও পড়ুন: লোকসভায়ও আদিবাসী মঞ্চ
জেলার এক পুলিশ কর্তা স্বীকার করলেন, “জেলার সীমান্তবর্তী বিভিন্ন গ্রামে যারা আগে জাল নোটের কারবারে যুক্ত ছিল, তারা এখন অনেকেই এই তক্ষকের চোরা কারবারে নেমেছে।” পুলিশ সূত্রে খবর, বাংলাদেশ বা নেপাল-ভুটানে যারা জঙ্গল থেকে এই তক্ষক ধরে, তারা পায় বড়জোর দেড়-দু’হাজার টাকা। কিন্তু সীমান্ত পেরিয়ে আসার পর, এক-একটি তক্ষক এ রাজ্যের দালালদের হাতে তুলে দিতে পারলেই মেলে কমপক্ষে ৩০-৩৫ হাজার টাকা। জাল নোটের থেকে লাভ বেশি।
আরও পড়ুন: বাগডোগরায় বিনামূল্যে জমি দেবে না রাজ্য
শুধু গেকো নয়, এই একই চক্র কচ্ছপ ও কাছিমের হাড়-গোড় পাচারের সঙ্গেও যুক্ত। কৌশিক সরকার বলেন, “গত কয়েক মাসে অন্তত তিনটি ক্ষেত্রে বিএসএফের সঙ্গে যৌথ অভিযানে কাছিমের হাড় উদ্ধার হয়েছে। এগুলি আসছিল উত্তরপ্রদেশ থেকে। সীমান্ত পার হওয়ার সময় উদ্ধার করা হয়।” তদন্তকারীদের দাবি, কাছিমের হাড়গোড় পাচারকারীদের হাত দিয়ে পৌঁছয় বাংলাদেশে। সেখানে স্থানীয় হাকিমদের কাছে এর খুব চাহিদা। কারণ এই হাড় থেকে নাকি হেকিমি পদ্ধতিতে দেশি ‘ভায়াগ্রা’ তৈরি হয়, যার চাহিদা বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে আকাশ ছোঁয়া।
আরও পড়ুন: হাতিমৃত্যু ঠেকাতে বৈঠক
আর তাই চিন হোক বা বাংলাদেশ— হাতুড়ে চিতিৎসকদের বাড়বাড়ন্তে জাল নোটকে পিছনে ফেলে বন্যপ্রাণ পাচারের প্রধান করিডর হিসেবেও এ বার উঠে আসছে মালদহের নাম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy