Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪
Purulia

তিন মাসের মেয়েকে ফেলে ঢুকতে হবে গ্রামে, তরুণীকে নিদান পুরুলিয়ায়

নিজের বাবা-মা থাকতেও তাকে অনাথ হয়েই বাঁচতে হবে। কেউ জানতেও পারবে না, তিন মাসের সন্তানকে শুধু প্রাণে বাঁচাতে তাকে অনাথ করে দিতে বাধ্য হয়েছে তার মা। কারণ সমাজের মুরুব্বিরা এই দুধের শিশুর প্রাণদণ্ডর নিদান দিয়েছেন।

স্কুলের পড়ুয়াদের কোলই এখন আশ্রয় শিশুটির। নিজস্ব চিত্র।

স্কুলের পড়ুয়াদের কোলই এখন আশ্রয় শিশুটির। নিজস্ব চিত্র।

সিজার মণ্ডল
শেষ আপডেট: ২২ জুন ২০১৮ ১৬:৩৮
Share: Save:

তিন মাসের ফুটফুটে মেয়ে। মঙ্গলবার দুপুরে ঘুম থেকে উঠে তাকিয়ে দেখল একগাদা অচেনা মুখ। ড্যাবড্যবে চোখে মাথা ঘুরিয়ে মা-কে খোঁজার চেষ্টা করল। কিন্তু খুঁজে পেল না।

সে জানতেও পারল না আর কোনও দিনই হয়তো সে তার মাকে দেখতে পাবে না। নিজের বাবা-মা থাকতেও তাকে অনাথ হয়েই বাঁচতে হবে। কেউ জানতেও পারবে না, তিন মাসের সন্তানকে শুধু প্রাণে বাঁচাতে তাকে অনাথ করে দিতে বাধ্য হয়েছে তার মা। কারণ সমাজের মুরুব্বিরা এই দুধের শিশুর প্রাণদণ্ডর নিদান দিয়েছেন।

এই নিদান উত্তর প্রদেশ বা হরিয়ানার কোনও খাপ পঞ্চায়েতের নয়। এ রাজ্যেরই একটি গ্রামের ঘটনা, যেখানে পড়ুয়ারা সবুজ সাথী প্রকল্পে সাইকেল পায়, যারা টিভিতে বিশ্বকাপ ফুটবল দেখে, মেসি রোনাল্ডো নিয়ে আলোচনাও করে।

পুরুলিয়ার বড়াবাজার থানা এলাকার একটি গ্রামের ১৭ বছরের মেয়ে। মেলায় একটি ছেলের সঙ্গে আলাপ। সেই সূত্র ধরেই কয়েক মাসের মধ্যে বিয়ের সিদ্ধান্ত। ছেলে-মেয়ে কোনও পক্ষের বাড়ি থেকেই মেনে নেওয়া হয়নি এই বিয়ে। সেটা মেনে নিয়েই সংসার পাতেন তাঁরা। থাকার স্থায়ী ঠিকানা নেই। ছেলের মূল বাড়ি বাঁকুড়ায়। কিন্তু তিনি স্ত্রীকে নিয়ে থেকে গেলেন সেই বড়াবাজার এলাকারই একটি গ্রামে। বড় চাষিদের ট্রাক্টর চালিয়ে, ধান কাটার মেশিন চালিয়ে দিন গুজরান।

আরও পড়ুন: কেউ বাড়ি করলে তোমাকে টাকা দেবে কেন? ভরা সভায় নেতাকে ধমক মমতার

চল্লিশটি আঘাতে গুঁড়ো শিবাজীর দেহ

এ ভাবেই বছর দুয়েক কেটে যায়। তার মধ্যে এই দু’জনের সংসারে তৃতীয় জনের আবির্ভাব। কিন্তু তার মধ্যেই তাল কাটল। যে ভাবে নিজেদের ইচ্ছেতে তাঁরা সংসার পেতেছিলেন, সে ভাবেই নিজেরাই আলাদা থাকার সিদ্ধান্ত নেন। স্ত্রীকে বড়াবাজার থানা এলাকারই একটি শবর গ্রামে ফেলে রেখে বাঁকুড়ায় নিজের বাড়িতে ফিরে যান ছেলেটি। একা মেয়েটি সহায় সম্বলহীন হয়ে তখন নিজের বাবার কাছে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু সমস্যার শুরু তিন মাসের সন্তানকে নিয়ে। তাকে নিয়ে মা নিজের বাবার কাছে ফিরতেই রে-রে করে ওঠেন গ্রামের মুরুব্বিরা। মেয়ের পরিবারকে তাঁরা সাফ জানিয়ে দিলেন, যে ওই শিশুকে নিয়ে মেয়ে গ্রামে থাকতে পারবে না। কারণ ওই মেয়ে অন্য জাতির ছেলেকে বিয়ে করেছে। তাই অন্য জাতির এই শিশুকে নিয়ে গ্রামে থাকা যাবে না। গ্রামে থাকার একটাই শর্ত— ওই শিশুকে বাইরে কোথাও ফেলে আসতে হবে।

পুরুলিয়ার পুঞ্চার আদি বাসিন্দা অরূপ মুখোপাধ্যায়। প্রায় এক যুগ ধরে শবরদের একটা স্কুল চালান তিনি। এখানকার সমাজ, রীতিনীতিও স্বাভাবিক ভাবেই জানেন তিনি। ফোনে তাঁর গলাতেও শোনা গেল বিস্ময়, “মঙ্গলবার বিকেল চারটে হবে। বছর উনিশের মেয়েটা আমার কাছে স্কুলে এল। কোলে কয়েক মাসের বাচ্চা। এসেই বললে আমার মেয়েটাকে আপনার কাছে রেখে বাঁচান। তারপরই ধীরে ধীরে গোটা ঘটনাটা জানলাম মেয়েটির কাছ থেকে।”

কর্মীরাই দেখভাল করছেন খুদেকে। নিজস্ব চিত্র।

অরূপ এর পর বললেন বাকি ঘটনা— মেয়েটি সাঁওতাল। টুডু। বিয়ে করেছিল অ-সাঁওতাল একটি ছেলেকে। আর সেই কারণেই এখন আদিবাসী সমাজের মুরুব্বিরা— মাঝি-মারোয়ারা অ-সাঁওতালের সন্তানকে মানতে নারাজ। অরূপ বলেন, “মেয়েটি আমাকে কাঁদতে কাঁদতে বলে, ওই গ্রামের মুরুব্বিরা ফতোয়া দিয়েছে তিন মাসের শিশুকে ফেলে আসতে হবে। না হলে তাঁকে গ্রামে থাকতে দেওয়া হবে না। মেয়েটি আমাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়েছে যাতে আমি কখনও ওর মেয়ের আসল পরিচয় না দিই। মেয়েটির ভয়, ওর গ্রামের লোক জানতে পারলে শিশুটিকে মেরে ফেলবে।”

মঙ্গলবার বিকেল থেকে ওই শিশুর ঠিকানা অরূপের পুঞ্চা নবদিশা মডেল স্কুল। সেখানেই তার জন্য নতুন পোশাক এসেছে। বেবিফুড এসেছে। কিন্তু অরূপের প্রশ্ন অন্য জায়গায়, “মেয়েটি শেষ চারমাস আদাবোনা নামে একটা শবর গ্রামে ছিল। সেখানকার লোকজন আমাকে চেনে। তাঁরাই আমার কাছে মেয়েটিকে পাঠিয়েছে। কিন্তু মেয়েটি যদি আমার মত কাউকে না পেত? তাহলে কী হত? আর গ্রামের মুরুব্বিরা কী আদৌ এ রকম নিদান দিতে পারেন?”

শবর শিশুদের সঙ্গেই বড় হচ্ছে ভাগ্যশ্রী। নিজস্ব চিত্র।

সাঁওতাল জাতির সবচেয়ে বড় ধর্মীয় ও সামাজিক সংগঠন ভারত জাকাত মাঝি পারগানা মহল। সেই সংগঠনের অন্যতম শীর্ষ নেতা রবিন টুডু। তিনি স্বীকার করেন যে এ রকম রীতি তাঁদের সমাজে আছে, “অন্য জাতির সন্তানকে সমাজ মেনে নাও নিতে পারে।” তিনি শিশুটিকে ফেলে দেওয়া বা প্রাণে মেরে ফেলার নিদানের নিন্দা করেন। কিন্তু যখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়, মেয়েটি নিরাশ্রয় হয়ে কোথায় যাবে? রবিনের উত্তর, “আদিবাসী সমাজে মহিলারা নিরাশ্রয় নন। তাঁরা পুরুষদের সমান। সন্তানকে নিয়ে আলাদাই বাঁচতে পারে সে।”

সাঁওতাল সমাজের শীর্ষ নেতা দিশম মাঝি নিত্যানন্দ হেমব্রমের অবশ্য সুর একটু নরম। তাঁর দাবি, “আসলে আমরা ভাবি সেই শিশুটির ভবিষ্যতের কথা। এটা কিছুটা ছেলের বাড়ির ওপর চাপ সৃষ্টি করাও। কেন ছেলের পরিবার শিশুটির ভরণপোষণের দায়িত্ব নেবে না?” তবে তিনি শিশুটিকে ফেলে দেওয়ার নিদানকে সমর্থন করেন না বলে জানান। তিনি বলেন, “আমি এখনই ওই জেলার দায়িত্বে যিনি আছেন তাঁকে যোগাযোগ করতে বলছি ওই পরিবারের সঙ্গে।”

আরও পড়ুন: বাঘ বাঁচানোর দরকার ছিল, বুঝল খুদেরা ​

বাঘ হত্যা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর তত্ত্বকেই চ্যালেঞ্জ বন দফতরের রিপোর্টে​

দিশম মাঝি যাই বলুন না কেন, গ্রামের মুরুব্বিদের নিদানে অনাথ হয়েই শবর শিশুদের সঙ্গে বড় হচ্ছে ভাগ্যশ্রী। মঙ্গলবার রাতেই অরূপের স্কুলের কর্মীরা এই নাম দিয়েছে শিশুটিকে। অরূপ বলেন, “আমি নাম দিয়েছি দিশা। আমি চাই সরকারের তরফে এই মেয়েটির একটা কোনও স্থায়ী রোজগারের সংস্থান করে দেওয়া হয়। যাতে সে তাঁর সন্তানকে নিয়ে স্বাধীন ভাবে বাঁচতে পারে।”

পুরুলিয়া জেলা পুলিশের এক শীর্ষ আধিকারিক সব শুনে বলেন, “আমরা ওই শবর স্কুলে খোঁজ নিচ্ছি। শিশু ও তার মা-র নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার চেষ্টা করছি।” পুরুলিয়া জেলা তৃণমূল সভাপতি শান্তিরাম মাহাতো ঘটনা শুনে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন,“আমি জেলা প্রশাসনকে বলছি বিষয়টি খতিয়ে দেখতে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Purulia Tribal Diktat Kangaroo Court
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE