কঙ্কাল দু’টোর কোমরে কেবল ছেঁড়া ইলাস্টিক। পোশাকের অবশেষ বলতে ওই টুকুই। ঘড়ি, আংটির মতো জিনিসও নেই। ডিএনএ নমুনা মিলছে কি না, সেটা পরীক্ষা করা ও তার ফল বেরোতেও ঢের দেরি। কিন্তু শুক্রবার লালগড়ের ভুলাগাড়া জঙ্গলে উদ্ধার হওয়া দু’টি কঙ্কাল ছ’বছর আগে নিখোঁজ হওয়া রাজ্য পুলিশের দুই কনস্টেবল কাঞ্চন গড়াই ও সাবির আলি মোল্লার বলেই আশাবাদী গোয়েন্দাদের একটা বড় অংশ। কঙ্কাল উদ্ধারের পর পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষ সাংবাদিক বৈঠকও করেছেন।
অথচ লালগড়-সহ কংসাবতীর পাড়ে জঙ্গলমহলের ওই তল্লাটে কঙ্কাল, হাড়গোড় গত চার বছরে কম মেলেনি। তা হলে শুক্রবার সকালের জোড়া কঙ্কাল ২০০৯-এর ৩০ জুলাই নিরুদ্দেশ দুই কনস্টেবলেরই বলে এ বার পুলিশ এত আশায় কেন?
গোয়েন্দা সূত্রের খবর, প্রথমত, ওই জোড়া কঙ্কালের সন্ধান দিয়েছেন লালগড়ের বোনিশোল গ্রামের এক যুবক, যিনি নাকি দুই পুলিশকর্মীকে মেরে ওই জায়গায় পুঁতে দেওয়ার প্রত্যক্ষদর্শী। মোটা টাকা ও চাকরির টোপ দিয়ে পুলিশ তার কাছ থেকে ওই খবর পেয়েছে। ঘটনা যখনকার, তখন ওই যুবক মাওবাদীদের গণ সংগঠন পুলিশি সন্ত্রাসবিরোধী জনসাধারণের কমিটির সক্রিয় সদস্য ছিলেন।
এখন অবশ্য তিনি শাসক দলের ঘনিষ্ঠ বলে স্থানীয় সূত্রের খবর। বৃহস্পতিবার গোয়েন্দাদের পক্ষে নির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি ও আশ্বাস পেয়ে তিনি কঙ্কাল দু’টির হদিস পুলিশকে দেন। তার পরেই বর্ধমান থেকে সাবির আলি মোল্লা ও বাঁকুড়া থেকে কাঞ্চন গড়াইয়ের বাড়ির লোককে জরুরি ভিত্তিতে তলব করে পশ্চিম মেদিনীপুর পুলিশ।
কাঞ্চনের ভাই চিত্তরঞ্জন গড়াই ও সাবিরের দাদা সামাদ মোল্লা— দু’জনেরই বক্তব্য, ‘‘জঙ্গলের মধ্যে যেখানে মাটি খুঁড়ে কঙ্কাল পাওয়া গিয়েছে, প্রত্যক্ষদর্শী ছাড়া অন্য কারও পক্ষে হদিস দেওয়া মুশকিল।’’
দ্বিতীয়ত, এক গোয়েন্দা অফিসার বলেন, ‘‘এ যাবৎ মাওবাদীদের হাতে খুন হওয়া যে সব ব্যক্তির কঙ্কাল এলাকায় পাওয়া গিয়েছে, সেগুলো মিলেছে মাটির তিন ফুট গভীরে। কিন্তু এই দু’টি কঙ্কাল মিলেছে মাটি থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ ফুট গভীরে।’’ ওই অফিসারের বক্তব্য, ‘‘পুলিশ বলেই ওই দু’টি দেহ বেশি গভীরে পোঁতা হয়েছিল। আমাদের সোর্স এটাও স্বীকার করেছে।’’ একই গর্তে উপর-নীচ করে শোয়ানো অবস্থায় কঙ্কাল দু’টি পাওয়া গিয়েছে।
কাঞ্চনের ভাই চিত্তরঞ্জন বলেন, ‘‘আমরা জেনেছি, খুন করার কিছুক্ষণ আগে ওদের দু’জনের গা থেকে পুলিশের উর্দি খুলে নিয়ে শুধু অন্তর্বাস পরিয়ে রাখা হয়েছিল। তারই ইলাস্টিক কঙ্কাল দু’টির কোমরে পাওয়া গিয়েছে। দু’জনের উর্দি পুঁতে দেওয়া হয় অন্যত্র।’’ সিআইএফ (কাউন্টার ইনসারজেন্সি ফোর্স) সূত্রের খবর, ওই উর্দির সন্ধান করা হচ্ছে।
কাঞ্চনের ভাই চিত্তরঞ্জনের বক্তব্য, ভুলাগাড়া-সহ গোটা ধরমপুর তল্লাটে জনসাধারণের কমিটির নেতা তখন দিলীপ মাহাতো। তাঁর বাড়ি ভুলাগাড়া গ্রামেই। চিত্তরঞ্জন বলেন, ‘‘তখন দিলীপ মাহাতোর প্রবল প্রতাপ। সাবির আলি মোল্লা ও আমার দাদাকে অপহরণের পিছনে দিলীপ মাহাতোর বড় ভূমিকা ছিল বলে জেনেছি।
তা হলে কঙ্কাল উদ্ধার হওয়ার পর ওঁকে কেন নতুন করে জেরা করা হবে না?’’
সেই দিলীপ মাহাতো এখন শাসক দল তৃণমূলের ধরমপুর অঞ্চল সভাপতি। তাঁর স্ত্রী টুলুরানি মাহাতো তৃণমূলের টিকিটে নির্বাচিত হওয়া পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য। চিত্তরঞ্জন গড়াই বলেন, ‘‘শাসক দলের স্থানীয় নেতা বলে দিলীপকে রেহাই দিলে ভুল হবে। আমরাও তৃণমূল করি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ক্ষমতায় আনতে আমাদের অবদানও কিছু কম নেই।’’ প্রসঙ্গত, কাঞ্চনের বাবা বাসুদেব গড়াই বাঁকুড়ার ছাতনার ঘোষেরগ্রাম গ্রাম পঞ্চায়েতের তৃণমূল সদস্য।
দিলীপ মাহাতোর দাবি, ‘‘আমি জীবনে একটা পিঁপড়ে পর্যন্ত মারিনি। আর দু’জন পুলিশকে খুন করব? আমি ওঁদের ব্যাপারে কিছু জানি না।’’ তা হলে কে জানেন? দিলীপ বলেন, ‘‘তখন এই তল্লাটে কমিটির নেতা ছিলেন অসিত মাহাতো। তিনি বলতে পারবেন।’’ অসিত আবার বলছেন, ‘‘কে, কী দাবি করলেন, সেটা নিয়ে আমার কী বলার আছে? ওই দুই পুলিশকর্মীকে অপহরণের ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না।’’
কাঞ্চন ও সাবির নিখোঁজ হওয়ার দু’মাসের মধ্যে গ্রেফতার হন কমিটির অন্যতম শীর্ষনেতা ছত্রধর মাহাতো। গোয়েন্দারা জানান, জেরায় ছত্রধর বলেছিলেন, ওই দুই কনস্টেবলকে বড় বৃন্দাবনপুর গ্রামের কাছে অপহরণ করা হয়। সেই খবর পেয়ে দিলীপ মাহাতো ও অসিত মাহাতোকে ফোনে ছত্রধর বলেন, ওই দুই পুলিশকর্মীর যেন কোনও ক্ষতি না করা হয়। কিন্তু তাঁর সেই কথা শোনা হয়নি
বলে ছত্রধর জানান। দিলীপ মাহাতো অবশ্য বলেন, ‘‘তৃণমূল করি বলে আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা চলছে।’’ দলের ব্লক সভাপতি বনবিহারী রায়ের বক্তব্য, ‘‘মাওবাদীদের হুমকির মুখে তখন বহু লোককেই কমিটিতে নাম লেখাতে হয়। দিলীপও তেমন ছিল। এর বেশি ভূমিকা ওর ছিল বলে মনে হয় না।’’
দুই পুলিশকর্মী অপহরণের মামলায় বছর চারেক আগে দিলীপ মাহাতোকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। এখন তিনি জামিনে মুক্ত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy