নিহতের বাড়ির সামনে গ্রামবাসীদের জমায়েত। আমডাঙার পাঁচপোতা গ্রাম।- নিজস্ব চিত্র।
পাঁচপোতায় ঢোকা মাত্র ভিড়টা ছেঁকে ধরল। ‘কোথা থেকে আসছেন?’ ‘কী চান?’ ‘কাল যখন আমাদের লোক খুন হল তখন কোথায় ছিলেন আপনারা?’ একের পর এক প্রশ্নের তির উড়ে আসছে আমাদের দিকে। খুব কম সময়ের মধ্যেই ‘আপনি’ সম্বোধনটা পাল্টে গেল ‘তুই’-তে। সঙ্গে বাছাই করা গালিগালাজ। শুধু গায়ে হাত পড়াটাই বাকি।
এই তীব্র উত্তেজনার সূত্রপাত সোমবার, পঞ্চায়েত ভোটের দিন। ওই দিন উত্তর ২৪ পরগনার আমডাঙার চণ্ডীগড় গ্রাম পঞ্চায়েতের পাঁচপোতা স্কুলে ভোট চলাকালীন বোমা ফেটে মৃত্যু হয় সিপিএম কর্মী তৈবুর গায়েনের। তার পর থেকেই উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে আমডাঙা ব্লকের আটটি পঞ্চায়েতে। অভিযোগের আঙুল ছিল তৃণমূলের দিকে। ভোট কেটে যাওয়ার পরে এখন কেমন আছে আমডাঙা, তা দেখতেই এ দিন সেখানে যাওয়া।
এ দিন সকালে পাঁচপোতা গ্রামে ঢোকার অনেক আগে থেকেই আমডাঙা এলাকারই সন্তোষপুর, আওয়ালসিদ্ধি, কামদেবপুর, দরিয়াপুর, হামিদপুর, মামুদপুর-সহ অন্যত্রও দেখা যাচ্ছিল ছোট-বড় জটলা। অনেকের মুখে গামছা জড়ানো। চোখে-মুখে অবিশ্বাস। অপরিচিত মুখ দেখলেই আটকানো হচ্ছে। হাজারো প্রশ্ন পেরিয়ে তবে গাড়ি এগোতে পারছে। কিন্তু, অসন্তোষের কেন্দ্রস্থলের অবস্থাটা ঠিক কী, তা স্পষ্ট টের পাওয়া গেল পাঁচপোতায় নামার পর।
দুষ্কৃতীদের বোমায় হাত উড়ে যাওয়ার পর হাসপাতালে কাজি গোলাম কিবরিয়া, (ইনসেটে) নিহত তৈবুর গায়েন। -নিজস্ব চিত্র।
সোমবার পঞ্চায়েত ভোট মেটার পর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন অনেকেই। যাক, বাঁচা গেল! কিন্তু সেই ‘শান্তি’তে জল ঢেলে, ভোটের পরও নির্বাচনী সন্ত্রাস থামেনি। অনেক গ্রামেই সাধারণ মানুষ যখন এই নিয়ে আতঙ্কে, তখন ঘুরে দাঁড়িয়ে পাল্টা মারের হুঙ্কার দিচ্ছেন আমডাঙার বাসিন্দারা। ক্ষোভে ফুঁসতে ফুঁসতে তাঁদের হুঙ্কার: রক্ত ঝরলে, আর এক জনও খুন হলে, এ বার পাল্টা লাশও পড়বে।”
আরও পড়ুন- সিপিএম পদ্ম আঁকছে, কটাক্ষ
আরও পড়ুন- ভোট পরবর্তী হিংসা অব্যাহত, নিহত আরও ৪
সাংবাদিক দেখে ক্ষোভ উগরে দিতে শুরু করলেন তাঁদেরই অনেকে।
ক্ষোভের পাশাপাশি গ্রামবাসীরা এতটাই ভীত যে কেউ নাম বলতে চাননি। তাঁদের অভিযোগ, ভোট হয়ে যাওয়ার পরেও বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভয় দেখাচ্ছে শাসক দলের লোকজন। প্রাণে মেরে ফেলার হুমকিও দেওয়া হচ্ছে। গ্রামে গ্রামে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে দুষ্কৃতী বাহিনী। পুলিশ বসে রয়েছে থানায়। তাদের দেখা মিলছে না গ্রামবাসীদের নিরাপত্তায়। আর এই অবস্থায়, প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন আমডাঙাবাসী। এমনকী, মহিলারাও হাতে তুলে নিয়েছেন বাঁশ, লাঠি। তাঁদের হুঙ্কার, “লাশ পড়লে এ বার আমরাও লাশ ফেলব।”
গ্রামবাসীরা ফুঁসছেন। তৈবুরের মৃত্যুর জন্য পুলিশি গাফিলতিকেই দায়ী করছেন তাঁরা। পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে তাদের উপর ক্ষোভ বাড়ছে গ্রামের মানুষের।
১২ ঘণ্টার বনধে দোকানপাট বন্ধ আমডাঙায়। -মঙ্গলবারের নিজস্ব চিত্র।
গ্রামে ফল বিক্রি করে সংসার চালাতেন তৈবুর। তাঁর উপরেই নির্ভরশীল ছিল পরিবার। বয়স মাত্র ২৯ বছর। খুব কম বয়সেই বিয়ে হয়। এক ছেলে, এক মেয়ে। সবে স্কুল যেতে শিখেছে। এরই মধ্যে তারা বাবাকে হারাল। ভেঙে পড়েছে গোটা পরিবার। তৈবুরের বাবা মোস্তাফা বলেন, “ছেলে চলে গেল। ওকে আর ফিরে পাব না। পরিবারের কী হবে, ভেবে পাচ্ছি না।”
তৈবুরকে বাঁচাতে গিয়ে গুরুতর জখম হন বন্ধু কাজি গোলাম কিবরিয়া। বোমার আঘাতে গোলামেরও একটি হাত বাদ গিয়েছে। আপাতত বারাসত হাসপাতালে ভর্তি তিনি। আহত হয়েছেন আরও দুই গ্রামবাসী। অভিযোগ, এত কিছুর পরেও পুলিশ দুষ্কৃতীদের গ্রেফতার করতে পারছে না। অথচ তারা গ্রামেই ঘুরে বেড়াচ্ছে।
কারা এরা? প্রশ্নের জবাব এল, অনেকেই এলাকার তৃণমূল সমর্থক। আবার অনেকে বাইরে থেকেও এসেছিল। পুলিশে অভিযোগ জানানো সত্ত্বেও, কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। তাঁরা হুমকির সুরে বলেন, যদি এর পরে কোনও বড়সড় গোলমাল বাধে, তার দায়িত্ব প্রশাসনকেই নিতে হবে। যদিও এই ঘটনায় তাঁদের কেউ জড়িত নন বলে স্থানীয় তৃণমূল সূত্রে দাবি করা হয়েছে। আর ঘটনার কথা বলতে শুরু করা মাত্রই আমডাঙার তৃণমূল বিধায়ক রফিকুর রহমান শুধু বললেন, ‘‘পরে ফোন করুন।’’ ফোন কেটে দেন তিনি। এর পরে বার পাঁচেক ফোন করা হলেও বিধায়ক আর ফোন ধরেননি।
তৈবুরের হত্যাকাণ্ড এবং ভোটের দিন সার্বিক সন্ত্রাসের প্রতিবাদে এ দিন আমডাঙায় ১২ ঘণ্টার বনধ ডেকেছিল সিপিএম। সেই বনধে গ্রামবাসীরাও সামিল হন। রাস্তাঘাটে লোকজন কম। দোকানপাটও কমই খোলা। বিরোধীদের দাবি, আমডাঙা ব্লকের আটটির মধ্যে ছ’টি পঞ্চায়েতেই সন্ত্রাস চলেছে। তার মধ্যে ৫০টি বুথে পুনর্নির্বাচনের দাবি করেছেন বিরোধীরা। সেই মর্মে মঙ্গলবার তাঁরা বিডিও অফিসে অভিযোগপত্র জমা দেন। শুধু আমডাঙাই নয়, উত্তর ২৪ পরগনার দেগঙ্গা, স্বরূপনগর, বাদুড়িয়াতেও একই ভাবে সন্ত্রাস চালানোর অভিযোগে পথে নেমেছেন স্থানীয় মানুষ। কোথাও চলেছে অবরোধ। কোথাও দুষ্কৃতীদের গ্রেফতারের দাবিতে থানায় বিক্ষোভ দেখানো হচ্ছে। বাদুড়িয়ার জগন্নাথপুরেও একই ভাবে তাণ্ডব চলে। গুলি চলেছে, বোমা পড়েছে মুড়ি-মুড়কির মতো। স্থানীয় গৌরী সর্দারের গুলি লাগে। তিনি এখন হাসপাতালে। আহত হয়েছেন আরও চার জন। দেগঙ্গার পূর্বপাড়ায় ভোট লুঠ রুখতে গিয়ে জখম হন বহু মানুষ। বিরোধীরা এর প্রতিবাদে এ দিন বিডিও অফিস এবং থানায় অভিযোগ জানান।
পাঁচপোতা ক্ষোভে ফুঁসছে বটে, কিন্তু তারই মধ্যে মাথা ঠান্ডা রেখে যুক্তি-বুদ্ধির উপরে ভরসা রেখেছেন কয়েক জন। সেই তাঁরাই বাকিদের বুঝিয়ে এই সাংবাদিককে ফেরার পথ করে দিলেন। বললেন, ‘‘ওঁরা কী করবেন? ওঁরা তো আর মারেননি। ধৈর্য ধরো। সত্যিকারের বদমাইশরা এলে ওদের মারার জন্য তৈরি থাক।’’
বোঝা গেল, আমডাঙার উত্তেজনা এত তাড়াতাড়ি কমার নয়!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy