Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

সাক্ষী খুনে অভিযুক্ত নিহত ছাত্রীর বাবা

সালিশি সভায় বাবাকে অপমানিত হতে দেখে প্রতিবাদ করেছিল দশম শ্রেণির এক ছাত্রী। পরের দিন সকালে ট্রেন লাইনের ধারে তার বিবস্ত্র দেহ উদ্ধার হয়। বছর খানেক আগের সেই ঘটনায় রাজ্য জুড়ে তোলপাড় পড়ে যায়। তৃণমূলের স্থানীয় ওয়ার্ড কমিটির সভাপতি গোবিন্দ ভৌমিক ও সেই ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর নমিতা রায়ের স্বামী চন্দ্রকান্ত রায় সহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে ওই নাবালিকাকে গণধর্ষণের পরে খুন করা হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়।

পড়ে রয়েছে নিতাই সিংহ রায়ের দেহ। — ফাইল চিত্র।

পড়ে রয়েছে নিতাই সিংহ রায়ের দেহ। — ফাইল চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
ধূপগুড়ি শেষ আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০১৫ ০৩:৪৭
Share: Save:

সালিশি সভায় বাবাকে অপমানিত হতে দেখে প্রতিবাদ করেছিল দশম শ্রেণির এক ছাত্রী। পরের দিন সকালে ট্রেন লাইনের ধারে তার বিবস্ত্র দেহ উদ্ধার হয়। বছর খানেক আগের সেই ঘটনায় রাজ্য জুড়ে তোলপাড় পড়ে যায়। তৃণমূলের স্থানীয় ওয়ার্ড কমিটির সভাপতি গোবিন্দ ভৌমিক ও সেই ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর নমিতা রায়ের স্বামী চন্দ্রকান্ত রায় সহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে ওই নাবালিকাকে গণধর্ষণের পরে খুন করা হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়। সেই ঘটনার প্রধান সাক্ষী নিতাই সিংহ রায়ের (৩৬) দেহ পাওয়া গিয়েছে সম্প্রতি। তবে নিতাইবাবুকে ওই ছাত্রীর বাবা ও মামাই খুন করেছেন বলে অভিযোগ। যা শুনে ওই ছাত্রীর বাবা ও স্থানীয় মানুষ অবাক। ওই ছাত্রীর বাবা বলেন, ‘‘আমার মেয়ের খুনের ঘটনায় যিনি প্রধান সাক্ষী, আমি কেন তাঁকেই খুন করতে যাব?’’ তাঁর দাবি, ‘‘তৃণমূলের স্থানীয় নেতাদের চাপেই আমার বিরুদ্ধে নিতাইবাবুকে খুনের অভিযোগ করা হয়েছে।’’ তৃণমূল অবশ্য সেই দাবি অস্বীকার করেছে।

স্থানীয় মানুষ ও বিরোধী নেতারাও কিন্তু বলছেন, শাসক দলের মদতেই ওই ছাত্রীর বাবাকে ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিরোধীদের বক্তব্য, উত্তর ২৪ পরগনার কামদুনি ও মধ্যমগ্রামের ধর্ষণ ও খুনের ঘটনাতেও শাসক দল অভিযুক্তদের আড়ালের চেষ্টা করেছিল। কামদুনির ঘটনায় বারাসত আদালতে কোনও আইনজীবী অভিযুক্তদের পক্ষে দাঁড়াতে চাননি। তখন মামলাটি বারাসত থেকে শাসক দলের পরোক্ষ প্রভাবেই আলিপুর দায়রা আদালতে সরানো হয় বলে অভিযোগ করেছিল মৃতার পরিবারই। মধ্যমগ্রামের ঘটনাতে অভিযুক্তদের আড়াল করতে তৃণমূলের হস্তক্ষেপের প্রমাণ মিলেছে আরও জোরালো ভাবে। পুলিশ নিগৃহীতাকে যথেষ্ট নিরাপত্তা দিতে পারেনি। ওই তরুণীকে দ্বিতীয়বার ধর্ষণ করা হয়। তিনি এলাকা ছাড়েন। তার পরে পুড়ে যাওয়ার ঘটনার পরও পুলিশ তাঁর দেহ পরিবারের কাউকে না জানিয়ে দাহ করারও ব্যবস্থা করে ফেলেছিল বলে অভিযোগ ওঠে।

ধূপগুড়ির ক্ষেত্রেও একই ভাবে শাসক দল প্রভাব খাটাচ্ছে বলে দাবি বিরোধীদের। সিপিএমের জলপাইগুড়ি জেলা সম্পাদক সলিল আচার্যের বক্তব্য, ‘‘নিজের মেয়ের খুনের মামলার প্রধান সাক্ষীকে কেউ খুন করে? আসলে ওই ছাত্রী খুনের ঘটনায় তৃণমূলের একাধিক ব্যক্তি অভিযুক্ত। তাই এখন ওই ছাত্রীর বাবা ও মামাকে শাসক দলের মদতেই ফাঁসানোর চেষ্টা হচ্ছে।’’

গত সোমবার নিতাইবাবুর দেহ পাওয়া যায় ধূপগুড়ি পুরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের একটি ধান খেতে। নিতাইবাবু লটারির টিকিট বিক্রি করতেন। গত বছর ১ সেপ্টেম্বর ধূপগুড়ির ৯ নম্বর ওয়ার্ডেই সালিশি সভা বসে বলে অভিযোগ। নিতাইবাবু পুলিশকে বয়ানে পরিষ্কার জানিয়েছিলেন, সে দিন সালিশি সভায় কে কে উপস্থিত ছিলেন। তাঁর বয়ানে স্পষ্ট বলা রয়েছে, ওই ছাত্রীর বাবাকে কী ভাবে মারধর করা হয়েছিল এবং তার প্রতিবাদ করায় ওই ছাত্রীকেও চুলের মুঠি ধরে থুতু চাটতে বলা হয়েছিল।


সবিস্তার জানতে ক্লিক করুন।

নিতাইবাবুর স্ত্রী নমিতাদেবীর কিন্তু অভিযোগ, ওই ছাত্রীরই বাবা ও মামা সহ কয়েক জন তাঁর স্বামীকে হত্যায় যুক্ত। কিন্তু কেন তাঁরা সে কাজ করবেন, তার যুক্তি নমিতাদেবী দিতে পারেননি। তাঁর দাবি, ‘‘উনি আমার স্বামীকে হুমকি দিতেন। কেন খুন করতে পারেন, সেটা পুলিশ দেখুক। আমি লিখিত অভিযোগ করেছি।’’ জলপাইগুড়ির এসপি আকাশ মেঘারিয়া বলেন, “অভিযোগে কেউ কিছু নাম জানাতেই পারেন। কিন্তু তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” ওই ছাত্রীর বাবা বা মামাকে নিতাইবাবুর খুনের ঘটনায় পুলিশ এখনও কোনও কথা জিজ্ঞাসা করেনি।

অভিযোগপত্র কে লিখে দিয়েছেন, তা নিয়েও রহস্য রয়েছে। নিতাইবাবুর স্ত্রী নমিতাদেবীর দাবি, “আমি পাঁচ জনের নামের অভিযোগপত্র লিখে পুলিশকে দিয়েছি।” কিন্তু তাঁর কথা শেষ না হতে নমিতাদেবীর ভাসুরের স্ত্রী প্রতিমাদেবী তাঁকেই জিজ্ঞাসা করেন, ‘‘ঘটনার পরে তুমি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলে। অভিযোগপত্র লিখলে কখন?’’ মৃতের দাদা সিপিএম সমর্থক ভজন সিংহ রায়ের বক্তব্য, “আমাদের পরিবার থেকে কেউ অভিযোগপত্র লিখে থানায় জমা দেয়নি।” ভজনবাবু বলেন, “ভাইয়ের সঙ্গে পাড়ার কোনও মানুষের ঝগড়া ছিল না।’’ তাঁর কথায়, ‘‘কে ওই অপরাধের সঙ্গে জড়িত, সেটা জানলে তো কথাই ছিল না।” ওই ছাত্রীর মামা বলেন, “ভাগ্নিকে খুনের ঘটনায় জড়িত দশ তৃণমূল নেতা ও কর্মী জেল থেকে ছাড়া পেয়ে নানা ভাবে আমাদের নাস্তানাবুদ করার চেষ্টা করছে। আমাদের মামলার সাক্ষীকে খুন করার পরে আমাদেরই ফাঁসানো হচ্ছে।”

তৃণমূলের ওয়ার্ড কমিটির সভাপতি গোবিন্দবাবুর দাবি, ‘‘নিতাইবাবু ওয়ার্ডেরই বাসিন্দা। গরিব পরিবার। তাই ঘটনার পরে কিছু সাহায্য করা হয়েছে। কিন্তু ওঁরা কার নামে কখন অভিযোগ করেছেন, সেটা জানা নেই।’’ গোবিন্দবাবু ও তাঁর অনুগামীরা সম্প্রতি তাঁদের হুমকি দিয়েছেন বলে ওই ছাত্রীর পরিবারের দাবি। গোবিন্দবাবু সে দাবি মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তৃণমূলের জেলা সভাপতি সৌরভ চক্রবর্তীর কথায়, “ধূপগুড়ির ওই ঘটনার বিষয়ে কিছু জানি না। খোঁজ নিয়ে দেখব।”

এ দিন খুনের খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে সাংবাদিকরা এলাকার একদল বাসিন্দার হাতে ঘেরাও হন। তৃণমূলের দখলে থাকা ওয়ার্ডে বিক্ষোভের সামনের সারিতে ছিলেন শাসক দলেরই কয়েক জন। সাংবাদিকদের এ ভাবে ঘিরে রাখার খবর পেয়ে তৃণমূলের জেলা নেতারাও বিব্রত হন। শেষ পর্যন্ত পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে প্রায় আধ ঘণ্টা বাদে সাংবাদিকদের ‘দেখে নেওয়ার হুমকি’ দিয়ে ছেড়ে দেন ওই বিক্ষোভকারীরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE