Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
প্রতিরোধের ছবি

ইটবৃষ্টির মুখে পড়ে দে দৌড় বহিরাগতদের

প্রতিরোধে আশা দেখছে বিরোধীরা। উদ্বেগ তৃণমূল শিবিরে! কলকাতা যা পারেনি, বিক্ষিপ্ত ভাবে হলেও শনিবার তা করে দেখাল জেলা। পুরভোটের নিরবচ্ছিন্ন সন্ত্রাসের মধ্যে বিচ্ছিন্ন প্রতিরোধ দেখা গেল একাধিক জেলায়। অনেক জায়গায় বিরোধী দলের সমর্থক মহিলারা ইট-বঁটি হাতে তাড়া করে এলাকা ছাড়া করলেন সন্ত্রাস চালাতে আসা বহিরাগতদের। কোথাও আবার বহিরাগতদের পিটিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দিল আম জনতাই।

বুথে হামলার অভিযোগ উঠেছিল বহিরাগতদের বিরুদ্ধে। তাঁদেরই এক জনকে হাতের সামনে পেয়ে মার জনতার। বাঁকুড়া শহরের লোকপুরে। ছবি: অভিজিৎ সিংহ

বুথে হামলার অভিযোগ উঠেছিল বহিরাগতদের বিরুদ্ধে। তাঁদেরই এক জনকে হাতের সামনে পেয়ে মার জনতার। বাঁকুড়া শহরের লোকপুরে। ছবি: অভিজিৎ সিংহ

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:৪৫
Share: Save:

প্রতিরোধে আশা দেখছে বিরোধীরা। উদ্বেগ তৃণমূল শিবিরে!
কলকাতা যা পারেনি, বিক্ষিপ্ত ভাবে হলেও শনিবার তা করে দেখাল জেলা। পুরভোটের নিরবচ্ছিন্ন সন্ত্রাসের মধ্যে বিচ্ছিন্ন প্রতিরোধ দেখা গেল একাধিক জেলায়। অনেক জায়গায় বিরোধী দলের সমর্থক মহিলারা ইট-বঁটি হাতে তাড়া করে এলাকা ছাড়া করলেন সন্ত্রাস চালাতে আসা বহিরাগতদের। কোথাও আবার বহিরাগতদের পিটিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দিল আম জনতাই।
দিনের শেষে বিরোধী দলগুলির অনেক নেতার গলাতেই আক্ষেপ, এই প্রতিরোধ যদি সার্বিক ভাবে করা যেত, তা হলে হয়তো এ দিন ভোট-সন্ত্রাসের ছবিটা অনেকটাই আলাদা হতো। বাঁকুড়ার সোনামুখী থেকে হাওড়ার উলুবেড়িয়া, পশ্চিম মেদিনীপুরের ক্ষীরপাই থেকে উত্তর ২৪ পরগনার বিরাটি— সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে এ দিন রুখে দাঁড়াতে দেখা গিয়েছে আম জনতা ও বিরোধী দলের কর্মীদের। এই বিক্ষিপ্ত প্রতিরোধ আগামী দিনে আরও বড় আকার নেবে, এমনই দাবি বিরোধীদের। এমনকী, তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের একাংশও একান্ত আলাপচারিতায় এই প্রতিরোধ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাঁদের বক্তব্য, এ দিন আরও কিছু জায়গায় এই ধরনের প্রতিরোধ হলে হয়তো আরও রক্ত ঝরত। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরও অবনতি হত।
কেমন ছিল এ দিনের প্রতিরোধ?
উত্তর শহরতলির বিরাটির ঘটনাতেই তা স্পষ্ট। উত্তর দমদম পুরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্গত ওই এলাকার সাহাবাগান কমিউনিটি হলের বুথের সামনে জটলা করেছিল কিছু বহিরাগত যুবক। প্রতিবাদ করেন এলাকার কিছু মহিলা। ওই যুবকেরা হুমকি দেয়, বাড়াবাড়ি করলে ভোট দিতেই দেওয়া হবে না। তর্কাতর্কির মধ্যেই কিছু যুবক তেড়ে যায় ওই মহিলাদের দিকে। মহিলারা পিছু হটেননি। বরং রাস্তা থেকে ইট, পাথর কুড়িয়ে নিয়ে পাল্টা হামলা চালালেন। হুমকি ভুলে তখন দে দৌড় ওই বহিরাগতদের। নিশ্চিন্তে ভোট দিয়ে বেরোলেন ওই মহিলারা।
বসিরহাটই বা কম যায় কীসে! ওই পুরসভার হরিশপুর এলাকায় ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের কিছু বুথে বোমা-গুলি চালানো শুরু হয়। ওই ওয়ার্ডের কংগ্রেস প্রার্থী সুকেশ ঘোষাল আহত হন। তিনি পালাতে গেলে তাঁর পিঠে ক্ষুর মারা হয়। সে সময়ে নিউটাউনের এক দুষ্কৃতীকে তাড়া করে ধরে পিটুনি দেয় জনতা। পুলিশ এলে তাদেরও জনতার বিক্ষোভের মুখে পড়তে হয়।
প্রতিরোধ প্রসঙ্গে তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় এ দিন বলেন, ‘‘বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনা ঘটেছে। অনেকে তা নিয়ে বেশি হইচই করছেন। কিন্তু আজ এমন ভয়াবহ ভূকম্পের দিনে মানুষের পাশে দাঁড়ানোটাই জরুরি। এ নিয়ে মন্তব্য করতে চাই না।’’ বিক্ষিপ্ত প্রতিরোধেও কিন্তু আশার আলো দেখছেন বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্য। তাঁর কথায়, ‘‘সর্বত্র প্রতিরোধ হয়তো হয়নি। সংগঠনের জোর, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, এলাকার পরিস্থিতি অনুযায়ী কিছু এলাকায় প্রতিরোধ হয়েছে। তবে এটাও ঠিক, প্রতিরোধের এই শুরু। মানুষ মুখ বুজে সন্ত্রাস মানবেন না!’’


ক্ষীরপাইয়ে তৃণমূল বাহিনীকে রুখে দিলেন সিপিএমের প্রমীলা বাহিনী। ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল।

শমীকবাবুর বক্তব্যেরই যেন প্রতিফলন ঘটেছে উলুবেড়িয়ায়। ওই পুরসভার ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের নোনা ২ প্রাথমিক স্কুলের বুথের কাছে এ দিন দুপুর ১২টা নাগাদ জটলা করেছিল শ’তিনেক যুবক। নেতৃত্বে তৃণমূল নেতা অজয় মণ্ডল। বেশ কিছু ভোটারকে তাঁরা বুথে ঢুকতে বাধা দেন বলে অভিযোগ। ক্ষোভ তখন থেকেই জমছিল। বুথের ভিতরে তখন তৃণমূলের বিরুদ্ধে বহিরাগত এনে ছাপ্পা ভোট দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। গ্রামবাসী এবং কিছু ভোটার তখন পুলিশকর্মীদের বলেন, ‘‘বন্দুক আমাদের দিন। আমরাই বহিরাগতদের তাড়িয়ে দেব।’’ পুলিশকে ঘিরে শুরু হয়ে যায় বিক্ষোভ। পরিস্থিতি বুঝে সক্রিয় হতে বাধ্য হয় পুলিশ। প্রায় এক ঘণ্টা বন্ধ থাকার পরে পুলিশ প্রহরায় ফের শুরু হয় ভোট গ্রহণ।
সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র বারবার প্রতিরোধের কথা বলছেন। তাঁর নিজের জেলা পশ্চিম মেদিনীপুরের ক্ষীরপাই পুরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কিছু সিপিএম সমর্থক মহিলা এ দিন সেটাই করেছেন। ওই ওয়ার্ডে গতবার জিতেছিল সিপিএম। অভিযোগ, এ দিন সকালে বহিরাগত জনা কুড়ি তৃণমূল কর্মী-সমর্থক এসে বুথে ঢুকতে গেলে বাধা দেন ওই ওয়ার্ডের সিপিএম প্রার্থী অজয় সিংহ। কিন্তু তিনি বিশেষ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেননি। উল্টে সিপিএম কর্মীরাই মার খেয়ে যান। এর পরই সিপিএম কর্মীদের বাড়ির মহিলারা লাঠিসোঁটা এনে হামলাকারীদের তাড়া করেন। দীপালি পাতর, জ্যোত্‌স্না পাতর, দুর্গা প্রামাণিকদের বক্তব্য, “বাড়ির ছেলেরা মার খাবে, আর আমরা তা বসে বসে দেখব, এটা হতে পারে না। একবার সন্ত্রাস মুখ বুজে সহ্য করলে তো ওরা বারবার সন্ত্রাস করবে!’’ ভোটারদের প্রতিবাদ হয়েছে এই জেলারই রামজীবনপুর পুরসভায়। ২ নম্বর ওয়ার্ডের রামেশ্বরপুর এলাকায় বুথ দখলের চেষ্টার অভিযোগে বিদায়ী পুরপ্রধান তথা তৃণমূল প্রার্থী শিবরাম দাসের ভাই অভিরামকে এ দিন ঘিরে ধরেন ভোটাররা। অভিযুক্তদের ধরার দাবিতে বিক্ষোভ দেখান এলাকার মহিলারা। পুলিশ প্রথমে অভিরামকে আটক করলেও পরে ছেড়ে দেয়। অভিরামের দাবি, “বুথে ঢুকিনি। বিরোধীরা স্থানীয় মানুষকে ভুল বুঝিয়ে অশান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করেছে।”
সোনামুখীতেও ছবিটা আলাদা নয়। শুক্রবার দুপুরেই বাঁকুড়া জেলার ওই পুর-শহরের ৮ নম্বর ওয়ার্ডে এক তৃণমূল কর্মীর বাড়ি থেকে ৩৭ জন বহিরাগতকে ঘেরাও করে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিলেন এলাকাবাসীর একাংশ ও বাম কর্মীরা। এ দিন ভোর থেকেই ৭ নম্বর ওয়ার্ডের আরএসপি প্রার্থী তথা সোনামুখীর বিদায়ী উপপুরপ্রধান তপন দত্তের বাড়ির সামনে জড়ো হয়েছিল জনা ৪০ বহিরাগত দুষ্কৃতী। তারা ঝামেলা করছে খবর রটতেই এলাকাবাসী বহিরাগতদের ধাওয়া করেন। দুষ্কৃতীরা পালাতে থাকে। তাদের মধ্যে দু’জন স্থানীয় এক বাসিন্দার বাড়িতে ঢুকে পড়ে। এলাকাবাসী তাদের বের করে চড় থাপ্পড় মেরে পুলিশের হাতে দেন। বাঁকুড়া শহরেও গোলমাল পাকানোর অভিযোগে এক বহিরাগতকে পিটিয়েছেন সাধারণ মানুষ।
সাধারণ ভোটারদের একটা বড় অংশ মনে করেন, তাঁরা যে সাহস দেখালেন, তা বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা দেখালে বহিরাগত দুষ্কৃতীদের দাপাদাপি এতটা বাড়াবাড়ি জায়গায় পৌঁছত না। সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম অবশ্য বলছেন, ‘‘সর্বত্র সন্ত্রাস রোখার ডাক দেওয়া হয়েছিল ঠিকই। তবে তার জন্য তো দলীয় কর্মীদের হঠকারি কাজ করার নির্দেশ দেওয়া সম্ভব নয়! সম্ভব নয়, বাইরে থেকে গুন্ডা জুটিয়ে ভোট করানোর। বামপন্থীরা মানুষের ক্ষোভের পাশে দাঁড়িয়েছেন, যেখানে পেরেছে হাতে হাত মিলিয়ে প্রতিরোধ করেছেন।’’ জনতা যা পেরেছে, তা তাঁরা পারেননি কেন? প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর বক্তব্য, ‘‘সংগঠনের জোর সব জায়গায় সমান নয়। তাই সর্বত্র প্রতিরোধ করা যায়নি। তবে মুর্শিদাবাদের মানুষ ও দলীয় কর্মীদের কাছে বারবার বলেছি, ভোট দেওয়া গণতান্ত্রিক অধিকার। সন্ত্রাস করে তা রোখার চেষ্টা যে কোনও মূল্যে ঠেকাতে হবে। পরে নাকি কান্না গাইলে শোনার কেউ নেই!’’
তৃণমূলের শীর্ষ নেতাদের একাংশও সিঁদুরে মেঘ দেখছেন। তাঁদের কথায়, ‘‘বহিরাগত এনে ভোট করানোর এই মডেলের কোনও দরকার ছিল না। আমরা তো এমনিতেই কয়েক মাস আগের লোকসভা ও বিধানসভা উপ-নির্বাচনগুলো জিতেছি। পুরসভাতেও তার ব্যতিক্রম ঘটত বলে মনে করার কোনও কারণ নেই। তবু কলকাতা বা জেলার পুরভোটে যা হল, তা সাধারণ মানষের কাছে ভুল বার্তা পৌঁছে দিল। এই প্রতিরোধ কিন্তু আমাদের জন্য ভবিষ্যতের আশঙ্কা!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE