পুণ্যস্নানের পথে। বৃহস্পতিবার জয়দেব-কেঁদুলির মেলায় তোলা নিজস্ব চিত্র।
প্রতি বছরের মতো দক্ষিণ ২৪ পরগনা থেকে ঢোল নিয়ে এসেছেন সলমা বিবি। কিন্তু, মকর সংক্রান্তির আগের দিন বিকালেও মালপত্র খোলার সুযোগ পাননি। প্রশাসনের নির্দেশে এ বার রাস্তার ধারে কোথাও বসতে পারেননি।
হুগলি থেকে শাঁখা নিয়ে এসে একই অবস্থা তাপস সাহারও। শেষমেশ কোথায় বসতে পারবেন, তা বুঝতে না পেরে মাথায় হাত উঠেছে তাঁরা। একই ভাবে বেকায়দায় পড়ে রাস্তার ধারে চড়া দরে একটি স্থায়ী দোকান ভাড়া নিয়ে ব্যাগের পসরা সাজাতে বাধ্য হয়েছেন নৈহাটির গোপীনাথ সাহা।
অজয়ের ধারে জয়দেব-কেঁদুলির মেলায় দূর-দূরান্ত থেকে পসরা নিয়ে এসে এ ভাবেই মুশকিলে পড়েছেন সবাই। বৃহস্পতিবার প্রত্যেকেই বললেন, ‘‘প্রশাসনের এমন হঠাৎ সিদ্ধান্তে চরম বিপাকে পড়েছি। যে মেলার কেনাবেচার উপর সারা বছর তাকিয়ে থাকি, সেখানে বসার স্থান পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ায় আমরা ভীষণ হতাশ।’’ ঠিক কতটা লোকসানের মুখে পড়তে হবে, তার আশঙ্কাও করতে পারছেন না তাঁরা। এমন সিদ্ধান্তে মূলে অবশ্য মেলায় এ বার বিশেষ অতিথির আগমনকেই ‘দুষছেন’ মেলায় সামগ্রী নিয়ে আসা ব্যবসায়ীদের একাংশ।
ঘটনা হল, এত দিন জয়দেব ঢোকার আগে টিকরবেতা গ্রাম থেকে জয়দেবের রাধাবিনোদ মন্দির পর্যন্ত রাস্তার দু’ধারে কম পক্ষে হাজার খানেক স্টল বসত। এ বারই প্রথম মূল রাস্তার দু’পাশে একটিও দোকান বসতে দেয়নি প্রশাসন। যা স্টল বসেছে, তা সবই অজয়ের চরে। রাস্তায় যাতে কোনও দোকান বা স্টল না বসে, তা নিশ্চিত করতেই কয়েক হাত অন্তর খুঁটি পুঁতে বাঁশ দিয়ে ব্যারিকেড করে দেওয়া হয়েছিল। পরে অবশ্য বাঁশ খুলে দেওয়া হয়েছে। মেলার ঠিক শেষেই আসছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর আসার আগে প্রশাসন বেশি তৎপর হয়ে এমনটা করছে বলে এলাকাবাসীর মত। এতে বাইরে থেকে আসা ব্যবসায়ীরা তো বটেই, অসুবিধায় পড়েছেন এলাকার স্থায়ী দোকানি ও বেকার যুবকেরাও। যাঁরা প্রতি বছর ছোটখাট পসরা সাজিয়ে জয়দেব মেলায় আসা লক্ষ লক্ষ মানুষের অপেক্ষায় থাকেন। প্রত্যেকেরই চরম ক্ষতি হল বলে দাবি করছেন এলাকাবাসী। অনেকেরই ক্ষোভ, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী আসবেন, এলাকার উন্নতি হবে। কিন্তু, উনি মেলার কিছু আগে বা পরে আসলে বোধহয় এমন কড়াকড়ি হতো না। লোকেদের ক্ষতির মুখেও পড়ে হতো না।’’
অভিযোগ অবশ্য মানতে নারাজ মেলা কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য তথা বোলপুরের মহকুমাশাসক শম্পা হাজরা। তাঁর দাবি, ‘‘জয়দেব মেলায় অতিরিক্ত ভিড় সামলাতে, অগ্নিসংযোগ ও পদপৃষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থেকে বাঁচতে অজয়ের চরে মেলা সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত প্রশাসন বহু আগেই নিয়েছিল। এ বারই প্রথম তা কার্যকর করতে আমরা চেষ্টা করেছি।’’ এর সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর আগমনের কোনও সম্পর্ক নেই বলেই শম্পাদেবীর দাবি। সেই দাবি অবশ্য এলাকাবাসী মানতে নারাজ। তাঁদের প্রশ্ন, এত দিন কেন তা কার্যকর করেনি প্রশাসন? এ বারই বা কী ভাবে সক্ষম হল তারা? প্রশাসনের তরফে সদুত্তর মেলেনি। অন্য দিকে, এই সিদ্ধান্তের ফলে সমস্যায় পড়েছেন মেলায় আসা পুণ্যার্থীরাও। বিশেষ করে যাঁরা গাড়ি ভাড়া করে আসছেন, ঘোর সমস্যায় পড়েছেন তাঁরা। মুখ্যমন্ত্রীর জন্য মঞ্চ তৈরি হচ্ছে বলে রাধাবিনোদ মন্দিরের বহু আগে (প্রায় আড়াই কিলোমিটার) জয়দেব মেলায় আগত গাড়ি পার্কিংয়ের স্থানও বেশ খানিকটা পিছিয়ে দিয়েছে মেলা কমিটি। সেখান থেকেই কোনও রকমে কাঁধে মাথায় ব্যাগপত্র নিয়ে হেঁটে মেলায় পৌঁছতে হচ্ছে পুণ্যার্থীদের।
ব্যবাসায়ী বা একাংশের পুণ্যার্থীরা অখুশি হলেও মূল রাস্তা দিয়ে স্বাচ্ছন্দে হাঁটতে পেরে খুশি মেলায় আগত মানুষ জন। বাঁকুড়া থেকে জয়দেবে আসা সমীরণ পাল, মুর্শিদাবাদের জলঙ্গি থেকে আসা সর্বাণী বসু কিংবা পুরুলিয়ার মানবাজারের মুকুল মহান্তরা বলছেন, ‘‘এত দিন ধরে মেলায় আসছি, এ বারই যেন খোলামেলা লাগছে। ভালই তো।’’ মকরসংক্রান্তির আগের দিন আগত পুণ্যার্থীদের চোখে জয়দেব মেলার চেনা ছবি কিছুটা বদলে গেলেও মেলা সুষ্ঠু ভাবে পার করার জন্য তৎপর প্রশাসন। প্রশাসনের কর্তাদের দাবি, অজয়ের চরে পরিকাঠামোগত উন্নতি (রাস্তা, আলো ও পানীয় জলের ব্যবস্থা) করা হয়েছে। মেলায় আসা মানুষ জনের সুবিধা অসুবিধার উপরেই এ বার অন্যান্য বারের চেয়ে আরও জোর দেওয়া হয়েছে। অস্থায়ী শৌচাগার থেকে পুলিশের নজরদারি, সবই বাড়ানো হয়েছে।
যদিও একটা দুশ্চিন্তা থেকেই যাচ্ছে। মকর স্নান উপলক্ষে যে অজয়ে এত মানুষ আসেন, নদে এ বার জল খুব কম। সাধারণত খয়রাশোলের হিংলো জলাধার থেকে মকর স্নান করার জন্য দু’হাজার কিউসেক জল ছাড়া হয়ে থাকে। এ বার সেই হিংলো জলাধারে জল নেই। সামান্য জলে এত মানুষ কী ভাবে পুণ্যস্নান করবেন, তা নিয়ে চিন্তা থাকছেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy