ঋণ আদায় কমেছে। কিন্তু সরকারি নির্দেশে মেয়াদ বাড়াতে হচ্ছে ঋণের। এই পরিস্থিতিতে ধুঁকতে থাকা বিভিন্ন জেলা কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্ক, প্রাথমিক সমবায় কৃষি ঋণদান সমিতি, মহিলা পরিচালিত সমবায় ঋণদান সমিতির উপরে নেমেছে ‘খাঁড়ার ঘা’। সরকারি ত্রাণ পেলে ভাল হয়, এমন সমবায় প্রতিষ্ঠানকেও বলা হয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে চাঁদা দিতে। বিষয়টি তদারক করছেন সমবায়-কর্তারা। ফলে, আপত্তি থাকলেও রা কাড়ার জো নেই সমবায় প্রতিষ্ঠানগুলির।
বাম আমলে দীর্ঘদিন ত্রাণ ও সমবায় দফতর ছিল ফরওয়ার্ড ব্লকের হাতে। প্রাক্তন ত্রাণমন্ত্রী হাফিজ আলম সৈরানির মন্তব্য, ‘‘বাম আমলে অনেক সময় অন্য সংগঠনের মতো সমবায় কর্মচারীদের সংগঠনও ত্রাণ তহবিলে টাকা দিয়েছে। কিন্তু সমবায় ব্যাঙ্কের তহবিল থেকে সেই টাকা যায়নি। এখন
তো নিয়ম-কানুনেরই বালাই নেই!’’
গত বছর মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলের জন্য কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্ক ও ঋণদান সমিতিগুলির থেকে লিখিত নির্দেশ দিয়ে সমবায় দফতরের চাঁদা তোলাকে ঘিরে হইচই হয়। দফতর সূত্রের দাবি, এ বার মৌখিক নির্দেশের ভিত্তিতে চাঁদা তোলা হচ্ছে। ১৭ নভেম্বর
কলকাতার নজরুল মঞ্চে রাজ্য সমবায় সপ্তাহের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হবে। ওই দিন সংগৃহীত টাকা তুলে দেওয়া হবে মু্খ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে। গত বছর ১ কোটি ৫৬ লক্ষ টাকার লক্ষ্যমাত্রা ধার্য হয়েছিল। এ বার নির্দিষ্ট কোনও অঙ্ক আগাম ধার্য করা হয়নি। তবে কর্তারা জেলা সমবায় ব্যাঙ্ক এবং ঋণদান সমিতিগুলিকে জানিয়ে দিয়েছেন, চাঁদা যেন এক কোটি টাকার কম না হয়।
পরিস্থিতি যে স্বস্তির নয়, মেনেছেন রাজ্যের সমবায়মন্ত্রী জ্যোতির্ময় করও। তাঁর কথায়, ‘‘এ বছর অতিবৃষ্টির জন্য কত চাঁদা উঠবে, তা নিয়ে চিন্তায় আছি।’’
খোদ মন্ত্রীই যেখানে চিন্তায়, সেখানে আরও করুণ দশা জেলার সমবায় প্রতিষ্ঠানগুলির। মুখ্যমন্ত্রীর দেওয়া নির্দেশের জন্য ২০১২ থেকে ব্যাঙ্ক বা সমবায় সমিতিগুলি ঋণখেলাপির সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার নোটিস দিতে পারছে না। ফলে, সে সব সম্পত্তি বেচে আয় করার পথ এক রকম বন্ধ। এ বছর অতিবৃষ্টিতে চাষের ক্ষতি হওয়ায় রাজ্য সরকারের নির্দেশে চাষিদের দেওয়া স্বল্পমেয়াদী ঋণকে দীর্ঘমেয়াদী ঋণে বদলানো হচ্ছে। ফলে, ঋণের টাকা অনাদায়ী থাকার মেয়াদ আরও বাড়বে।
হাওড়া জেলা কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কের এক আধিকারিকের অভিজ্ঞতা, ২০০৭-এ বন্যার জন্য কৃষি-ঋণ পুনর্গঠন করা হয়েছিল। পুরোন ঋণের উপরে ফের চাষিদের নতুন ঋণ দেওয়া হয়। নতুন ঋণ আদায় হলেও পুনর্গঠন করা পুরনো ঋণের টাকার অনেকাংশ এখনও আদায় হয়নি। তার পরিমাণ অন্তত ৭০ কোটি টাকা। এ বারেও ঋণ পুনর্গঠনের পরে অনেক টাকা অনাদায়ী থাকবে বলে আশঙ্কা ওই আধিকারিকের।
এই অবস্থায় ত্রাণ তহবিলে চাঁদা দেওয়ার নির্দেশ আসায় বেশ ফাঁপরে পড়েছে জেলা কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কগুলি। সমবায় দফতর সূত্রের দাবি, চলতি মাসের গোড়ায় সমবায়মন্ত্রী নিজেই পদস্থ আধিকারিকদের চাঁদা তোলায় উদ্যোগী হতে মৌখিক নির্দেশ দেন। আধিকারিকদের এক-একটি জেলার দায়িত্ব দেওয়া হয়। মন্ত্রী বলছেন, ‘‘লাভজনক সমবায় ব্যাঙ্ক বা ঋণদান সমিতিগুলি প্রতি বছরই চাঁদা দেয়। সেটা নতুন কিছু নয়। এ জন্য লিখিত নির্দেশ দিতে হবে কেন?’’
হাওড়া জেলা সমবায় ব্যাঙ্কের এক কর্তা জানান, গতবার ত্রাণ তহবিলে তাঁরা ২ লক্ষ টাকা চাঁদা দিয়েছিলেন। এ বারেও তা-ই দিতে হবে বলেই ‘উপর’ থেকে নির্দেশ রয়েছে। পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুক-ঘাটাল কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্ক গতবারে চাঁদা দিয়েছিল ৫০ হাজার টাকা। ওই ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যেই ১ লক্ষ টাকা চাঁদা দিয়েছে। কিন্তু ওই ব্যাঙ্কের অধীনে থাকা প্রায় সাড়ে তিনশো ঋণদান সমিতির একটা বড় অংশ বন্যা এবং অতিবৃষ্টিতে চাষের ক্ষতির প্রেক্ষিতে চাঁদা দেওয়া নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। তখন তাদের বলা হয়েছে, ‘যা পারো দাও, তবে চাঁদা দিতে হবে’।
বছর দেড়েক ধরে বন্ধ থাকার পরে সদ্য অক্টোবর মাসে খুলেছে বীরভূম জেলা কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্ক। লেনদেন এখনও স্বাভাবিক হয়নি। মেলেনি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের লাইসেন্স। ব্যাঙ্কের উপরে নির্ভরশীল সমবায় সমিতিগুলির আর্থিক দৈন্য পৌঁছেছে চূড়ান্ত পর্যায়ে। কারণ, তারা ব্যাঙ্কে গচ্ছিত আমানত তুলতে পারছে না। এই পরিস্থিতিতেও ব্যাঙ্কের উচ্চ পর্যায়ের কমিটির সদস্য তথা জেলা সভাধিপতি বিকাশ রায় চৌধুরীর দাবি, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে চাঁদা দেওয়ার টাকার অভাব হবে না। ব্যাঙ্ক টাকা না দিলেও জেলায় তিনশোর বেশি কৃষি সমবায় রয়েছে, মার্কেটিং সোসাইটি, মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ রয়েছে। সেখান থেকে ত্রাণ তহবিলে দেওয়ার টাকা উঠে যাবে।’’ যদিও সমবায় দফতর সূত্রের খবর, জেলা কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্ক খোলার আশায় যে সব কৃষি সমবায়
গত বার টাকা দিয়েছিল, তারা অনেকেই
এ বার চাঁদা দেওয়ার জায়গায় নেই।
দলের তরফে সমবায় ফ্রন্টের ভারপ্রাপ্ত, সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অমিয় পাত্র মনে করিয়ে দিচ্ছেন, আইন অনুযায়ী সমবায়গুলি স্বশাসিত। কৃষক বা সমাজের যে অংশের মানুষের সহায়তার জন্য সমবায়গুলির কাজ করার কথা, সেই ভূমিকা নির্দিষ্ট করে দেওয়া আছে আইনে। সেখানে মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে অনুদান বা চাঁদা দেওয়ার কোনও সংস্থান নেই। তাঁর সমালোচনা, ‘‘বামফ্রন্ট বা তার আগের জমানাতে এমন কাণ্ড হয়ওনি। কিন্তু এই সরকার রীতি-নীতি, আইন-কানুন মানে না!’’
সহ প্রতিবেদন: দয়াল সেনগুপ্ত
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy