Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

পাহাড়ে শ্যুটার

হতে চেয়েছিলেন শ্যুটার। সাফল্যও পেয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎই হয়ে গেলেন পর্বত অভিযাত্রী। একাধিক শৃঙ্গ জয়ের অভিজ্ঞতা তাঁর ঝুলিতে। সুজাতা ভট্টাচার্যের অভিযানের কাহিনি শুনলেন সৌমেশ্বর মণ্ডলহতে চেয়েছিলেন শ্যুটার। সাফল্যও পেয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎই হয়ে গেলেন পর্বত অভিযাত্রী। একাধিক শৃঙ্গ জয়ের অভিজ্ঞতা তাঁর ঝুলিতে। সুজাতা ভট্টাচার্যের অভিযানের কাহিনি শুনলেন সৌমেশ্বর মণ্ডল

শিখরে: তেনচেন কাং শৃঙ্গ জয়ের পরে সুজাতা। নিজস্ব চিত্র

শিখরে: তেনচেন কাং শৃঙ্গ জয়ের পরে সুজাতা। নিজস্ব চিত্র

শেষ আপডেট: ২১ মে ২০১৮ ০০:০৭
Share: Save:

প্রশ্ন: চর্চা শুরু করেছিলেন অ্যাথলেটিক্স। কিন্তু পরে পর্বত অভিযাত্রী। আচমকাই?

উত্তর: ২০০৩ সালের ডিসেম্বরে হেস্টিংস কলেজে ‘শিখর মাউন্টেনিয়ারিং ক্লাব’এর আয়োজনে এক কর্মশালা দেখতে গিয়েছিলাম। তখন পর্বতারোহণের বিষয়টি জানতে পারি। অভিযানের ইচ্ছেটা জাগে। পরের বছর শুশুনিয়া পাহাড়ে চারদিনের ‘বেসিক রক ক্লাইম্বিং কোর্স’ প্রশিক্ষণ নিই। সেরা শিক্ষানবিশের পুরস্কার পাই।

প্রশ্ন: তার আগের জীবন?

উত্তর: আমি খড়গপুর ২ ব্লকের লছমাপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের বালিহাটি গ্রামের মেয়ে। এলাকায় ভাল স্কুল না থাকায় রাজবালা বালিহাটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণির পর মেদিনীপুর শহরের পাহাড়িপুর স্কুল থেকে মাধ্যমিক, বিদ্যাসাগর বিদ্যাপীঠ বালিকা বিদ্যালয় থেকে উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হয়ে মেদিনীপুর কলেজে থেকে বিএ পাশ।

প্রশ্ন: খেলাধুলোর শুরু কবে?

উত্তর: গ্রামের বাড়িতে থাকার কারণে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত কোনও প্রতিযোগিতায় যোগ দেওয়া হয়নি। বিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্রীড়ায় ভাল ফল করার পর প্রধানশিক্ষিকা মীরা ঘোষ আমাকে অ্যাথলেটিক্সে যাওয়ার পরামর্শ দেন। মেদিনীপুর অ্যাথলেটিক কোচিং সেন্টারে ভর্তি হই। শর্টপাট, ডিসকাস ও জ্যাভেলিন থ্রো’য়ে স্বপন পতির কাছে প্রশিক্ষণ নিই। জেলা ও রাজ্যস্তরে ভাল ফল হয়। পরে শ্যুটিং প্রশিক্ষণের জন্য মেদিনীপুর রাইফেল ক্লাবে ভর্তি হই। সেনাবাহিনীর রাইফেল শ্যুটার ক্যাপ্টেন ভগীরথ সামইয়ের অধীনে ২৫ মিটার স্পোর্ট পিস্তল ও ১০ মিটার এয়ার পিস্তল ইভেন্টে প্রশিক্ষণ নিই। রাজ্য ও পূর্বাঞ্চলীয় পিস্তল শ্যুটিংয়ে সফল হয়েছি। ১৯৯৮ সালে কলকাতায় ৩২তম রাজ্য পিস্তল শ্যুটিংয়ে চ্যাম্পিয়ান হয়েছিলাম।

প্রশ্ন: পর্বত আরোহণে কবে থেকে?

উত্তর: ২০০৬ সালে চারদিনের ‘অ্যাডভান্স রক ক্লাইম্বিং’ প্রশিক্ষণ নিই পুরুলিয়ার মাঠা পাহাড়ে। এই বছরই জুলাইয়ে ক্লাবের আয়োজনে কাশ্মীরে ‘মাউন্ট নুন’ (৭১৩৫ মিটার) অভিযান হয়। জীবনের প্রথম পর্বত অভিযানে যাওয়ার সুযোগ। তবে প্রশিক্ষণ না থাকায় ‘অ্যাডভান্স বেসিক ক্যাম্প’ পর্যন্ত গিয়েছিলাম। ২০০৮ সালে দার্জিলিংয়ের হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট থেকে ২৮ দিনের ‘বেসিক মাউন্টেনিয়ারিং’য়ের প্রশিক্ষণ নিই। ২০০৯ সালের মে মাসে উত্তর কাশির নেহরু ইন্সটিটিউট অফ মাউন্টেনিয়ারিং থেকে ২৮ দিনের ‘অ্যাডভান্স মাউন্টেনিয়ারিং’ প্রশিক্ষণ নিই। জুলাই মাসে হিমাচল হিমালয়ে ৬১৪২ মিটার উচু ‘মাউন্ট শিবা’ পর্বত অভিযানে যাই। অভিযানের সময় অ্যাডভান্স বেসিক ক্যাম্পে শেরপা রাজু ভাইয়ের ফুসফুসে সমস্যা দেখা দেয়। ফলে শেরপাকে নিয়ে ফিরে আসি।

প্রশ্ন: থেমে যেতে পারত তো অভিযানের ইচ্ছে?

উত্তর: থামেনি তো। ২০১২ সালে ছন্দা গায়েনের নেতৃত্বে ১০ জন মেয়ের দল গঢ়বাল হিমালয়ে ‘মাউন্ট মনিরাং (৬৫৯৩ মিটার) অভিযানে যাই। এই অভিযানে প্রথম পর্বত শিখরে আরোহণ করতে পারি। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে মহুয়া বিশ্বাসের নেতৃত্বে ৬০১০ মিটারের পশ্চিম সিকিম হিমালয়ের ‘মাউন্ট তেনচেন কাং’ আরোহণ করি। ২০১৭ সালেও মহুয়া বিশ্বাসের নেতৃত্বে গঢ়বাল হিমালয়ের ৬৫৩৫ মিটার উঁচু একটি অনামী পর্বত শিখরে পৌঁছে জাতীয় পতাকা ওড়াই। ওই পর্বতে তখনও কেউ ওঠেনি।

প্রশ্ন: অভিযানের গল্প বলুন?

উত্তর: তেনচেন কাং অভিযানের সময় সামিট ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে শিখরের দিকে এগোনোর সময় আমার শরীর খুবই খারাপ হয়ে যায়। এক শেরপা বলেন, দিদি, আর ঝুঁকি নেবেন না। বাপস চলুন। তখন আমারও মনে হচ্ছিল আর পারব না। এই সময় এগিয়ে এসেছিলেন শেরপা আন। বলেছিলেন, দিদি পারবেন। দিদির মানসিক জোর আছে। আন শেরপা আমার পায়ের পেশিগুলি ম্যাসাজ করে দেন। আমাকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেন। আন শেরপা না থাকলে আমার অভিযান শেষ হত না।

প্রশ্ন: তারপর?

উত্তর: নামার সময় আবার বিপত্তি। আমার ফিক্সড রোপের ‘ডিসেন্ডার’ খুলে পড়ে গিয়েছিল। এক শেরপার ‘ডিসেন্ডার’ দড়িতে লাগিয়ে নীচে নেমে ছিলাম। এই অভিযানেই নদিয়ার নূপুর মণ্ডলের শরীর একদম ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। বেস ক্যাম্প থেকে মালবাহকেরা কাঁধে করে তাঁকে নামিয়ে আনেন।

প্রশ্ন: অভিযান মানেই তো নানা বিপত্তি। এরকম অভিজ্ঞতা নিশ্চয় আরও আছে?

উত্তর: গঢ়বালের পর্বত অভিযানে খুবই কষ্ট হয়েছিল। আবহাওয়া সঙ্গ দেয়নি। গঙ্গোত্রী থেকে ধস শুরু হয়। গোমুখের দিকে যত এগিয়েছি ততই রাস্তা ভয়ঙ্কর হয়েছে। ৮০ ডিগ্রি খাড়াই রাস্তা। কোথাও খাড়াই খাদের পাশে ৪-৫ ফুট চওড়া রাস্তা দিয়ে পার হতে হয়েছে। এই অভিযানেই হাওড়ার স্বরূপা মণ্ডলের পা মচকে গিয়েছিল। মালবাহকেরা তাকে কাঁধে করে নিচে নামায়। তবে অভিযানে কষ্টের সঙ্গে আনন্দও ছিল। কলকাতার বন্দনা হালদার ক্যাম্পে রান্না করে খায়িয়েছিল। উত্তর ২৪ পরগনার উন্নতি পাণ্ডে এক বছরের বাচ্চাকে বাড়িতে রেখে অভিযানে গিয়েছিল। মোবাইলে বাচ্চার ছবি দেখেছিলাম। তারপর থেকেই বাচ্চা কোলে নিয়ে নাচানোর ভঙ্গি করে ‘নাচু নাচু’ গান করে উন্নতির সঙ্গে খুনসুটি করতাম আমরা।

প্রশ্ন: দুর্গম পথ। দলের কয়েকজনের মুখ দেখতে হয় প্রতিদিন। একঘেয়ে?

উত্তর: শেরপারা খুব সাহায্য করেন। সারাদিন অভিযানের পর ক্লান্ত হয়ে পড়ি। শেরপারা তখন নেপালি গান শোনান। দড়ি দিয়ে গিঁট বাঁধা খেলা হয়। গিঁট বেঁধে খুলতে দিলে কোনওভাবেই খোলা যায় না। মনের জোর বাড়ানোর জন্য শেরপারা কোনও দুর্ঘটনার কথা বলেন। দুর্ঘটনায় পড়লে কী ভাবে উদ্ধার করা হয় সেই সব গল্প শোনান। এতে আমাদের মানসিক জোর বাড়ে। অনেকে আবার ভয় পেয়ে যান।

প্রশ্ন: আপনারা কী করেন তখন?

উত্তর: সময় কাটানোর জন্য আমরা মাঝে মধ্যেই শেরপাদের বাংলা ভাষা শেখাতাম। ওঁরা আমাদের সঙ্গে বাংলায় কথা বলার চেষ্টা করতেন। শেরপা ফুরাবা রান্না হলেই বলতেন, ‘সবাই চলে এসে। খাবে না তো খাবে না। না খাবে তো না খাবে’। আমরা এখনও অভিযানে গেলে ক্যাম্পে খাওয়ার সময় বন্ধুদের সঙ্গে একথা বলি।

প্রশ্ন: পর্বত অভিযান ছাড়া আর কোনও অভিযান করেছেন?

উত্তর: অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস করেছি। গোয়ায় চারদিনের কোস্টাল ট্রেক করেছি। পরপর অনেকগুলো সি বিচ পার হয়েছি। রাজস্থানের থর মরুভূমিতে সাত দিনের ‘ডেসার্ট ট্রেক’ করেছি।

প্রশ্ন: এখন তো ঝাড়গ্রামের শ্রীরামকৃষ্ণ সারদাপীঠ বিদ্যালয়ে ক্রীড়া শিক্ষিকার। জীবনের লক্ষ্য?

উত্তর: এভারেস্ট জয় করার থেকে ছেলে মেয়েদের পর্বত অভিযানের সঙ্গে যুক্ত করাই আমার লক্ষ্য। তবে সমাজে মেয়েদের জন্য কিছু করতে চাই। ঝাড়গ্রামে মমতা হাঁসদা ও সোমবারি কিস্কু-সহ ২৬ জন রক ক্লাইম্বিং কোর্স করেছে। সেরা শিক্ষানবিশের পুরস্কার পেয়েছে। ভবিষ্যতে পর্বত অভিযানেও যাবে। ছেলে মেয়েদের স্কাউট অ্যান্ড গাইডের ক্যাম্প করি। প্রতি শনি রবিবার আমার গ্রামের ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের খেলাধুলো করাই। সাংস্কৃতিক চর্চাও চলে। মানুষকে মরণোত্তর চক্ষুদান করার বার্তা দিই।

প্রশ্ন: এখনও পর্বতে যেতে ইচ্ছে করে?

উত্তর: এখনও নিয়মিত পর্বত অভিযানে যেতে ইচ্ছে করে। তবে টানা এতদিন ছুটি পাওয়া যায় না। তাই কম দিনে ছোট পর্বতে যাচ্ছি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Sujata Bhattacharya Mt Tinchenkang Interview
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE