গুলির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে মুহুর্মুহু। পাড়ার একজন বাসিন্দাও ঘরে নেই। সকলে জমা হয়েছেন আশপাশের বাড়ির ছাদে। অভিজ্ঞ কান শুনলেই বুঝতে পারবেন, আওয়াজটা লাইট মেশিনগানের গুলি ছোড়ার।
তখন সত্তরের দশক। বেলদায় চলেছিল এমন গুলিগোলা। অবশ্য পুরোটাই নকল যুদ্ধ। এনসিসি ক্যাডেটদের যুদ্ধের মহড়া দেখানো হয়েছিল বেলদায়। আয়োজন করেছিল এনসিসি-র ৬০ বেঙ্গল ব্যাটেলিয়ন। বেলদায় কেন এমন যুদ্ধের মহড়ার ব্যবস্থা করা হল? সেই উত্তর জানতে গেলে মেদিনীপুরে জাতীয় সমর শিক্ষার্থী বাহিনীর (এনসিসি) এক সমৃদ্ধ ইতিহাসের কথা জানতে হবে। সেই ইতিহাসের আগে এনসিসি-র ইতিহাসটা একটু জেনে নেওয়া যাক।
এনসিসি-র আদিরূপ ইউটিসি। পুরো নাম ইউনিভার্সিটি অফিসার্স ট্রেনিং কর্পস। ১৯২৫ সালে। ব্রিটিশ শাসকদের উদ্দেশ্য খুব একটা সহজ-সরল ছিল না। ভারতীয় পড়ুয়াদের সমর শিক্ষা দিয়ে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার নিয়মিত সরবরাহ ব্যবস্থা তৈরি রাখা। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় শাসকেরা হঠাৎ বুঝতে পারেন ইউটিসি কাজে লাগেনি। উদ্দেশ্য ব্যর্থ। তাই ভারত সরকার ১৯৪৬ সালে দেশের সমস্ত বিদ্যালয়, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় নতুন সমর শিক্ষার্থী বাহিনী তৈরি করতে একটি কমিটি তৈরি করে। ওই বছরেরই ২০ অক্টোবর পণ্ডিত হৃদয়নাথ কুঞ্জুরুর সভাপতিত্বে একটি বিল জমা দেওয়া হয়। ১৯৪৮ সালে সংসদে বিলটি পাশ হয়। জন্ম নেয় ন্যাশনাল ক্যাডেট কর্পস, সংক্ষেপে এনসিসি। প্রথমে শুধুমাত্র ছেলেরাই সমর শিক্ষা নিতে পারত। পরে তৈরি হয় বালিকা বিভাগ। ১৯৫২ সালে বায়ু এবং নৌ শাখাও তৈরি হয়। স্বাধীন ভারতের এনসিসি-র লক্ষ্য অবশ্যই আলাদা হয়ে যায়। চরিত্র, সাহস, নেতৃত্বদান, শৃঙ্খলা-সহ একাধিক বিষয়ে পড়ুয়াদের উন্নতিই এনসিসি-র শিক্ষার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। বাহিনীর মোটো, ‘একতা অউর অনুশাসন’।
স্কুলে এনসিসি-র ইউনিট হল জুনিয়র ডিভিশন এনসিসি। আর কলেজে থাকে সিনিয়র ডিভিশন এনসিসি। ১৯৬২ সালে তৈরি হয়েছিল এনসিসি রাইফেলস। সেই সময়ে কেন্দ্রীয় সরকার একটি নির্দেশিকা জারি করে। তাতে জানানো হয়, ক্যাডেটদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষকের অভাব দেখা দিয়েছে। তাই এনসিসি ‘সি’ শংসাপত্র পেয়েছেন এমন শিক্ষক, সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে থেকে প্রশিক্ষক নিয়োগ করা হবে। ১৯৬৩ সালে এনসিসি-তে যোগ দেওয়ার সুযোগ এল আমার। মেদিনীপুর ৪৬ নম্বর ব্যাটেলিয়নে যোগ দিই। এই ব্যাটেলিয়নের অধীনে ছ’টি কলেজ ছিল। মেদিনীপুর কলেজ, কে ডি কলেজ অফ কমার্স, রাজা নরেন্দ্রলাল খান কলেজ (মহিলা কলেজ), ঘাটাল কলেজ, পাঁশকুড়া বনমালী এবং তমলুক কলেজ ছিল আমার প্রশিক্ষণের আওতায়। এর সঙ্গে ছিল ১২-১৪টা স্কুল। সঠিক সংখ্যা এখন আর মনে নেই। সেই সময়ে কাঁথিতে ছিল ৬০ নম্বর বেঙ্গল ব্যাটেলিয়ন। তার অধীনেও অনেকগুলো স্কুল, কলেজ ছিল।
জাতীয় শিক্ষক শিবকালী মিশ্রের উদ্যোগে ১৯৭১ সালে বেলদা গঙ্গাধর অ্যাকাডেমিতে এনসিসি ইউনিট তৈরি হয়। তার দায়িত্ব পেয়েছিলাম। এই ইউনিটটি সেই সময়ে থেকেই পারদর্শিতায় দেখিয়েছিল। স্কুলের ট্রুপ প্রথমবারই দারুণ ফল করে। প্রথমবার ‘এ’ সার্টিফিকেট পরীক্ষার্থী ছিল ১৫ জন। তাদের মধ্যে আটজন ‘এ’ গ্রেড পেয়েছিল। বাকিরা ‘বি’ গ্রেড। পরীক্ষার ফলে বিস্মিত হয়েছিলেন তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ, সিকিম এবং আন্দামানস এর ডিরেক্টর ব্রিগেডিয়ার সি এস মেটা। তিনি বেলদার ট্রুপ পরিদর্শনে এসেছিলেন। কোনও ব্রিগেডিয়ার একটা জুনিয়র ডিভিশন গ্রুপ পরিদর্শনে এসেছেন, এনসিসি-র ইতিহাসে বোধহয় সেটাই প্রথম ঘটনা। মেদিনীপুরের এনসিসি-র স্বর্ণযুগের ওই দশকেই গঙ্গাধর অ্যাকাডেমিতে সেকশন ইন অ্যাটাক বা যুদ্ধের মহড়া অনুষ্ঠিত হয়।
সেই সময় ১৫ দিন স্কুল ব্যাটেলিয়নের নিয়ন্ত্রণে চলে গিয়েছিল। সেনা অফিসারেরা স্কুলে ঘাঁটি গেড়ে মহড়ার জন্য প্রস্তুতি সেরেছিলেন। স্কুলের কাছে একটি মহড়া ক্ষেত্র, কিছুটা দূরে এক পুকুর পাড়ে আরেকটি মহড়া ক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল। মাটি খুঁড়ে ঢালাই দিয়ে তৈরি করা হল পিট। সেগুলো ভর্তি করে দেওয়া হল বালি দিয়ে। তার আগে কয়েকদিন ধরে মাইকে প্রচার করা হয়েছিল, মহড়ার দিনে কেউ যেন মাটিতে না থাকেন। কারণ মহড়ায় ব্যবহার করা হবে লাইট মেশিনগান। তা থেকে ব্ল্যাঙ্ক ফায়ার করা হবে। সত্যি সত্যি গুলি না চললেও আওয়াজ হবে সত্যিকারের গুলি চালানোর মতোই। তাতে লোকজন ভয়ে হুড়োহুড়ি করতে পারেন। মহড়ার দিনে আশপাশের বাড়ির ছাদ ভরে গিয়েছিল লোকে। শুধু নকল যুদ্ধ নয়, যুদ্ধের পরে আহতদের সেবা, নিহতদের সরিয়ে নিয়ে যাওয়া, দখল করা জায়গা কেমন করে সাজাতে হয়, সেদিনই সব দেখানো হয়েছিল।
এই মহড়ায় সাফল্যের পরে বেলদা গঙ্গাধর অ্যাডেমিতে অসামরিক প্রতিরক্ষা বিভাগও মহড়ার আয়োজন করে। বাড়িতে আগুন লাগলে তিন তলা ছাদ থেকে, ভূমিকম্পের সময়ে ধস থেকে বাসিন্দাদের কী ভাবে উদ্ধার করা হবে, সে সব দেখানো হয়েছিল। কিন্তু গঙ্গাধর অ্যাকাডেমির চূড়ান্ত সাফল্য তখনও বাকি ছিল। এই স্কুল থেকে দিল্লির প্রজাতন্ত্র দিবসে যোগ দিয়েছিল এক ক্যাডেট। বাদল জানা। আর আমি নির্বাচিত হয়েছিলাম কন্টিনজেন্ট কম্যান্ডার (সিও) হিসেবে। একজন জুনিয়র এনসিসি অফিসার তার আগে কখনও সিও হননি। ১৯৮২ সালে দিল্লির প্রজাতন্ত্র দিবসের প্যারেডে যোগ দিই। আমার অধীনে ১২১ জন ক্যাডেট ছিল। তার আগে পালাম বিমানবন্দরের কাছে গ্যারিসন গ্রাউন্ডে ২১ দিনের শিবির হয়েছিল। অন্য শিবির ১০-১২ দিনের হলেও প্রজাতন্ত্র দিবসের প্যারেডের শিবির হয় দ্বিগুণ সময় ধরে। দিল্লিতে জানুয়ারি মাসের ঠান্ডা। আমি তো ২১ দিনের মধ্যে মাত্র দু’দিন চান করেছিলাম। প্রজাতন্ত্র দিবসে রাষ্ট্রপতি নিলম সঞ্জীব রেড্ডি আমাদের অভিবাদন গ্রহণ করলেন। প্রজাতন্ত্র দিবসে আমার একটি ছোট্ট আবিষ্কার প্রদর্শিত হয়। রণপা সাধারণত হাতে ধরে নিয়ে চলতে হয়। সেটি একটু বদলে আমি হাতে না ধরে শুধু পায়ে রণপা পরে চলার ব্যবস্থা করতে পেরেছিলাম। ২০ জন ক্যাডেট রণ পা পরে যোগ দিয়েছিল।
সারা জীবনের এই অভিজ্ঞতার সঙ্গে যোগ হল রাষ্ট্রপতি ভবনে নৈশভোজের আমন্ত্রণ। রুপোর পাত্রে খাওয়াদাওয়া। তবে রাষ্ট্রপতি আমাদের সঙ্গে আহার করেননি। ২৮ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধী আমাদের প্রাতরাশে আমন্ত্রণ জানালেন। সেদিন দেখেছিলাম, প্রধানমন্ত্রীর অন্য রূপ। তিনি নিজেই ক্যাডেটদের প্লেটে খাবার দিচ্ছিলেন। শেখাচ্ছিলেন কেমন করে ছুরি, কাটা চামচ ধরতে হয়। খুব সহজ ছিল তাঁর ব্যবহার। আমাদের খুব ভাল লেগেছিল।
লেখক এনসিসি-র অবসরপ্রাপ্ত মেজর
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy