Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

কোচবিহার থেকে আমেরিকায়, স্বপ্নের উড়ান রূপান্তরকামী নারী সুমির

সুমি জানান, সমাজের সামনে প্রকাশ্যে লড়াই ছাড়া অন্য কোনও রাস্তা ছিল না। তাঁরা একটি সংগঠনও গড়ে তোলেন। প্রকাশ করতে শুরু করেন একটি পত্রিকাও। সেই পত্রিকায় রূপান্তরকামীদের কথা তুলে ধরা শুরু হয়।

দৃষ্টান্ত: সুমি দান। নিজস্ব চিত্র

দৃষ্টান্ত: সুমি দান। নিজস্ব চিত্র

নমিতেশ ঘোষ
কোচবিহার শেষ আপডেট: ২৭ মে ২০১৮ ০৪:০২
Share: Save:

স্বপ্নের উড়ান! নাকি স্বপ্নেও কোনওদিন ভাবেননি সুমি! কোথায় কোচবিহারের প্রত্যন্ত মফস্‌সল, আর কোথায় আমেরিকার পোর্টল্যান্ড!

ছোট্ট থেকে অপমান আর বঞ্চনাই তাঁকে জুগিয়েছে হার-না-মানা লড়াইয়ের জেদ। সেই জেদের জোরেই আজ বিশ্বমঞ্চে রূপান্তরকামী নারী সুমি দাস। পোর্টল্যান্ড থেকে জানালেন, একদিন কেউ তাঁকে মানুষ বলেই গণ্য করত না। আড়ালে সেই কষ্ট বুকে চেপে রাখতেন তিনি। আর আজ তাঁর কথা বিশ্বের মানুষ শুনছে। হোয়াটসঅ্যাপ কলে কথা বলতে বলতে গলা ভার হয়ে আসে তাঁর। বললেন, “সেই ১৪ বছর বয়সে শপথ নিয়ে বাড়ি ছেড়েছিলাম। পথই হয়েছিল আমার ঠিকানা। হার মানিনি। শুধু নিজের জন্য নয়, আমাদের জন্য এই লড়াইয়ে আজ আমেরিকায় আসতে পেরে আমি খুশি।” রূপান্তরকামী এবং বৃহন্নলারা ভারতের বড় শহরগুলির বাইরেও কী ভাবে সঙ্ঘবদ্ধ হচ্ছেন তা নিয়ে এদিনই পোর্টল্যান্ডে একটি এক আলোচনাসভায় বললেন তিনি।

দিনহাটার বলরামপুর রোডে বাড়ি সুমিদের। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। বাবা ব্যবসায়ী। ছোট থেকেই সুমির ‘অন্যরকম’ আচরণ নিয়ে বিরক্ত হত তাঁর পরিবার। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময়েই মা মারা যান। এর পর থেকেই প্রতি পদে প্রতিবেশী-স্বজনদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য যেন সঙ্গী হয়ে ওঠে তাঁর। ওই বয়সেই মনটা প্রতিবাদী হয়ে ওঠে তাঁর। ১৪ বছর বয়সে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন। তাঁর কথায়, “বাড়ি এবং স্কুল থেকে প্রতিবেশী সবাই যেন অন্য চোখে দেখতে শুরু করল। এমন আচরণ করছিল সবাই, মনে হচ্ছিল যেন আমি মানুষ নই।” সেই থেকে আর বাড়ি ফেরেননি তিনি। নানা জায়গায় ঘুরে শেষে জেলা শহরের কাছে ঘুঘুমারিতে ভাড়াবাড়িতে থাকতে শুরু করেন। সেখানেই রূপান্তরকামী ও বৃহন্নলাদের নিয়ে চলতে থাকে তাঁর কাজ। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা গড়ে তোলেন। তাঁর সঙ্গে আরও অনেকেই যোগ দেন সেখানে। স্বনির্ভর গোষ্ঠী গড়ে তুলে আয়ের পথ দেখতে শুরু করেন তাঁরা। সেই সঙ্গে চলতে থাকে সামাজিক আন্দোলন।

সুমি জানান, সমাজের সামনে প্রকাশ্যে লড়াই ছাড়া অন্য কোনও রাস্তা ছিল না। তাঁরা একটি সংগঠনও গড়ে তোলেন। প্রকাশ করতে শুরু করেন একটি পত্রিকাও। সেই পত্রিকায় রূপান্তরকামীদের কথা তুলে ধরা শুরু হয়। সেই সঙ্গে সমাজের মূল স্রোতে রূপান্তরকামীদের ফিরিয়ে আনতে নাট্য-কর্মশালা সহ নানা সাংস্কৃতিক কাজও শুরু করেন। ক্রমশ সুমি কোচবিহার তো বটেই, পরিচিত হয়ে ওঠেন গোটা রাজ্যে। দিনকয়েক আগেই কোচবিহারে লোক আদালতের বিচারকের সম্মান দেওয়া হয় তাঁকে। এরপর একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের ডাকে আমেরিকা পাড়ি। পোর্টল্যান্ড, সিয়াটল, নিউ ইয়র্ক, ওয়াশিংটনে নানা অনুষ্ঠান করে রূপান্তরকামী-তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের সঙ্গে সাক্ষাৎ-আলোচনা করেই বাড়ি ফেরার ইচ্ছে তাঁর।

কোচবিহারের সাংসদ পার্থপ্রতিম রায় বলেন, “সুমি দাসের লড়াইয়ের কথা আমরা সবাই জানি। এটা সবার কাছে শিক্ষণীয়।” চিত্রশিল্পী শ্রীহরি দত্ত বলেন, “আমি ব্যক্তিগত ভাবে চিনি সুমিকে। সমাজের উপহাসের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তিনি লড়াই করছেন। তাঁর পাশে আমরা আছি।”

সুমি বলেন, “স্বপ্নের এই উড়ান এখনও শেষ হয়নি। আগে লোকে সামনেই টিটকিরি দিত। এখনও অনেকে পিছনে দেয়। সেই লড়াইটাও জিততে হবে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Transgender Sumi Das
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE