মহম্মদ মনিরুল শেখ
প্রধানমন্ত্রী কে? ঠিক উত্তর মিলল না। পাশ থেকে ফুট কাটল কেউ, ‘‘নওয়াজ শরিফ কে জানিস!’’ জাতীয় সঙ্গীত কী? উত্তর এল, ‘‘জানি না ঠিক।’’ সঙ্গে সঙ্গে সপাটে এক চড়।
হাওড়া থেকে মালদহগামী ট্রেনে বাংলায় কথোপকথন চলছে। গোটাটা ভিডিয়ো করে রাখছে কেউ। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর নাম আর জাতীয় সঙ্গীত বলতে না পারলে এ দেশে থাকার অধিকার নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। ‘লেখাপড়া বেশি দূর করিনি’ বলে রেহাই মিলল না। ‘পশ্চিমবঙ্গের সিএম কে’? উত্তরদাতা মলিন মুখে থতমত হয়ে ভাবলেন, কোথায় থাকেন জানতে চাওয়া হচ্ছে। উত্তর এল, মালদহের কালিয়াচক। তার পর ভুল শুধরে নিয়ে সঠিক উত্তর দিলেন। শুনে আক্রোশ আরও বাড়ল। চড়থাপ্পড় আর অকথ্য গালাগালি। প্রশ্ন ছুটে এল গুজরাত দাঙ্গা নিয়ে। জাতীয় সঙ্গীত কী বলতে না পারায় জুটল আরও এক প্রস্ত লাঞ্ছনা। তার পর জনগণমন-র কথা জিজ্ঞাসা করায় অবশ্য দু’কলি গেয়ে শুনিয়েও দেন। কিন্তু তাতে রাগ পড়েনি। বলতে হল ‘বন্দেমাতরম’ আর ‘ভারতমাতা কি জয়’!
গোটা ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল কিন্তু একটি প্রশ্ন থেকে। নাম কী? ‘জামাল মোমিন’ বলতেই পরের প্রতিক্রিয়া এগুলো। এ রাজ্যে ট্রেন-কামরায় এমন অবলীলায় আগ্রাসী হিন্দুত্ব, জাতিবিদ্বেষ আর উগ্র জাতীয়তাবাদের বিস্ফোরণ সম্বলিত ভিডিয়োটি দেখে স্তম্ভিত নাগরিক সমাজের বড় অংশ। সহযাত্রীদের কেউ প্রতিবাদ করলেন না কেন, কী উদ্দেশ্যে ওই ভিডিয়ো সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়ানো হল, প্রশ্ন তা নিয়েও।
ঘটনাটি গত ১৪ মে-র। কলকাতা থেকে কালিয়াচকে ফিরছিলেন জামাল। আধার কার্ড অনুযায়ী নামটা অবশ্য মহম্মদ মনিরুল শেখ। হাওড়া থেকে ট্রেনে উঠে জানলার ধারেই আসন পান। ব্যাগটা রেখে নেমেছিলেন চা খেতে। উঠে দেখেন, তাঁর জায়গায় বসে অন্য এক জন। দলে তাঁরা চার জন। মনিরুল আসনটা ছেড়ে দিতে বলেন। তাতেই ঘটনার শুরু। কোনও না কোনও প্রশ্ন করা হচ্ছে মনিরুলকে, থমকালেই চড়। চলল প্রায় আধ ঘণ্টা। ব্যান্ডেলে নেমে যায় ওই দলটি।
গুজরাতে দিনমজুরের কাজ করেন মনিরুল। বাড়ি ফিরে তিনি কিছু বলেননি। শেরশাহী নয়গ্রামে থাকেন তাঁর স্ত্রী-ছেলে। পঞ্চায়েত ভোটের জন্য এসেছিলেন। তখনই এক বার কলকাতা যান। আবার গুজরাত ফিরেও গিয়েছেন। তাই বিষয়টা বেমালুম হারিয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু সেই রাতে মোবাইলে রেকর্ড করা তাঁকে নির্যাতনের দৃশ্য সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়েছে। মনিরুলের স্ত্রী জুলেখাবিবিও তা দেখে আঁতকে উঠেছেন। তিনি বলছেন, ‘‘এমন করে মারল! কিন্তু আমাকে কিছুই বলেনি।’’ কেন বলেননি? মনিরুল গুজরাত থেকে ফোনে বলেন, ‘‘জুলেখা আরও ভয় পেত। এমনিতেই বাইরে থাকি।’’
আরও পড়ুন: জঙ্গলমহলে জমি ফেরাতে ভরসা ‘ভারতী মডেল’?
কালিয়াচকের বাসিন্দারা বলছেন, আফরাজুল কাণ্ডের পর থেকেই এই ভয় চেপে বসেছে তাঁদের মনে। আফরাজুল রাজস্থানে কাজে গিয়ে নৃশংস ভাবে খুন হন। স্থানীয় এক জনের কথায়, এলাকায় শিক্ষার হার কম, কাজের সুযোগ কম, তাই হাজারো ভয় নিয়েই জীবন কাটাতে হয় তাঁদের। এলাকার বাইরে বেরোলেই নির্যাতন-অসম্মান-ভয় ওত পেতে থাকে। কিন্তু ট্রেনের কামরায় সর্মসমক্ষে যে ভাবে এক জনকে দল বেঁধে নিগ্রহ করা হল দেশভক্তির নামে, ধর্মের নামে, তা রীতিমতো ত্রাসের সঞ্চার করছে গোটা সমাজ জুড়েই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy