Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

রবীন্দ্রনাথকে বুঝতে একটা জীবন কি যথেষ্ট

অসাধারণ স্থাপত্য, চারপাশে মানুষের ভিড়, কেমন একটা মন কেমন করা পরিবেশ। কিন্তু সেই পরিবেশ আচমকাই অন্য দিকে মোড় নিল কুর্দদের বিক্ষোভের জন্য।

রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। বর্ধমানের এক সংবর্ধনা সভায় রবীন্দ্রনাথ। নিজস্ব চিত্র

রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। বর্ধমানের এক সংবর্ধনা সভায় রবীন্দ্রনাথ। নিজস্ব চিত্র

সৈয়দ তানভীর নাসরীন
শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০১৮ ১৫:৩৫
Share: Save:

সেই যে ফারহান আখতার ‘দিল চাহতা হ্যায়’ (২০০১) বানালেন, আর একবিংশ শতাব্দীর প্রেমকে নতুন সংজ্ঞা দিলেন, তখন থেকেই সিডনি অপেরা হাউসকে নিয়ে অনেক ভারতীয়ের মধ্যে কেমন যেন একটা উন্মাদনা আছে। আমির খান আর প্রীতি জিন্টার ‘রোম্যান্স’ দেখতে গিয়ে তাঁরা কখন যেন অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের বন্দর-শহরের অপেরা হাউসের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন। এ দেশে যখন গ্রীষ্মের দাবদাহ, তখন অস্ট্রেলিয়ায় শীতের শুরু। বৈশাখে অস্ট্রেলিয়ায় সেই শীতের শুরুতে যখন সিডনিতে চক্কর মেরে বেড়াচ্ছি, তখন বন্দরের ধারে অপেরা হাউসে যেতেই হবে।

অসাধারণ স্থাপত্য, চারপাশে মানুষের ভিড়, কেমন একটা মন কেমন করা পরিবেশ। কিন্তু সেই পরিবেশ আচমকাই অন্য দিকে মোড় নিল কুর্দদের বিক্ষোভের জন্য। ইরাকের কুর্দ প্রভাবিত এলাকাগুলির উপরে তুরস্কের হামলার প্রতিবাদ জানাতে প্রবাসী কুর্দরা বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন অপেরা হাউস থেকে অদূরে। হাতে পোস্টার, তুরস্কের রাষ্ট্রপতি এদোদোয়াঁর (Erdogan) কুশপুতুল, আর তার সঙ্গে সুরে-ছন্দে গান আর কবিতা। কুর্দদের নিয়ে আগ্রহ রয়েছে, তাই অপেরা হাউস ভুলে কুর্দ নারী-পুরুষদের অবস্থান, সত্যাগ্রহ দেখছিলাম। তাঁদের গান শুনতে শুনতে হঠাৎ রবীন্দ্রনাথের একটা গান মাথায় চলে এল। ‘বাধা দিলে বাধবে লড়াই, মরতে হবে। পথ জুড়ে কী করবি বড়াই, সরতে হবে’।

এটাই রবীন্দ্রনাথের মাহাত্ম্য। সিডনি হোক বা শিকাগো, প্রতিবাদ হোক বা প্রেম, আমাদের হৃদয় আর মস্তিস্কে রবীন্দ্রনাথ ফিরে আসবেনই। যে দেশেই যাই না কেন, রবীন্দ্রনাথ সর্বক্ষণ, সর্বসময় আমাদের সঙ্গী। বৈশাখের দাবদাহে বর্ধমানে যখন জ্বলছি, তখনও তাঁকে মনে পড়ে, আবার এই বৈশাখেই অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরায় প্রবাসী বাঙালিদের আড্ডায় গুনগুন করে গাই, ‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না। কেন মেঘ আসে হৃদয়- আকাশে, তোমারে দেখিতে দেয় না’। সে গান শুনে অস্ট্রেলিয়ার প্রবাসী বাঙালিরা যখন বলেন, ‘‘রবীন্দ্রনাথ বোধ হয়, এই শীতের অস্ট্রেলিয়ায় সূর্যদেবের কথা ভেবেই গানটা লিখেছিলেন। এখন থেকে তো সূর্যদেবের আর দেখা পাব না’’, তখন যেমন মনে হয় তিনি কত প্রাসঙ্গিক, তেমনই ফিরে এসে যখন তারাবাগে, আমার বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসগৃহে কালবৈশাখী আছড়ে পরে, তখনও তো তাঁর লেখাই মাথায় আসে। ‘তোমায় আমায় সারাজীবন সকাল-সন্ধ্যাবেলা নয় এ মধুর খেলা। কতবার যে নিবল বাতি, গর্জে এল ঝড়ের রাতি--সংসারের এই দোলায় দিলে সংশয়েরই ঠেলা’।

কৈশোরে যখন কোনও বয়স্ক আত্মীয় বা আত্মীয়া জিজ্ঞেস করতেন, ‘‘প্রেম-টেম করছিস নাকি? কাকে জোটালি?’’, তখন থেকেই হাসতে হাসতে বলতাম, ‘‘প্রেমিক? শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রনাথ থাকতে আবার প্রেমিকের অভাব!’’ আজও মনে প্রাণে বিশ্বাস করি, সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি মহিলার প্রথম প্রেম শুরু হয় রবীন্দ্রনাথ থেকে। তিনিই তাঁদের অস্তিত্বে, মননে, শিকড়ে এমন ভাবে গেঁথে যান, যে সেই বাঙালি রমণীরা আর রবীন্দ্রনাথের ছায়া থেকে বেরোতেই পারেন না। সারা জীবন আসলে তাঁর গান, কবিতা, সাহিত্যের সঙ্গেই ‘সহবাস’ করেন। এই ‘সহবাস’ এত অন্তর দিয়ে করা হয়, যে হৃদয়- মনের গভীরে অন্য পুরুষকে জায়গা করে নিতে বেশ কষ্ট করতে হয়।

আরও পড়ুন: স্মৃতির পাতায় ফিরে দেখা রবীন্দ্রনাথ

এ বছর রবীন্দ্রজয়ন্তীর আগেও যখন ‘গুগল’ খুললেই রবীন্দ্রনাথ এবং ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো-র সম্পর্ক নিয়ে ‘স্টোরি’তে ছেয়ে রয়েছে, তখন আমার মতো অসংখ্য নাম না জানা ক্ষুদ্র রবি-অনুরাগিনী হয়তো মনে মনে হাসেন। ‘গুগল’ হয়তো ২৫শে বৈশাখের আগে এ রকম একটা ‘স্টোরি’ এনে সবাইকে চমকে দিতে চাইছে, কিন্তু কী করে জানবে, কত অসংখ্য রবি-অনুরাগিনী ছড়িয়ে রয়েছেন পৃথিবীর নানা প্রান্তে। তাঁদের মধ্যে কেউ বিখ্যাত, কাউকে নিয়ে আখ্যান রচিত হয়েছে, আর অনেকেই রয়ে গিয়েছেন অজান্তে-আড়ালে। সব মীরার তো কৃষ্ণের সাক্ষাৎ দর্শনের দরকার নেই, অনেকের জন্য মূর্তিই যথেষ্ট। আর রবীন্দ্রনাথের মূর্তি তো শুধু কাঠ বা সিমেন্ট দিয়ে তৈরি হয় না, সে মূর্তি থাকে হৃদয়ে, তাঁর লেখায়-ছবিতে, গুনগুন করে গেয়ে ওঠা গানের কলিতে।

নারী এবং বাঙালি রমণী সম্পর্কে এক ঘরোয়া আলাপচারিতায় এক বার প্রয়াত ঋতুপর্ণ ঘোষও ঠিক একই কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘‘ওই পোশাক, ওই দাড়ি, ওই চেহারা—বাঙালি মহিলার হৃদয়ের অন্তঃপুরে এতো গভীর ভাবে গেঁথে আছে, অন্য কোনও ব্যক্তিত্বের সেই জায়গাটা নেওয়া মুশকিল।’’ সত্যিই, পৃথিবীর যে কোনও গোলার্ধে বসবাসকারী বাঙালিদের কাছে তিনিই সবচেয়ে উজ্জ্বল ‘আইকন’। এমনকী, এই বাংলা, আর ওপার বাংলায় রাজনীতি করতে গেলেও আপনাকে রবীন্দ্রনাথ থেকেই উদ্ধৃতি দিতে হবে।

বাংলাদেশের এক বন্ধু, সে দেশের বিখ্যাত আমলা জিল্লার রহমান এক বার আমাদের সঙ্গে শান্তিনিকেতনে বেড়াতে গিয়েছিলেন। দেখি, সঙ্গীতভবন, কলাভবনের সামনে থেকে তিনি আর নড়ছেন না। তাঁকে তাড়া দিচ্ছি। তাঁর কোনও তাড়া নেই। অনেক বলার পরে তিনি বলেছিলেন, ‘‘রবীন্দ্রনাথকে বুঝতে বা জানতে একটা জীবন লেগে যায়, সেখানে এক দিনে আমি কী করে শান্তিনিকেতনের সব দেখে ফেলি বলুন তো!’ রবীন্দ্রনাথকে অনুধাবন করার জন্যে একটা জীবন কি যথেষ্ট? আমিও বিশ্বাস করি, মোটেই যথেষ্ট নয়।

বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

rabindranath tagore rabindra jayanti special
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE