Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
State news

ছাইপোড়া ইটে রবীন্দ্র-স্মৃতির গন্ধ

গেট পেরিয়ে চোখ যায় ঝাউপাতার মোটিফের উপরে কাঠের তৈরি নামফলকের দিকে, মিস্টার অ্যান্ড মিসেস টেগোর। টেগোর!

ক্লাস চলছে বিশ্বভারতীতে। —ফাইল চিত্র।

ক্লাস চলছে বিশ্বভারতীতে। —ফাইল চিত্র।

স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০১৮ ১৫:১১
Share: Save:

আজ তাঁর জন্মদিন।

তিনি বলে গেছেন,

‘রবে মোর মৌন বীণা মূর্ছিয়া তোমার পদতলে।

আর রবে পশ্চাতে আমার, নাগকেশরের চারা

ফুল যার ধরে নাই, আর রবে খেয়াতরীহারা

এ পারের ভালোবাসা— বিরহস্মৃতির অভিমানে

ক্লান্ত হয়ে রাত্রিশেষে ফিরিবে সে পশ্চাতের পানে।

তাঁর কথা নিয়ে খেয়াতরীহারা প্রান্তরে তাঁকে খুঁজতে শহর ছেড়ে লাল মাটির রাস্তায় পৌঁছে গেলাম।

সে বাড়ির ছাইপোড়া ইটে ইতিহাসের গন্ধ। সেই গন্ধের নাম ‘শোহিনী’। শান্তিনিকেতন। গেট পেরিয়ে চোখ যায় ঝাউপাতার মোটিফের উপরে কাঠের তৈরি নামফলকের দিকে, মিস্টার অ্যান্ড মিসেস টেগোর। টেগোর!

‘‘আমার দিদি সুপূর্ণা যখন জন্মায়, তখন তাকে গুরুদেবের কোলে দেওয়া হলে তিনি বলেছিলেন, এই মেয়ের নাম রেখো স্বলীলা, যদিও সে নাম রাখা যায়নি। আমার বাবা-মা তাঁর নাম দিয়েছিলেন সুপূর্ণা। এত যুগ পেরিয়ে আজ যখন আমার ছেলের মেয়ে হল, আমি রবীন্দ্রনাথের ওই নাম রাখলাম। এত দিন রবীন্দ্রনাথের ওই নাম অপেক্ষা করেছিল!’’ থামলেন সুপ্রিয় ঠাকুর, যিনি সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রপৌত্র, তাঁর স্ত্রী শুভ্রা ঠাকুরের মা গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাতনি। ঠাকুরবাড়ি যেন স্ফটিকের মতো আভা ছড়াচ্ছে ওই বাড়িতে।

দেখুন ভিডিও:

রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন বলতে কী মনে পড়ে? ‘‘জোড়াসাঁকো থেকে শান্তিনিকেতনে চলে আসার পর আমাদের ছোটবেলায় রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন হত নববর্ষের দিন। কারণ পঁচিশে বৈশাখ গরমের ছুটি পড়ে যেত, ছাত্রদের পাওয়া যেত না। যদিও পরে ঠিক হয়, ছুটি পিছিয়ে জন্মদিনের দিন উৎসব হবে। এই উৎসব মানেই ঘণ্টাতলায় জন্মদিন পালন। আর মনে পড়ে, জোট বেঁধে বকুলবীথিতে খাওয়াদাওয়া।’’ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে তাঁর চোখ। যেন সেই কথা ‘ফিরিবে সে পশ্চাতের পানে’।

সময় বদলেছে। বৈশাখের তপ্ত বেলায় বকুলবীথির দিকে ফিরে দেখলে দেখি কাচের মন্দির পেরিয়ে আম্রকুঞ্জের উচছ্বাসের মাঝে একটু অবহেলায় একা হয়ে আছে বকুলবীথি। বকুল বিছানো পথ আছে। কিন্তু তাকে দেখার পথিক আর নেই!

‘‘ভিড় বেড়েছে। ঘরোয়া শান্তিনিকেতন, রবীন্দ্রনাথ এখন বিশ্বের, তাই ওই বকুলবীথির খাওয়াদাওয়ার জন্মদিন হারিয়ে গেছে। তবে সন্ধেবেলা নৃত্যনাট্য পরিবেশনের রীতি থেকে গেছে।’’ স্মৃতি বলছেন সুপ্রিয় ঠাকুর। আর তাঁর পাশেই রাখা দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের এস্রাজ! রবীন্দ্রনাথ বলতেন, ‘‘দীনু আমার সকল গানের কাণ্ডারী।’’

আরও পড়ুন: কথা বলুক সবাই, চাইতেন রবীন্দ্রনাথ

ইন্দিরা দেবী চৌধুরানি থাকার সময় পঁচিশে বৈশাখ তাঁদের বাড়িতে ভিড় জমতো। তাঁকে দেখার জন্য, প্রণাম করার জন্য। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি থেকে আনা লম্বা আরামকেদারার দিকে তাকিয়ে রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনের কথা বলছিলেন সুপ্রিয় ঠাকুর। তাঁর ঠিক একটু দূরের সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কমন্ডুলু যেন ছড়ানো স্মৃতির মাঝে সোনার মতো আলো ছড়াচ্ছে।

এত স্মৃতির মাঝে থেকে যাওয়াটা কেমন?

‘‘খুব সুখকর নয়। এই তো আমাদের খাবার টেবিলটা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের। রোজ যদি এ সব নিয়ে ভাবি তো স্বাভাবিক ভাবে বাঁচতে পারব না। আসলে উত্তরাধিকার বহন করা খুব সহজ নয়,’’ যোগ করলেন তিনি।

খাবার টেবিল পেরিয়ে দূরে রাখা ঠাকুরবাড়ির পিয়ানো। স্পর্শ করলে যার থেকে গগন ঠাকুরের পরিবারের ইতিহাস বেরিয়ে আসে।

আচ্ছা, রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনের উৎসব মানে কি শুধুই গান গাওয়া? সঙ্গে সঙ্গে উত্তর আসে, ‘‘একেবারেই না। গান তো সমুদ্রের মধ্যে এক ঢেউ জল। তবে ওই ভিড়ের কারণে গান মাঝে মাঝে কোলাহলে হারিয়ে যায়। তবে ভাল গানও শুনি অনেক।’’

ঠাকুরবাড়ির স্থিতধী, বক্তব্যের ভারসাম্য তাঁর রক্তে।

বাড়ি ঘিরে ক্যামেরা, আলো, আসবাব এ দিক-ও দিক করার আওয়াজ...আড়াই মাসের স্বলীলা কি ঘুম ছেড়ে উঠে পড়ল?

চোখ ফেরাই। দেখি সে এক গালে হাত দিয়ে ঘুমের দেশে। তার পাশেই রাখা রবীন্দ্রনাথের লেখার কাঠের টেবিল!

স্বলীলার মুখে সকালের রবির আলো!

জন্মদিন আর কোনওখানে নয়!

আজ তিনি এইখানেই, ‘রবে মোর মৌন বীণা মূর্ছিয়া তোমার পদতলে।’

ক্যামেরা অজয় রায়

এডিটিং শৌভিক দেবনাথ

প্রোডিউসার অভিরূপ দাম

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE