এ-ও এক ঘুরে দাঁড়ানোর কাহিনি!
পশ্চিমবঙ্গ রেশমশিল্পী সমবায় মহাসঙ্ঘের গায়ে একদা অলাভজনক তকমা সেঁটে গিয়েছিল। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে তারা ইতিমধ্যে নজরকাড়া সাফল্য পেয়েছে, যার নেপথ্যে অবশ্যই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের ভূমিকা। পণ্যের গুণমান ও সরকারি বরাতের বহর বাড়িয়ে স্বনির্ভরতার পথে ছোটানো গিয়েছে ধুঁকতে থাকা প্রতিষ্ঠানটিকে।
কারবারের হিসেবপত্রে পরিবর্তনটা পরিষ্কার। ২০০৬-০৭ অর্থবর্ষে সমবায় প্রায় ১ কোটি ৪৫ লক্ষ টাকার সামগ্রী বেচেছিল। ২০১৪-১৫য় সাড়ে ৩ কোটির। সে বছর লাভ হয় প্রায় ৭০ লক্ষ টাকা। পুনরুত্থানের সেই শুরু। ‘‘ভর্তুকি ছাড়া এক পা চলা মুশকিল ছিল। এখন দরকার পড়ছে না। দু’বছর হয়ে গেল, আমরা মোটের উপর স্বাবলম্বী।’’— বলেন সমবায়ের এক কর্তা। মহাসঙ্ঘের এমডি অরুণিমা দে’র মন্তব্য, ‘‘আগে অর্ডার পেতে হা পিত্যেশ করতে হতো। এখন জিনিস দিয়ে কূল পাচ্ছি না।’’
মূলত রেশমশিল্পীদের মহাজনের গ্রাস থেকে বাঁচানোর লক্ষ্যে ১৯৫৮য় মহাসঙ্ঘের পত্তন। এর আওতায় রয়েছে বিভিন্ন জেলার ১৬টি রেশমশিল্পী সমবায়। তবে বিপদ ঘনায় অন্য দিকে। নাগরিক জীবনে রেশমের পড়তি কদর ব্যবসায় ভাটা ডেকে আনে। নব্বইয়ের দশকের শেষাশেষি পরিস্থিতি রীতিমতো সঙিন হয়ে ওঠে।
তখনও সমবায় অবশ্য চলছিল খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। ২০০৫ নাগাদ একেবারে মুখ থুবড়ে পড়ে। সুরাহার উপায় খুঁজতে ২০০৭-এ তদানীন্তন বাম সরকার এক সংস্থাকে দিয়ে সমীক্ষা করিয়েছিল। রিপোর্টের সুপারিশ মেনে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়া চালু হয় ২০১০-এ। সাফল্য এসেছে এই আমলে। কী ভাবে?
‘‘পণ্যের মান ও বৈচিত্র বাড়িয়ে। আধুনিক ক্রেতার পছন্দের সঙ্গে তাল রেখে। বিপণনে জোয়ার এনে।’’— ব্যাখ্যা করছেন মহাসঙ্ঘের এক আধিকারিক। যেমন, আগে ‘প্রকিওরেটর কমিটি’তে সিল্কের গুণমান যাচাইয়ের জন্য বিশেষজ্ঞ কিংবা ডিজাইনার রাখার বালাই ছিল না। সমবায় থেকে সিল্কের থান কিনে সোজা পাঠানো হতো শ্রীরামপুরে, প্রিন্টারদের কাছে। তাঁরা নিজেদের পছন্দমাফিক রং-নক্শায় শাড়ি বানাতেন। কিন্তু বাঁধা গতের বাইরে বিশেষ যেতে পারতেন না। বাঁকুড়ার বালুচরীতেও তা-ই।
ফলে শহুরে ক্রেতার ভিড় ক্রমশ কমছিল। এখন উল্টো ছবি। কমিটিতে চার জন বিশেষজ্ঞ। ডিজাইন নিয়ে নিরন্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা। পরিণামে পণ্যসম্ভার রং-ডিজাইনের বৈচিত্রে ভরপুর। যে হেতু উন্নত মানের সিল্ক ছাড়া বিভিন্ন শেডের রং ও ডিজাইন খোলে না, তাই রেশমের মানোন্নয়নেও সবিশেষ গুরুত্ব। বিশেষজ্ঞ সৌরভ মজুমদার বলেন, ‘‘গুটিপোকা থেকে সুতো বার করার প্রক্রিয়ায় উন্নত প্রযুক্তির প্রয়োগ শুরু হয়েছিল ২০০৬-এ। ২০১১-র পরে তা জোরদার হয়েছে।’’ ২০১৪-য় রাজ্য সরকার বাঁকু়ড়া-মুর্শিদাবাদের শিল্পীদের হাতে পৌঁছে দিয়েছে অটোম্যাটিক সিল্ক রোলিং ও তসর রোলিং মেশিন, যা দিয়ে আরও ভাল সুতো তৈরি করা যায়।
এবং সেই সুতোর দৌলতেই বাংলার রেশমবস্ত্রে ইদানীং হরেক ডিজাইন ও রঙের বাহার। ‘‘ডিজাইন ও রং না-বদলালে বাজারে টিকে থাকা যাবে না। রেশমশিল্পীরা লাল, নীল, কালোর মতো প্রাথমিক রঙের উপরে বিভিন্ন শেড ব্যবহার করে ঘুরে দাঁড়াতে পারছেন।’’— পর্যবেক্ষণ ফ্যাশন ডিজাইনার অগ্নিমিত্রা পলের। ফ্যাশন ডিজাইনার অভিষেক দত্ত বলেন, ‘‘নতুন ভাবে বিভিন্ন রঙের ব্যবহার রেশমি শাড়ির জনপ্রিয়তা ফেরাচ্ছে।’’ মেয়েদের জ্যাকেট, লেহেঙ্গা, প্যান্ট বা ছেলেদের জহরকোট-কুর্তায় রেশমের ব্যবহার বাড়ানোর পরিকল্পনাকেও তিনি স্বাগত জানিয়েছেন।
এ তো গেল উৎপাদনের সঞ্জীবনী। পাশাপাশি যুগোপযোগী বিপণনের প্রয়াসও জারি। এক কর্তার কথায়, ‘‘কবে খদ্দের দোকানে আসবে, সে অপেক্ষায় থাকার দিন ফুরিয়েছে। এখন আমাদেরই খদ্দেরের দরজায় হাজির হতে হবে।’’
তাই পেশাদার এজেন্সির সাহায্য নেওয়া হচ্ছে। একাধিক ম্যাগাজিনে নিয়মিত চোখ টানছে রেশম সমবায়ের জমকালো বিজ্ঞাপন। জনপ্রিয় সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে নিজস্ব পেজ খুলেছে গত বছর। এ বছরে হয়েছে নিজস্ব ওয়েবসাইট। প্রতিনিয়ত তা আপডেট হচ্ছে। আপলোড হচ্ছে নিত্যনতুন ডিজাইনের শাড়ির ছবি। কর্মযজ্ঞের প্রতিক্রিয়ায় চাহিদা বাড়ছে। তাই বা়ড়ছে শোরুমের সংখ্যা। পুরনো শোরুম নতুন করে সেজে উঠছে। মাসখানেকের মধ্যে অনলাইন বিক্রি শুরু হওয়ার কথা।
জড়ত্বের গুটি কেটে সরকারি রেশমশিল্পের এ যেন সাফল্যের উড়ান। হৃত গৌরব ফেরানোর লক্ষ্যে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy