Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

অম্বিকেশদের মামলার ভবিষ্যৎ নিয়েই প্রশ্ন সরকারের অন্দরে

সুপ্রিম কোর্টে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৬এ ধারা বাতিলের সঙ্গে সঙ্গেই অবধারিত ভাবে উঠে এসেছে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটা। পশ্চিমবঙ্গে এই ধারায় যে সব মামলা চলছে, সেগুলির কী হবে? আইনজ্ঞদের অনেকেই বলছেন, যে হেতু সর্বোচ্চ আদালত ওই ধারাটিই বাতিল করে দিয়েছে, তাই যে সব মামলায় এই ধারা প্রযুক্ত হয়েছে, সেগুলি আর প্রয়োজ্য নয়। অর্থাৎ, যাঁদের ক্ষেত্রে শুধু মাত্র এই ধারাটি প্রযুক্ত হয়েছে, সেই সব মামলা খারিজ হয়ে যাবে। রাজ্যের আইন ও বিচার দফতর এবং স্বরাষ্ট্র দফতরের আমলারা এ দিন সকাল থেকেই সুপ্রিম কোর্টের রায় নিয়ে দফায় দফায় আলোচনা করেছেন।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২৫ মার্চ ২০১৫ ০৪:০৬
Share: Save:

সুপ্রিম কোর্টে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৬এ ধারা বাতিলের সঙ্গে সঙ্গেই অবধারিত ভাবে উঠে এসেছে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটা। পশ্চিমবঙ্গে এই ধারায় যে সব মামলা চলছে, সেগুলির কী হবে?

আইনজ্ঞদের অনেকেই বলছেন, যে হেতু সর্বোচ্চ আদালত ওই ধারাটিই বাতিল করে দিয়েছে, তাই যে সব মামলায় এই ধারা প্রযুক্ত হয়েছে, সেগুলি আর প্রয়োজ্য নয়। অর্থাৎ, যাঁদের ক্ষেত্রে শুধু মাত্র এই ধারাটি প্রযুক্ত হয়েছে, সেই সব মামলা খারিজ হয়ে যাবে।

রাজ্যের আইন ও বিচার দফতর এবং স্বরাষ্ট্র দফতরের আমলারা এ দিন সকাল থেকেই সুপ্রিম কোর্টের রায় নিয়ে দফায় দফায় আলোচনা করেছেন। রাজ্যে এ ধরনের মামলার সংখ্যা কত, তা জানার জন্য কলকাতা হাইকোর্ট এবং বিভিন্ন আদালতের কাছে খোঁজখবর নিতে শুরু করেছে আইন ও বিচার দফতর। কিন্তু ওই সব মামলার ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নিয়ে আমলাদের অনেকেই বিভ্রান্ত।

আমলাদের একাংশ বলেছেন, সর্বোচ্চ আদালত রায় ঘোষণার পর ওই ধারায় মামলা চালানোর কোনও মানে হয় না। বরং, সরকার অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সত্যিই মামলা চালিয়ে যেতে চাইলে ফৌজদারি বিধির অন্য বিকল্প ধারা যোগ করতে পারে। নতুন করে মামলাও করতে পারে। আর বিচার প্রক্রিয়ার মধ্যে যদি তা করা সম্ভব না হয়, তা হলে আদালতের উপরেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার ছেড়ে দেওয়া উচিত বলে জানান আমলাদের কেউ কেউ।

এ প্রসঙ্গে প্রশাসনিক মহলে সবচেয়ে বেশি চর্চা শুরু হয়েছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অম্বিকেশ মহাপাত্রের মামলাটি নিয়ে। ২০১২ সালে রেলের ভাড়া বাড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রোষের মুখে মন্ত্রিত্ব ছাড়তে হয় তৎকালীন রেলমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদীকে। মমতার নির্দেশে রেল মন্ত্রকের দায়িত্ব পান তৃণমূলের তৎকালীন সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়। ওই বছরের এপ্রিল মাসে মুকুল, দীনেশ ও মমতাকে নিয়ে একটি কার্টুন ই-মেলে কয়েক জনকে ফরোয়ার্ড করেন অম্বিকেশবাবু। তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৬এ ধারা প্রয়োগ করে তাঁকে গ্রেফতার করে কলকাতা পুলিশ। দায়ের করা হয় মামলাও।

রাজ্য মানবাধিকার কমিশন এবং হাইকোর্ট এই মামলায় অম্বিকেশবাবুকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দেয়। সরকার সেই নির্দেশ এখনও মানে নি। এর মধ্যেই সর্বোচ্চ আদালতের রায় আসায় মামলাটির ভবিষ্যৎ নিতে প্রশাসনিক মহলে আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছে।

সুপ্রিম কোর্টের এ দিনের রায়ের পরে স্বাভাবিক ভাবেই কিছুটা স্বস্তিতে অম্বিকেশবাবু। তিনি বলেন, “সংবিধানে থাকা মানুষের মৌলিক অধিকার খর্ব করছিল বিভিন্ন রাজ্যের সরকার। সুপ্রিম কোর্টের রায় বুঝিয়ে দিল, পুলিশি ক্ষমতা দেখিয়ে মানুষের মৌলিক অধিকার খর্ব করা যায় না।”

এখন তিনি কী করবেন? যাদবপুরের এই শিক্ষকের প্রতিক্রিয়া, “এখন কিছুই করব না। রাজ্য কী করে, তা দেখে সিদ্ধান্ত নেব। শুনানির সময়ে সুপ্রিম কোর্টের রায় তুলে ধরব।”

শুধু অম্বিকেশ মহাপাত্র নন, ফেসবুকে মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অশালীন মন্তব্য করার অভিযোগে গত বছর ১৪ অক্টোবর রাতে মালদহের হরিশচন্দ্রপুর থেকে কর্মচ্যুত সিভিক ভলান্টিয়ার বাপি পালকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। রাত পৌনে ১১টায় অভিযোগ পাওয়ার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বাপি পালকে পুলিশ গ্রেফতার করে। তাঁর বিরুদ্ধেও টেলিগ্রাফ আইনের ৬৬এ ও ৬৭ ধারায় মামলা করা হয়। ওই দুটি ধারা ছাড়াও পরে ৫০৬ ও ৫০৯ ধারাও বাপি পালের বিরুদ্ধে যোগ করা হয়। ওই ঘটনায় এখনও চার্জশিট জমা পড়েনি।

চাঁচল মহকুমা আদালতে বাপির আইনজীবী হিমাদ্রিশেখর দাস বলেন, “এখনও পুলিশ চার্জশিট জমা করেনি। ফলে মামলার শুনানিও শুরু হয়নি। তবে উচ্চ আদালতের রায়ের পর ওই ধারা বাদ গেলে বাকি ধারাগুলিও বাদ গিয়ে মামলার আর অস্তিত্ব থাকবে না। কেন না ৬৬এ ধারার সঙ্গেই বাকি ধারার মামলাগুলি সম্পৃক্ত।”

এই ধরনের মামলাগুলির ব্যাপারে রাজ্যের অবস্থান কী হবে?

আইন দফতরের এক কর্তার দাবি, বিচার প্রক্রিয়া চলছে। এখন রাজ্য সরকারের কিছু করার নেই। আদালতের কাছে অভিযুক্ত চাইলে আবেদন করতে পারেন। এর পর আদালত যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার, নেবে। যে সব মামলায় এখনও চার্জশিট জমা পড়েনি, সেই সব ক্ষেত্রে এই ধারার আর কোনও গুরুত্ব রইল না বলেও জানিয়েছেন ওই কর্তা।

তবে ৬৬এ ধারায় মামলা করার মধ্যে কোনও অন্যায় দেখছে না আইন দফতর। এক কর্তার বক্তব্য, টেলিগ্রাফ আইন কেন্দ্রীয় সরকার তৈরি করে। আইন সংশোধন করে ৬৬এ ধারাটি কেন্দ্রীয় সরকারই যুক্ত করেছিল। আইনে যখন ছিল, তা ব্যবহার করে এই মামলাগুলি দায়ের করা হয়েছিল। এখন সুপ্রিম কোর্ট তা বাতিল করে দিলে, কেন্দ্রীয় সরকার নিশ্চয় আইন থেকে তা বাদ দিয়ে দেবে।

এ প্রসঙ্গে কলকাতা হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি ভগবতীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৬এ ধারায় পুলিশ ও প্রশাসনকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল দণ্ডনীয় ধারায় মামলা দায়ের করার। সুপ্রিম কোর্ট মনে করেছে, ওই ধারায় সংবিধানের বাক ও মত প্রকাশের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। তাই বাতিল করা হয়েছে ওই ধারা।” ভগবতীপ্রসাদবাবু মনে করেন, ওই ধারার অপব্যবহার করা হচ্ছিল। কারও মানহানির বিষয়টি ভারতীয় দণ্ডবিধিতে আগে থেকেই সুরক্ষিত রয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট ৬৬এ ধারা বাতিল করায় এ রাজ্য-সহ দেশের অন্য রাজ্যে ওই ধারায় যে সব মামলা হয়েছে, সেগুলি আপনাআপনি খারিজ হয়ে যাবে।

কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী অরুণাভ ঘোষ জানান, মানহানি, অবমাননা ইত্যাদি হলে ভারতীয় দণ্ডবিধি অনুযায়ীই ব্যবস্থা নেওয়া যায়। তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৬এ ধারা নতুন করে যোগ করা হয়েছিল। ভারতীয় দণ্ডবিধিতে অভিযুক্তকে যে সুরক্ষা-কবচ দেওয়া আছে, ৬৬এ ধারায় তা নেই বলে জানান তিনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE