টিবি রুখতে সচেতনতাই প্রধান অস্ত্র। ছবি: শাটারস্টক।
বিনামূল্যে ওষুধ। পুষ্টিকর খাদ্যের জন্য টাকা। বাড়ি বাড়ি ঘুরে আক্রান্তদের ডটস কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া। সদিচ্ছা প্রমাণ করে, এমন অনেক সরকারি পরিষেবা আছে। কিন্তু প্রতিকূলতাও আছে। দিয়া বেহারি, বাবলু হাজরা, আমিনা খাতুন (সবই ছদ্মনাম)-এর মতো যক্ষ্মায় আক্রান্তেরাই সেই মূর্তিমান প্রতিকূলতা। কারণ, তাঁরা দলছুট। রবিবার বিশ্ব যক্ষ্মা দিবসে এই দলছুটদের আগলে রাখাটাই চ্যালেঞ্জ।
গত ডিসেম্বরে যক্ষ্মা ধরা পড়ার পরে ১৭ বছরের কিশোরী দিয়ার চিকিৎসা শুরু হয়। চিকিৎসার মাঝপথে হারিয়ে গিয়েছিল দিয়া। যক্ষ্মা চিকিৎসকদের পরিভাষায় যাঁদের পরিচয়, ‘লস্ট টু ফলো আপ’। আদিবাসী কিশোরীর ঘটনা সম্পর্কে অবহিত রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্মী বলেন, ‘‘দিয়ার বাবা মদ্যপ। মা ও মেয়ে মাঠে কাজ না-করলে সংসার চলে না। কেন্দ্রীয় প্রকল্পে পুষ্টিকর খাদ্যের জন্য মেয়েটির অ্যাকাউন্টে দেওয়া ৫০০ টাকাও নেশার জিনিস কিনতে কেড়ে নেন বাবা। বিকল্প হিসেবে চাল, গম, স্বাস্থ্য-পানীয় কিনে দেওয়া হত দিয়াকে। সেই স্বাস্থ্য-পানীয় বোঁচকার মধ্যে লুকিয়ে রাখে দিয়া। কারণ, বাবার নজরে পড়লে সেটাও বিক্রি করে দিয়ে নেশা করবেন উনি!’’
মুর্শিদাবাদে যক্ষ্মা নিবারণ কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত এক স্বাস্থ্যকর্মী বললেন বহরমপুর ব্লকের বল্লমপাড়ার বাসিন্দা বাবলু হাজরার কথা। ওই স্বাস্থ্যকর্মীর কথায়, ‘‘পেশায় খালাসি বাবলুকে দিনে ১৩টি ওষুধ খেতে হয়। শরীরে দুর্বলতার জন্য কাজে যেতে পারছেন না। আর কাজে গেলে ওষুধ খাওয়া সম্ভব হচ্ছে না।’’ সংসারের একমাত্র রোজগেরে হওয়ায় চিকিৎসার মাঝপথে বাবলুদের হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। বেলগাছিয়ার বাসিন্দা আমিনার প্রসঙ্গ টেনে এক চিকিৎসক বলেন, ‘‘১৬ বছরের কিশোরী ওষুধ খেয়ে সুস্থ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ছ’মাস বাদে আবার সংক্রমণ শুরু হয়। কিছু দিন আগে আমিনার মৃত্যু হয়েছে। একটি ঘরে আমিনারা ১৯ জন থাকত! ফল যা হওয়ার, তা-ই হয়েছে।’’
আরও পড়ুন: দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
স্বাস্থ্য দফতরের যুগ্ম অধিকর্তা তথা রাজ্য যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক ব্রজকিশোর সাহার অভিজ্ঞতা, অনেক রোগী কিছু দিন ওষুধ চলার পরে তাঁদের মনে হয়, ভাল হয়ে গিয়েছেন। রোজগারের কথা ভেবে সেন্টারে আসতে চান না। সেই জন্য রোগীর বাড়ির কাছাকাছি থাকেন, এমন কাউকে সংশ্লিষ্ট রোগীর দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। তা সত্ত্বেও যে ‘লস্ট টু ফলো আপ’ আটকানো যাচ্ছে না, তা স্বীকার করে নিচ্ছেন ব্রজবাবু। তিনি বলেন, ‘‘সব স্তরের মানুষের মধ্যে সচেতনতা প্রয়োজন। তাঁরা যদি রোগীকে ওষুধ খাওয়ার জন্য চাপ তৈরি করেন, তা হলে উপকার হয়।’’ চিকিৎসকদের আক্ষেপ, সারা বছরে যক্ষ্মায় মৃতের সংখ্যা বেশি হলেও ডেঙ্গি-ম্যালেরিয়ার মতো বছরভর সচেতনতা প্রচারে রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখা যায় না। ‘‘সচেতনতা বাড়াতে দলছুটদের সমস্যার কথা মাথায় রেখে সরকারি কর্মসূচির রূপরেখা তৈরি করা জরুরি,’’ বলছেন ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চের প্রাক্তন অধ্যাপক ডেনি জন।
চিকিৎসকদের মতে, আগের তুলনায় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণের কর্মসূচি গতি পেয়েছে। তবে রাজ্যে যক্ষ্মারোগীদের চিকিৎসার জন্য পৃথক আইসিইউ প্রয়োজন। যক্ষ্মারোগী চিহ্নিতকরণে বেসরকারি স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে সক্রিয়তার অভাব রয়েছে বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য দফতরের আধিকারিকেরা। ব্রজবাবু জানান, গত বছর রাজ্যে এক লক্ষ তিন হাজার যক্ষ্মারোগী চিহ্নিত করা হয়েছে। তার মধ্যে বেসরকারি স্তরে চিহ্নিত করা হয় মাত্র ১৪ হাজার রোগীকে। ‘‘এখানে ফাঁক বিস্তর। যক্ষ্মারোগীদের তথ্য দেওয়ার জন্য বেসরকারি স্তরে আবেদন করেও ফল হচ্ছে না,’’ বলেন ব্রজবাবু। আন্তর্জাতিক জার্নাল ‘ল্যান্সেট’-এর রিপোর্টও বলছে, বেসরকারি স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে যক্ষ্মার চিকিৎসার মানোন্নয়ন প্রয়োজন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy