Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
Crime

গরুপাচারের রুটে এখন ইয়াবা-র রমরমা, মাদক করিডরে কলকাতাই প্রাণকেন্দ্র

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছরের মে মাসে দেশ জুড়ে মাদক বিরোধী কঠোর অভিযানের নির্দেশ দেন।

বাংলাদেশ-মায়ানমার সীমান্তে টেকনাফে চলছে মাদক বিরোধী অভিযান। ছবি: এএফপি।

বাংলাদেশ-মায়ানমার সীমান্তে টেকনাফে চলছে মাদক বিরোধী অভিযান। ছবি: এএফপি।

সিজার মণ্ডল
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ জানুয়ারি ২০১৯ ২১:০১
Share: Save:

এ যেন একের সর্বনাশ, অন্যের পৌষমাস! মাদকবিরোধী টানা অভিযানে নাভিশ্বাস উঠছে বাংলাদেশের মাদক কারবারিদের, আর সেই অভিযানের দৌলতেই মোটা টাকা কামিয়ে লাল হয়ে যাচ্ছে এ রাজ্যের পাচারকারীরা। সৌজন্যে ইয়াবা

ছোট ছোট গোলাপি রঙের ট্যাবলেট। দেখলে মনে হবে লজেন্স। এক হাজার ট্যাবলেটের ওজন ১০০ গ্রামেরও কম! লুঙ্গির খুঁট হোক বা প্যান্টের পকেট— অনায়াসেই সেঁধিয়ে যায় এ রকম কয়েক হাজার ট্যাবলেট। আর সেই ট্যাবলেট পৌঁছে দিতে পারলেই মোটা মুনাফা। ওই মাদক ট্যাবলেট অর্থাৎ ইয়াবা পাচার করিডরের মূল কেন্দ্র এখন কলকাতা। সেখান থেকে উত্তর ২৪ পরগনা এবংনদিয়া হয়ে লাখে লাখে নিষিদ্ধ ইয়াবা ট্যাবলেট চলে যাচ্ছে পড়শি বাংলাদেশে।

গত কয়েকমাসে বদলে গিয়েছে বাংলাদেশ সীমান্তে চোরা চালানের সমীকরণ। গরু ছেড়ে এখন সীমান্তের বাঘা চোরা চালানকারীরা ঝুঁকছেন ইয়াবা পাচারের দিকে। গত মে মাস থেকে গোটা বাংলাদেশ জুড়ে চলা মাদক বিরোধী পুলিশি অভিযানই ভাগ্য বদলে দিয়েছে এখানকার কারবারীদের, এমনটাই দাবি সীমান্ত এলাকার ব্যবসায়ীদের। এ দেশের গোয়েন্দারাও স্বীকার করে নিচ্ছেন সে কথা।

বাংলাদেশ পুলিশের হাতে বাজেয়াপ্ত মাদক। ছবি: রয়টার্স।

আরও পড়ুন: বকেয়া ডিএ চলতি মাসেই, বললেন মুখ্যমন্ত্রী, প্রতারণামূলক ঘোষণা, বলছে কর্মী সংগঠনগুলি​

গোটা পূর্ব এশিয়ায় মধ্যে বাংলাদেশেই ইয়াবা মাদকের সবচেয়ে বড় বাজার। মেটামেম্ফাটাইন এবং ক্যাফেইনের মিশ্রণে তৈরি এই মাদকের প্রচলন শুরু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। তখন সেনাদের দেওয়া হত ওই মাদক। পরবর্তীতে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার তাইল্যান্ড, মায়ানমার,লাওস, কম্বোডিয়াতে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ওই মাদক। তাই ভাষায় ইয়াবার অর্থ ‘পাগল করা ওষুধ’। এই শতকের শুরুর দিক থেকে বাংলাদেশে বিশাল বাজার খুঁজে পায় ইয়াবা।

বাংলাদেশের মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, গোটা দেশে প্রায় ৭০ লাখ মাদকাসক্তের মধ্যে ৫০ লাখই ইয়াবা আসক্ত। যদিও ওই দেশের বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের দাবি, ইয়াবা আসক্তের সংখ্যা আরও কয়েক গুণ বেশি। বাংলাদেশ পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে সে দেশে আমদানি করা হয়েছিল প্রায় ৩০ কোটি ইয়াবা ট্যাবলেট! আর পুরোটাই আমদানি হত মায়ানমার থেকে। কয়েক হাজার কোটি টাকার ব্যাবসা।

র‌্যাবের অভিযানে উদ্ধার হওয়া ইয়াবা ট্যাবলেট। ছবি: এপি।

কিন্তু সেই পাচারের রুটটাই এখন বদলে গিয়েছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছরের মে মাসে দেশ জুড়ে মাদক বিরোধী কঠোর অভিযানের নির্দেশ দেন। বাংলাদেশ পুলিশের দাবি, টানা অভিযানে প্রায় ২৫ হাজার দাগী এবং সন্দেহভাজন মাদক কারবারিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে মারা গিয়েছে কয়েক জন কুখ্যাত মাদক কারবারি। যদিও ঢাকার একাধিক মানবাধিকার সংগঠনের দাবি, সংঘর্ষে মৃতের সংখ্যা দু’শোরও বেশি।গত অগস্ট মাস থেকে বাংলাদেশের এই মাদক বিরোধী অভিযানে একের পর এক সন্দেহভাজন মাদক কারবারির মৃত্যু নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে একাধিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে এর পর অভিযানে কিছুটা ভাটা পড়লেও তত দিনে বদলে গিয়েছে বাংলাদেশে ইয়াবা আমদানির সমস্ত রুট।

কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার এক আধিকারিক জানাচ্ছেন, প্রথম কয়েক মাস টানা পুলিশি অভিযানে ব্যবসায় কিছুটা মন্দা দেখা দিলেও চোরা কারবারিরা দ্রুত বিকল্প রুট এবং পাচারকারীদের নয়া নেটওয়ার্ক তৈরি করে নেয়। দু’দেশের মধ্যে গোয়েন্দা তথ্য আদান প্রদানের সঙ্গে যুক্ত এক আধিকারিক বলেন,“ঢাকার মহম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্প এলাকার ইস্তিয়াক আহমেদ বা করাইল বস্তির বাবা কাসেমের মতো কুখ্যাত মাদক কারবারিরা কয়েকশোকোটি টাকার মালিক। তাদের মতো বড় মাথারা গোড়াতেই গা-ঢাকা দিয়েছে। কেউ কেউ পালিয়ে এ দেশে লুকিয়ে আছে। ধরা পড়েছে মূলত নিচুতলার পাচারকারীরা। ফেরার মাদক মাফিয়ারা তাই দ্রুত নতুন রুট তৈরি করে নেয়।”

কলকাতায় নার্কোটিক কন্ট্রোল ব্যুরোর হাতে উদ্ধার ইয়াবা।—নিজস্ব চিত্র।

গোয়েন্দাদের দাবি, আগে মায়ানমার থেকে সরাসরি নাফ নদি পেরিয়ে টেকনাফ দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকত ইয়াবা। কিন্তু, ধরপাকড়ের পর প্রথমে দু’টি বিকল্প রুট তৈরি হয়। এ নিয়ে ভারতীয় গোয়েন্দাদের বেশ কিছু তথ্য দিয়েছে বাংলাদেশের র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। সেই তথ্য অনুসারে, বিকল্প রুটের প্রথমটি ছিল মায়ানমার থেকে মিজোরাম হয়ে সিলেটের জকিগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশ। অন্যটি ছিল বাংলাদেশের পটুয়াখালি, কুয়াকাটা হয়ে নদীপথে ঢাকা। কিন্তু, র‌্যাব কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সেই রুটের হদিশ পাওয়ায় এবার পুরো রুটটাই ঘুরিয়ে দিয়েছে পাচারকারীরা।

এ দেশের নার্কোটিক কন্ট্রোল ব্যুরো (এনসিবি)-র গোয়েন্দাদের দাবি, এখন মায়ানমার থেকে মণিপুর-মিজোরাম হয়ে সড়ক পথে কলকাতায় চলে আসছে লাখে লাখে ইয়াবা ট্যাবলেট। তারপর কলকাতা এবং সংলগ্ন উত্তর ২৪ পরগনার বিভিন্ন এলাকায় জমা করে রাখা হয় সেই মাদক। প্রথম দিকে বাংলাদেশ থেকে কেরিয়ার এসে নিয়ে যেত ট্যাবলেট। এ রকমই একটি গ্যাং-কে সম্প্রতিকলকাতার বেনিয়াপুকুর থেকে পাকড়াও করে কলকাতা পুলিশের স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ)। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের দাবি, এখন উত্তর ২৪ পরগনা এবং নদিয়ার গরু পাচারের করিডর ধরেই প্রতি দিন পাচার হচ্ছে লাখ লাখ টাকার ইয়াবা।

বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে চলছে মাদক বিরোধী অভিযান। ছবি: এএফপি।

আরও পড়ুন: মোদীর সভার আগেই দু’বার বাংলায় আসছেন অমিত শাহ, জরুরি বৈঠক ডাকলেন দিলীপ​

বসিরহাটের কাছে ঘোজাডাঙা সীমান্তের এক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আগে যারা মূলত গরু এবং অস্ত্র পাচারের সঙ্গে যুক্ত ছিল, তারাই এখন ইয়াবা পাচার করছে। কারণ গরু বা অস্ত্র পাচারের থেকে ইয়াবায় ঝামেলা কম। এবং টাকাও বেশি।” সূত্রের খবর, এক দম নিচুতলার পাচারকারীরা প্রতি হাজার ইয়াবা ট্যাবলেট পাচার করে আয় করে সাত থেকে আট হাজার টাকা। ধরপাকড়ের আগে বাংলাদেশে এক একটি ইয়াবা ট্যাবলেটের দাম ছিল ৩০০ টাকা। এখন সেটাই বিকোচ্ছে৫০০ টাকায়। তাই কেরিয়ারদের পেছনে দরাজহস্ত মাদক কারবারিরা। নিয়োগ হচ্ছে নতুন নতুন কেরিয়ার।

উত্তর ২৪ পরগনার ঘোজাডাঙা, পেট্রাপোল, ঝাউডাঙা, এবং নদিয়া জেলার একাধিক সীমান্তবর্তী গ্রাম দিয়ে ওপারে যাচ্ছে ইয়াবা। শুধু নিচুতলা নয়, নিরাপদে ইয়াবা মজুত করছেন অনেক বড় ব্যবসায়ীও। এক লাখ ট্যাবলেট এক সপ্তাহ রেখে দিলেই মিলছে তিন লাখ! আর সেই মোটা মুনাফার লোভে দলে দলে যোগ দিচ্ছে ইয়াবা ব্যবসায়। কলকাতাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠছে মাদক পাচারের নয়া করিডর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Crime Drugs War Against Drugs Bangladesh Yaba
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE