Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

তাক করা রাইফেলের নল, আমি জঙ্গি!

কখনও তাড়া করে বাইকবাহিনী। কখনও ছিনতাইবাজের মারধর। তার মাঝেও চলে সবুজের জন্য অভিযান। সাইকেল সফরকারী মলয়কুমার পাত্রের কথা শুনলেন আরিফ ইকবাল খানকখনও তাড়া করে বাইকবাহিনী। কখনও ছিনতাইবাজের মারধর। তার মাঝেও চলে সবুজের জন্য অভিযান। সাইকেল সফরকারী মলয়কুমার পাত্রের কথা শুনলেন আরিফ ইকবাল খান

সফর: নেপালের দূরগাঁওয়ে মলয়। নিজস্ব চিত্র

সফর: নেপালের দূরগাঁওয়ে মলয়। নিজস্ব চিত্র

শেষ আপডেট: ২৭ মে ২০১৮ ০২:০৮
Share: Save:

একে ফর্টি সেভেনের নলটা তাক করা তাঁর দিকে। সাইকেলের হ্যান্ডেল ধরা হাতটা অজান্তেই কেঁপে যাবে সেই নলের দিকে তাকালে। ভাগ্য ভাল আগ্নেয়াস্ত্রধারীরা কোনও জঙ্গি নন। তাঁরা মহারাষ্ট্রের পুলিশ। উল্টে পুলিশেরা তাঁকেই জঙ্গি ঠাউরেছেন।

সাইকেল নিয়ে ভারত সফরের গল্প বলছিলেন মলয়কুমার পাত্র। হলদিয়ার সুতাহাটার গুয়াবেড়া গ্রামের মলয়। স্থানীয় কলেজে ভূগোলের প্রথম বর্ষের ছাত্র। তাঁর অন্য পরিচয় তিনি ‘দু’চাকায় দুনিয়া’ দেখতে ভালবাসেন। সে দেখা অবশ্য উদ্দেশ্যমূলক। সবুজের অভিযান। নানা দূষণের প্রকোপে পড়া দুনিয়াকে বাঁচাতে যে আরও গাছের প্রয়োজন সেটাই প্রচার করে বেড়িয়েছেন সারা ভারত জুড়ে। গিয়েছেন নেপাল এবং ভুটানেও। মলয়ের ‘মিশন গ্রিন’ অভিযানের অভিজ্ঞতা তাঁর ব্যাগপ্যাক ভরে দিয়েছে।

জঙ্গি সন্দেহে পুলিশের হাতে গ্রেফতারের ঘটনা মহারাষ্ট্রের কুডাল জেলার। গত বছরে। সেই সময় মহারাষ্ট্রের একটি আধাশহরে সাইকেল নিয়ে ঘুরছেন। বাংলাদেশি জঙ্গি ঢোকার খবর ছিল মহারাষ্ট্র পুলিশের কাছে। কয়েকজন সন্দেহভাজন আটকও হয়েছিল। কোনও পরিচয়পত্র ছিল না তাঁর কাছে। ফলে পুলিশ আর দু’চাকায় সবুজের অভিযানের কথায় বিশ্বাস রাখতে পারছিল না। ধৃত এক সন্দেহভাজনের মুখোমুখি বসানো হয়। সে-ও বাঙালি। তবে সিলেটের। দুই বাংলার বেশ তফাৎ। দুই সন্দেহভাজনের আলোচনা শুনতে হাজির পুলিশের উচ্চ পদাধিকারীরাও। সেই জঙ্গিই আধিকারিকদের জানালেন, মলয় বাংলাদেশি নন। কিন্তু তাতেও নিস্তার নেই। মলয়কে তাঁর থানা এবং এলাকার কথা বলতে হয়। গুগলে খোঁজ চলে। মলয় এক পুলিশ কর্মীর মোবাইল নিয়ে থানার ফ্রি ওয়াইফাই ব্যবহার করে হোয়াটসঅ্যাপে খবর দেন সুতাহাটা থানায়। সুতাহাটা থানা থেকে যোগাযোগ করা হয় মহারাষ্ট্র পুলিশের সঙ্গে। মুক্তি মেলে।

মলয় বলছিলেন, ‘‘আমাকে তুলে নিয়ে এসেছিলেন এক মহিলা আইপিএস অফিসার। তাঁর নাম ঠিক মনে নেই। আমি যখন থানা থেকে বেরিয়ে আসছি, ডাক পড়ল। তিনি আমার হাতে একটি মিষ্টির প্যাকেট দিয়ে বললেন, নিজের মিশন চালিয়ে যাবে। হাল ছাড়বে না।’’ পুলিশ অফিসারের উৎসাহ তখন আর মাথাতে ছিল না। এমন হেনস্থায় হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। অভিযান স্থগিত রেখে ফিরে আসার চিন্তাও করেছিলেন। এক পুলিশকর্মী তাঁকে ৪০ কিলোমিটার দূরে ফেলে রাখা সাইকেলের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। তখন অনেক রাত।

সন্দেহের ফেরে আরেকবার পড়েছিলেন মলয়। সেটা নেপালে। চলতি বছরেরই মার্চ মাস সেটা। সারাদিন সাইকেল চালিয়ে সন্ধ্যার আগে কোনও থানা বা গ্রামে পৌঁছনোর চেষ্টা করতেন তিনি। ভরতপুর থেকে অনেকটা ভেতরের একটা গ্রামে ঢুকেছেন। গ্রাম বলতে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামের মতো নয়। রাস্তা নেই যে তা দিনের বেলায় বেশ মালুম হয়েছে। আশেপাশে কোনও থানা না পাওয়ায় গ্রামে। খুবই দরিদ্র গ্রাম। পরে জানা গিয়েছিল, এই গ্রামে ভূমিকম্পে অনেকেই মারা গিয়েছিলেন। কেউ আশ্রয় দিতে চাননি। এদিকে প্রবল ঠান্ডায় রাতে আশ্রয় না পেলেও সমস্যা। বাসিন্দারা তল্লাশি চালালেন। কাগজপত্র আর খান দুই ডায়েরি আর কিছু জামা কাপড় মেলায় রেহাই দেওয়া হল। খিদেয় মলয়ের পেট জ্বলছে। অনেকেই দেখতে চলে এসেছিলেন। তাঁদের মলয় জানান, দূষণমুক্ত পৃথিবী তাঁর লক্ষ্য। আর কোনও উদ্দেশ্য নেই।

উদ্ধার পেয়েছিলেন নাটকীয়ভাবে। বাসিন্দাদের একজন জানালেন, তাঁদের গ্রামের এক বাসিন্দা বাংলায় নিরাপত্তারক্ষীর কাজ করতেন। সেই বাবুলাল ছেত্রী বাংলা জানেন। বাবুলাল এসে কথা বলে নিশ্চিন্ত হওয়ায় রাতের খাওয়া ও আশ্রয় মিলল। বাবুলাল বেশ কিছুদিন কলকাতায় নিরাপত্তারক্ষীর কাজ করেছিলেন। পরে পরিবারের কাছে ফিরে আসেন। মলয় বললেন, ‘‘মেঝেয় বিছানা পাতা। কেউ মশারি ব্যবহার করেন না। আমি মশারি টাঙিয়ে ঘুম দিয়েছিলাম। মাঝ রাতে প্রচণ্ড ঠান্ডায় ঘুম ভেঙে যায়।’’ মলয়ের নেপাল ভাল লেগে যায়। তাঁর কথায়, ‘‘দেশের পরিকাঠামো হয়তো উন্নত নয়। কিন্তু মানুষজন পরোপোকারী। মেয়েরা খুব পরিশ্রমী। চড়াই উৎরাই পেরিয়ে মেয়েরা মাইলের পর মাইল বুনো লতাপাতা বয়ে নিয়ে যান।’’ তিনি বকসোল, পাটনাই, পোখরা, দেবগাঁও-সহ নানা গ্রামে গিয়েছেন। নেপালে রাস্তায় জল খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। এক পরিবার আশ্রয় দিয়েছিলেন। চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ করে তুলেছিলেন। কাঠমান্ডু শহরে আতিথেয়তা পেয়েছেন পুলিশের কাছে।

ভুটানে ফুন্টশোলিং দিয়েই তিনি ভুটান সফর শুরু করেন। ছবির মত সুন্দর ভুটানের পাহাড়ি রাস্তায় মাঝে মাঝে রয়েছে জঙ্গল। আর ওই জঙ্গলে রয়েছে জন্তুও। জানতেন একা সাইকেল চালানো নিরাপদ নয়। তবে ভুটানে সাইকেল সফর মাঝপথেই থামিয়ে দিতে হয়। ভুটান পুলিশ জানায়, পথের বাঁকে বাঁকে বিপদ লুকিয়ে রয়েছে। তাছাড়া সে দেশে আর একটি নিয়ম রয়েছে, গিয়ার ছাড়া সাইকেল অভিযানে অনুমতি দেওয়া হয় না। মলয়ের সাইকেল গিয়ার ছিল না। তাই তাঁকে আর এগোতে দেওয়া হয়নি। কয়েকশো কিলোমিটার গিয়েই থেমে যায় ভুটান সফর।

একবার তো ছিনতাইবাজদের হাতে পড়েছিলেন। সেটা অবশ্য দেশে। হিমাচলপ্রদেশের একটি গ্রামের মধ্যে যাওয়ার সময় পাহাড়ি রাস্তায় ছিনতাইকারীরা ধরে। তারা মারধোর করে সব কিছু কেড়ে নিতে চেয়েছিল। মারধর আর তল্লাশি করেও কিছু না পাওয়ায় নির্যাতন আরও বেড়ে যায়। ব্যাগে ছিল একটা চোরা কুঠুরি। সেখানেই রাখা ছিল মোবাইল আর ১১০০ টাকা। টাকা তো বাঁচল। কিন্তু প্রাণ বাঁচবে কী করে! মলয় কাকুতি মিনতি শুরু করলেন। জানালেন তাঁর ক্যানসার হয়েছে। বেশদিন বাঁচবেন না। তাই দেশ দেখতে বেরিয়েছেন। তাতেই কাজ হয়। বন্ধ হয় নির্যাতন। ভয় কেটে যায়। ওই ছিনতাইবাজেরাই আবার ডেরায় নিয়ে গিয়ে রুটি তরকারি খাওয়ায়। রাতও কাটে সেখানে। কেরলের কোঝিকোড়ের কাছে আবার অন্য বিপদ। একদল বাইক আরোহী তাড়া করে মলয়কে। ধরেও ফেলে। কিন্তু সঙ্গে কিছু না পাওয়ায় তাঁকে ছেড়ে দেয়। গুজরাত সফরে মোবাইল উপহার পেয়েছিলেন।

দেশ তো দেখা হল। তাজমহল, স্বর্ণমন্দির, অক্ষরধাম, সাবরমতী আশ্রম। সুবজের অভিযান কি তবে থেমে গেল? মলয় জানিয়েছেন, নতুন উদ্যম শুরু হয়েছে। তিনি চিনের মান্দারিন ভাষা শিখতে চান। শিখতে চান পর্তুগিজ ভাষাও। যোগাভ্যাস করেন। জিমন্যাস্টিকেও দখল রয়েছে। হংকং সফরে গিয়ে মার্শাল আর্ট শেখার ইচ্ছে আছে। পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভাল নয়। কিন্তু দুনিয়া দেখার নেশা তাঁকে তাড়িয়ে ফেরে। তাছাড়া সবুজের জন্য অভিযান তো করতে হবে। প্রিয় এই নীল গ্রহটিকে কি বিবর্ণ হতে দেওয়া যায়!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE