Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

বাঘের ডেরায় আদিবাসীদের স্কুল খুলেছেন যুবক

কয়েক মাস পরে মুম্বইয়ে মিটিং-এর ফাঁকে শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মোবাইলে খবর আসে বাঘের আক্রমণে মারা গিয়েছেন বাচ্চু। বাচ্চুর স্ত্রী কাকলি ছিলেন নদীতে, নৌকার উপরে।

উৎসাহী: ‘বিদ্যাশ্রম’-এ পড়ুয়ারা। ছবি: রণজিৎ নন্দী

উৎসাহী: ‘বিদ্যাশ্রম’-এ পড়ুয়ারা। ছবি: রণজিৎ নন্দী

সুনন্দ ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ অক্টোবর ২০১৯ ০৬:১৪
Share: Save:

মশার কামড়ে ঘুম হচ্ছিল না। শহুরে জীবনে অভ্যস্ত শুভঙ্করের পাশে শতছিদ্র কম্বলমুড়ি দিয়ে বাচ্চু তখন গভীর ঘুমে। বিদ্যুৎহীন কুঁড়ের মেঝেয় নোংরা বিছানায়, প্রায় বেহুঁশ বাচ্চু। শরীর থেকে হাড়িয়ার গন্ধ বেরোচ্ছে। শহর থেকে আসা ‘বাবু’ ঘুমোতে পারছেন না বুঝতে পেরে বাচ্চু নিজের কম্বল তুলে দেন শুভঙ্করের গায়ে। মন ছুঁয়ে গিয়েছিল বহুজাতিক সংস্থার কর্মীর।

কয়েক মাস পরে মুম্বইয়ে মিটিং-এর ফাঁকে শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মোবাইলে খবর আসে বাঘের আক্রমণে মারা গিয়েছেন বাচ্চু। বাচ্চুর স্ত্রী কাকলি ছিলেন নদীতে, নৌকার উপরে। পাড়ে শিক দিয়ে ঠুকে ঠুকে কাঁকড়া তুলছিলেন বাচ্চু। সন্তর্পণে পিছনের জঙ্গল ফুঁড়ে ঘাড়ের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঘ। ছুটে এসেছিলেন কাকলি। গাছের ভাঙা ডাল নিয়ে কাকলির একার লড়াইয়ে বাচ্চুকে টেনে জঙ্গলে নিয়ে যেতে পারেনি বাঘ।

কিন্তু, প্রথম আক্রমণেই ঘাড় ভেঙে দিয়েছিল বাচ্চুর। সেটা ২০১৫ সালের ডিসেম্বর। সুন্দরবনের ‘জি-প্লট’- এর কাকলি ও পিতৃহীন দুই আদিবাসী শিশুর কথা ভেবে ঘুম ছুটে যায় শুভঙ্করের। ঠিক করেন আরামের জীবন ছেড়ে চলে যাবেন সুন্দরবন। শুধু তো ওই দু’টি শিশুই নয়, আরও অনেক বাচ্চাকে দেখে এসেছেন অপুষ্টি, অশিক্ষার শিকার হতে। দেখেছেন, মধু আনতে বাচ্চাকে পিঠে বেঁধে মায়েরা জঙ্গলে ঢোকার সময়ে বাচ্চার মুখে ঠুসে দেয় খৈনি। নেশায় ঘুমিয়ে থাকে বাচ্চা। জেগে থাকলে পাছে শিশুর কান্নার আওয়াজ যদি বাঘের কানে যায়।

দেখেছেন, দাওয়ায় বসে যুবক আধখাওয়া জ্বলন্ত বিড়ি এগিয়ে দিচ্ছেন মায়ের দিকে। মাঝে সাত বছরের ছেলেও দু’টান মেরে দিচ্ছে। শুভঙ্কর বুঝতে পারেন, শিক্ষা তো বহু দূর, সাধারণ ব্যবহারিক জীবন সম্পর্কেই ধ্যান-জ্ঞান নেই আদিবাসীদের।

ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট থেকে রাশিবিজ্ঞানের ডিপ্লোমা করা শুভঙ্করের গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে বেড়ানোর নেশা। পরিচিতেরা জানেন, আর দশটা সুখী জীবনের পিছনে ছোটেন না তিনি। ঘুরতে ঘুরতে এক দিন পৌঁছে যান সুন্দরবনের জি-প্লটে। আদিবাসীদের ভালোবেসে শুরু হয় সপ্তাহান্তে যাতায়াত। কাকলিদের দিয়ে নকল মালা তৈরি করিয়ে নিয়ে আসতে থাকেন কলকাতায়। কাকলিদের বলতেন, কলকাতায় বিক্রি করছেন সেই মালা। কিন্তু, আদতে নিজের ফ্ল্যাটে জমতো মালার স্তূপ।

শুভঙ্করের কথায়, ‘‘আমি বড়বাজার থেকে মালা তৈরির কাঁচামাল কিনে নিয়ে যেতাম। এ ভাবে কাকলিদের মনে স্বনির্ভরতার বিশ্বাস জন্মাতে শুরু করে। হাতে টাকা আসতে থাকায় অনেকেই উৎসাহ নিয়ে মালা তৈরি করতে শুরু করেন। পরে ১-২ টাকায় কলকাতার অটো-বাসচালকদের কাছে বিক্রি করে দিই।’’ কিন্তু, বাচ্চুর মৃত্যুর পরে ছেদ পড়ে সেই কাজে। পাকাপাকি ভাবে সেখানে থাকতে শুরু করেন শুভঙ্কর। তবে তার আগে অমরনাথের পথে ২০০ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে যাচাই করে দেখেন — সত্যিই ওই কষ্টের জীবনে মানিয়ে নিতে

পারবেন তো!

সুন্দরবনের আদিবাসী গ্রামে এখন ‘বিদ্যাশ্রম’ বানিয়েছেন শুভঙ্কর। সেখানে থাকে ২৪টি বাচ্চা। তাদের খাওয়া-পরা, প্রাথমিক পড়াশোনার দায়িত্ব শুভঙ্কর ও আরও কয়েক জন সহমর্মী মানুষের। এখন আশপাশের গ্রামের বাচ্চারাও আসে বিদ্যাশ্রমে। কলকাতা থেকে স্কাইপে আঁকা, নাচ শেখানোর কাজ চলছে। ৪০ বছরের ছেলের খেয়ালখুশি মেনে এখন মাঝেমধ্যেই সুন্দরবনে গিয়ে থাকেন শুভঙ্করের বাবা-মা। শুভঙ্করের কথা — ‘‘লড়াই এখন সামর্থ্যের সঙ্গে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Sundarbans School
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE