Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

এ বার ফিরহাদ, লক-আপ থেকেই ঘোষণা আসিফের

সারদা কেলেঙ্কারিতে রাজ্যের আর এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর জড়িত থাকার ইঙ্গিত মঙ্গলবারই দিয়েছিলেন সিবিআইয়ের তদন্তকারীরা। বুধবার সেই মন্ত্রীর নাম ফাঁস করলেন প্রাক্তন তৃণমূল নেতা আসিফ খান। আসানসোল এসিজেএম আদালতের কোর্ট লক-আপে দাঁড়িয়ে বললেন, “এ বার সিবিআইয়ের ডাক পাওয়ার পালা ববি (ফিরহাদ) হাকিমের।”

নিজস্ব সংবাদদাতা
আসানসোল ও কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:২৮
Share: Save:

সারদা কেলেঙ্কারিতে রাজ্যের আর এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর জড়িত থাকার ইঙ্গিত মঙ্গলবারই দিয়েছিলেন সিবিআইয়ের তদন্তকারীরা। বুধবার সেই মন্ত্রীর নাম ফাঁস করলেন প্রাক্তন তৃণমূল নেতা আসিফ খান। আসানসোল এসিজেএম আদালতের কোর্ট লক-আপে দাঁড়িয়ে বললেন, “এ বার সিবিআইয়ের ডাক পাওয়ার পালা ববি (ফিরহাদ) হাকিমের।”

প্রতারণার মামলায় গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে সারদা কেলেঙ্কারিতে পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র বা তৃণমূলের সর্বভারতীয় সম্পাদক মুকুল রায়ের জড়িত থাকার অভিযোগ তুলছিলেন আসিফ। খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও তিনি ‘ডাকাতরানি’ বলেছিলেন। এর মধ্যে মদন মিত্রকে সিবিআই গ্রেফতার করেছে। আপাতত তিনি জেলে বন্দি। মুকুলকেও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করা হয়েছে। এ দিন মুখ্যমন্ত্রীর একান্ত আস্থাভাজন পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের দিকে অভিযোগের আঙুল তুললেন আসিফ। মুকুলের পরে সিবিআই আর কাকে ডাকতে পারে, সাংবাদিকদের এই প্রশ্নের উত্তরে আসিফ এ দিন বলেন, “ববি। ববি হাকিম।” কেন? আসিফের ব্যাখ্যা, “কলম ও আজাদহিন্দ পত্রিকা চালানোর দায়িত্ব তো ববিই পেয়েছিল।”

সিবিআই এবং ইডি সূত্রেরও খবর, রাজ্যের এক মন্ত্রী একদা সারদার অধীনে থাকা ‘কলম’ পত্রিকায় মাসিক ১৫ লক্ষ টাকা জোগাতেন। তা নিয়ে খোঁজ শুরু হয়েছে। ওই মন্ত্রীর নাম-পরিচয় এখনও প্রকাশ করতে চাইছেন না সিবিআইয়ের তদন্তকারীরা। তবে আসিফের মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে খোদ ফিরহাদ এ দিন বলেছেন, “দেশের দুর্ভাগ্য যে, সিবিআই এখন আসিফ খানের কথায় চলছে!”

সারদা কেলেঙ্কারি নিয়ে আসিফকে বেশ কয়েক বার জিজ্ঞাসাবাদ করেছে সিবিআই। তদন্তকারীদের সূত্রে খবর, তিনি অনেক তথ্যও দিয়েছেন। গোয়েন্দাদের সাহায্য করার কথা স্বীকার করেছেন আসিফ নিজেও। ঘটনাচক্রে, সিবিআই-কে সাহায্য করার কথা বলা এবং নিজের বাড়িতে সাংবাদিক বৈঠক ডেকে তৃণমূল থেকে ইস্তফা দেওয়ার পরেই আসিফের বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা নিয়ে সক্রিয় হয় রাজ্য পুলিশ। অভিযোগ ওঠে, সারদা-কাণ্ডে তৃণমূল নেতাদের নামে সিবিআই-কে তথ্য দেওয়ার পরেই আসিফের নামে একের পর এক প্রতারণার মামলা দায়ের করাতে পুলিশ সক্রিয় হয়। শেষ পর্যন্ত গ্রেফতারও করা হয় তাঁকে। বাড়িতে তল্লাশির সময়ে পুলিশকে বাধা দেওয়ার অভিযোগেও মামলা দায়ের করা হয় আসিফের নামে।

আসানসোল পুলিশ সূত্রের খবর, গত ২৯ ডিসেম্বর আসানসোল এসিজেএম আদালতে জয়গোবিন্দ যাদব নামে এক ব্যক্তি আসিফের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ দায়ের করেন। তার ভিত্তিতেই এ দিন আসিফকে আদালতে হাজির করানো হয়। আদালত চত্বরে সাংবাদিক দেখলেই আসিফ যে মুখ খুলতে পারেন, তা আগেই আঁচ করেছিল পুলিশ। তাই আসানসোল কমিশনারেটের কয়েক জন এডিসিপি-র নেতৃত্বে বিরাট বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছিল। বেলা সওয়া ১১টা নাগাদ একটি কালো রঙের প্রিজন ভ্যানে চাপিয়ে আসিফকে আদালতে নিয়ে আসা হয়। সামনে-পিছনে ছিল দু’টো পুলিশের জিপ। ভ্যান থেকে আসিফ নামার আগেই আদালত চত্বরে হাজির থাকা পুলিশকর্মীরা সমস্বরে ‘হা-রে-রে-রে’ করে চিৎকার শুরু করেন। সঙ্গে চলে গাড়ির গায়ে ধাঁই-ধপাধপ চাপড়ও। বেগতিক দেখে আসিফ ওই সময়ে কিছু বলার চেষ্টা করেননি।

আসিফকে মুখ খুলতে না-দিয়ে কিছুটা স্বস্তি পেয়েছিল পুলিশ। বেলা ২টো ১০-এ আসিফকে নিয়ে যাওয়া হয় কোর্ট লক-আপে। জালে ঘেরা কুঠুরিতে আসিফকে ঢুকিয়ে চারপাশে ঘিরে থাকেন পুলিশ অফিসারেরা। কিন্তু আদালতে পুলিশ চেঁচাতে পারবে না, তা ভালই জানতেন আসিফ।তাই বিচারক এজলাসে আসার আগে কুঠুরির কাছে পেন-নোটপ্যাড হাতে সাংবাদিক দেখেই হাতজোড় করে ‘নমস্কার’ জানান তিনি। হাবেভাবেই বুঝিয়ে দেন কথা বলতে চান। শুধু প্রশ্নের অপেক্ষা।

তখনই জানতে চাওয়া হয় এ বার কার পালা? এবং ববির নাম করেন আসিফ।

সবিস্তার দেখতে ক্লিক করুন।

আসিফ মুখ খুলেছেন টের পেয়েই সক্রিয় হয়ে ওঠে পুলিশ। তাঁকে কথা বলতে বারণ করা হয়। সরে যেতে বলা হয় সাংবাদিকদেরও। কিন্তু মুচকি হেসে আসিফ চোখের ইশারায় সাংবাদিকদের লোহার গ্রিলের কুঠুরির ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকতে বলেন। তার পরেই বদলে ফেললেন মুখ খোলার ছক! কখনও পুলিশ, কখনও আইনজীবীদের সঙ্গে খোশগল্পের ছলে বলতে থাকেন, “সিঙ্গাপুরে তো মুকুলের ছেলের একটা হোটেল আছে। মুকুলকে ২০ তারিখের মধ্যেই গ্রেফতার করবে সিবিআই। আমি তো ১২১ জনের নাম দিয়েছি সিবিআই-কে।” আসিফের অভিযোগ সম্পর্কে মকুল-পুত্র শুভ্রাংশু রায়কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “যদি সিঙ্গাপুরে হোটেল থাকত, তবে তো ব্যবসা চালাতে সেখানে যেতে হতো। আমি জীবনে কখনও সিঙ্গাপুর যাইনি। তা হলে সেখানে আমার ব্যবসা থাকবে কী করে?”

কিন্তু আসিফ এ দিন বোমা ফাটানোয় স্বাভাবিক ভাবেই অস্বস্তিতে পড়েছে পুলিশ। তবে তাদের একাংশ আবার এ-ও বলছেন যে, শাসক দল যত আসিফকে মামলায় জেরবার করতে চাইবে, ততই তৃণমূল নেতাদের গোপন কথা উগরে দেবেন তিনি। বস্তুত, আসানসোলে মামলা দায়ের করা জয়গোবিন্দ যাদবও রানিগঞ্জের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল নেতা বলে পরিচিত। তাঁর অভিযোগ, ২০১০-এ রাজ্য সরকারে চতুর্থ শ্রেণির কর্মীর চাকরি পাইয়ে দেওয়ার নাম করে আসিফ তাঁর কাছ থেকে দেড় লক্ষ টাকা নিয়েছিলেন। আসিফ নিজেকে তখন তৃণমূল সংখ্যালঘু সেলের চেয়ারম্যান বলে পরিচয় দিয়েছিলেন বলেও জয়গোবিন্দর অভিযোগ।

আসিফের আইনজীবী লোকেশ শর্মা এ দিন দাবি করেন, “আসিফকে সরকার ভয় পাচ্ছে বলেই মিথ্যে মামলায় ফাঁসাচ্ছে। ২০১০ সালে তৃণমূল ক্ষমতাতেই ছিল না। তখন চাকরির প্রতিশ্রুতি দেওয়ার প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে? পুলিশ এই মামলায় কোনও নথিই পেশ করতে পারেনি।” দু’পক্ষের শুনানি শেষে আসানসোল আদালতের এসিজেএম অনিরুদ্ধ মাইতি আসিফকে তিন দিনের পুলিশি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।

বিচারকের নির্দেশ শুনে দৃশ্যত অবশ্য অখুশি হননি আসিফ। বলেন, “আমি তো বেরোতে চাইছি না। এখানে ঠিক আছি। দেখছেন তো, ওরাও ঢুকছে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE