কৌশিক রায়চৌধুরী। নিজস্ব চিত্র।
দিন তিনেক আগে বন্ধুর ছেলেকে বলেছিলেন, “তোকে শেষ কথা বলছি। কোন যন্ত্রণা থেকে জীবনানন্দ পাতার পর পাতা লিখতেন, আবার কেটেও দিতেন, তা বোঝার বয়স তোর হয়নি।” আর শুক্রবার রাতে জীবনের শেষ অঙ্ক নিজের হাতেই লিখে চলে গেলেন নাট্যকার, নাট্যপরিচালক, কবি, প্রাবন্ধিক, চিত্রশিল্পী ও অধ্যাপক কৌশিক রায়চৌধুরী (৫০)।
বহরমপুর শহরের ইন্দ্রপ্রস্থ এলাকায় নিজের বাড়ি থেকে নাট্যকারের ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার করে পুলিশ। প্রাথমিক তদন্তের পর পুলিশের অনুমান তিনি আত্মহত্যা করেছেন।
বহরমপুরে কৌশিকবাবুর মৃত্যু এ দিন কলকাতার নাট্যজগতে তাঁর সুহৃদদেরও নাড়া দিয়ে গিয়েছে। রাতেই খবরটা পেয়েছিলেন অভিনেতা দেবশঙ্কর চট্টোপাধ্যায়। দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় কলকাতার সংস্ৃতি-র প্রযোজনা ‘ইয়ে’ নাটকে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন দেবশঙ্কর। কৌশিকের মৃত্যুতে ইয়ের মতো দুর্লভ নাটক আর সহজে মিলবে না বলে এ দিন দুপুরেই আক্ষেপ করছিলেন দেবেশ ও দেবশঙ্কর। সন্ধ্যায় কোন্নগরের নান্দীকারের শোয়ে নাচনী নাটকটির মঞ্চায়ন ঘটে। শো শেষে রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত নিজে দর্শকদরে তাঁদের এই স্বজন-বিয়োগের কথা বলেন।
দেবশঙ্কর আনন্দবাজারকে বলেন, “অসম্ভব গুণী ছিল কৌশিক। তা ছাড়াও, এ আমার ব্যক্তিগত ক্ষতি। ওকে চিনি বহরমপুরে মামার বাড়িতে যাতায়াতের সূত্রে। পরে বন্ধুত্ব গাঢ় হয় ও কলকাতায় এমএ পড়তে আসার পরে।”
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় বিও ও এমএদু’টোতেই প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন কৌশিক। প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনা শুরু করে পরে দার্জিলিং গভর্নমেন্ট কলেজ ও বারাসত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে যান। এখন তিনি কলকাতার গোয়েনকা কলেজে পড়াতেন। কিন্তু বছর খানেক ধরে তিনি পড়াতে যাচ্ছিলেন না। কৌশিক যখন একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র, তখন থেকেই বহরমপুরের অধুনালুপ্ত সাহিত্যগোষ্ঠী রৌরব-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। লেখালেখির সেই শুরু। বন্ধুরা মিলে চলচ্চিত্র বিষয়ক পত্রিকা ‘সিনেমা ভাবনা’ সম্পাদনা শুরু করেন ওই সময়ে। তাঁর প্রথম নাটক ‘মা অভয়া’ মঞ্চস্থ করে বহরমপুরের ‘যুগাগ্নি’। কলকাতার ‘সংসৃতি’-র ইয়ের মঞ্চায়ন ছাড়া ‘নান্দীকার’ও কৌশিকের লেখা ‘নগর কীর্তন’ মঞ্চস্থ করে। বহরমপুরের ‘ঋত্বিক’ তাঁর ‘জাগরণ পালা’ এবং ‘কঙ্কাল’ অভিনয় করে। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তের ‘নান্দীকার’ এবং বহরমপুরের ‘ঋত্বিক’-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কৌশিক। কর্মসূত্রে স্ত্রীর সঙ্গে কলকাতায় থাকলেও, গত দুর্গাপুজোর আগে থেকে তিনি বহরমপুরের বাড়িতে একাই থাকছিলেন।
শুক্রবার সকালে বন্ধু স্কুল শিক্ষক শুভ সেনের কাছে তাঁর একটি ফোন কল আসে। ছোটবেলা থেকে ঘনিষ্ঠ ওই বন্ধুকে কৌশিক বলেন, “আজকে স্কুল থেকে ফিরে আমার ফ্ল্যাটে অবশ্যই আসবি। দরজা খোলা থাকবে।” রাত ৯টা নাগাদ তিনিই প্রথম ওই বাড়িতে গিয়ে গলায় শাড়ির ফাঁস দেওয়া বন্ধুর ঝুলন্ত দেহ দেখতে পান। বিছানার উপর সাদা কাগজে তাঁরই আঁকার তুলিতে লেখা, “নিজের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা আর অকর্মন্যতায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে আমি আমার মৃত্যু বেছে নিলাম। এ সিদ্ধান্ত আমারই। আর কেউ কোনও ভাবে দায়ী নন।...যাঁরা আমাকে ভালবাসতেন ও বাসেন, তাঁরা মার্জনা করবেন।”
শুভবাবু এ দিন বলেন, “ও হতাশায় ভুগত। আক্ষেপ করে বলত, নাট্যকারকে বুঝি নিজের নাটকের দলও তৈরি করতে হয়। না হলে হয় তা মঞ্চস্থ হয় না। অথবা অন্যেরা তা নিজের নামে চালায়।” শুভবাবু জানান, প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে আইনি ভাবে সম্পর্ক ছিন্ন হলেও সেই বিচ্ছেদ তিনি মেনে নিতে পারেননি। ওই যন্ত্রণাও তাঁর ভিতরে ছিল। শনিবার বিকেলে ময়না-তদন্তের পর তাঁর দেহ প্রথমে নিয়ে আসা হয় বহরমপুর রবীন্দ্র সদনে, পরে যুগাগ্নি ও ঋত্বিকের মহলা কক্ষে। তিন জায়গাতেই মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন স্তরের সাংস্কৃতিক কর্মীরা এসে শ্রদ্ধা জানান। পরে খাগড়া শ্মশানঘাটে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy