Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

জমির পর কয়লা, ফের ধাক্কা কাটোয়ার

বিশ্ববঙ্গ সম্মেলনের মঞ্চ থেকে রাজ্যে লগ্নির ভবিষ্যৎ হিসেবে কাটোয়া তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের কথা ঢাকঢোল পিটিয়ে বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই সগর্ব ঘোষণার পরে তেরাত্তিরও কাটেনি, ধাক্কা খেলো প্রকল্প গড়ার কাজ। টেন্ডার-জট আর কয়লা কাঁটা কাটোয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশ খানিকটা প্রশ্ন তুলে দিয়েছে বলেই সংশ্লিষ্ট মহলের মত। তাঁদের বক্তব্য, এই ধরনের প্রকল্পের কাজে এক বার ঢিলেমি এসে গেলে তা কাটিয়ে গতি ফেরানো খুবই মুশকিল। ঠিক যেমন লেট করা ট্রেন। তাকে দাঁড় করিয়ে রেখে সবুজ সঙ্কেত দিয়ে দেওয়া হয় অন্য ট্রেনকে।

প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখছেন এনটিপিসি-র চেয়ারম্যান অরূপ রায়চৌধুরী। ছবি: অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়।

প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখছেন এনটিপিসি-র চেয়ারম্যান অরূপ রায়চৌধুরী। ছবি: অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়।

পিনাকী বন্দ্যোপাধ্যায় ও সৌমেন দত্ত
কাটোয়া শেষ আপডেট: ১১ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:১৭
Share: Save:

বিশ্ববঙ্গ সম্মেলনের মঞ্চ থেকে রাজ্যে লগ্নির ভবিষ্যৎ হিসেবে কাটোয়া তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের কথা ঢাকঢোল পিটিয়ে বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই সগর্ব ঘোষণার পরে তেরাত্তিরও কাটেনি, ধাক্কা খেলো প্রকল্প গড়ার কাজ। টেন্ডার-জট আর কয়লা কাঁটা কাটোয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশ খানিকটা প্রশ্ন তুলে দিয়েছে বলেই সংশ্লিষ্ট মহলের মত। তাঁদের বক্তব্য, এই ধরনের প্রকল্পের কাজে এক বার ঢিলেমি এসে গেলে তা কাটিয়ে গতি ফেরানো খুবই মুশকিল। ঠিক যেমন লেট করা ট্রেন। তাকে দাঁড় করিয়ে রেখে সবুজ সঙ্কেত দিয়ে দেওয়া হয় অন্য ট্রেনকে।

বিশ্ববঙ্গ সম্মেলনে রাজ্যের শিল্প পরিস্থিতির কথা বলতে গিয়ে ১২ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রসঙ্গ বিশেষ ভাবে তুলে ধরেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তখনও জানা ছিল, পরের পর বিভিন্ন বাধা পেরিয়ে প্রস্তাবিত এই প্রকল্পের কাজ শুরু হবে ২০১৪ সালের শেষ নাগাদ। কিন্তু শনিবার বর্ধমানের কাটোয়ায় এসে ওই কেন্দ্রীয় সংস্থার চেয়ারম্যান অরূপ রায়চৌধুরী জানালেন, কিছু সমস্যার জন্য নির্মাণের কাজ পিছিয়ে দিতে হচ্ছে। এবং আগামী সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের আগে ওই প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার কোনও আশা নেই।

তৃণমূল সরকার জমি অধিগ্রহণ না করার নীতিতে গোঁ ধরে থাকায় প্রকল্পটি জমিজটে ফেঁসে থেকেছে দীর্ঘ সময় ধরে। এমনকী চাষিরা জমি বিক্রির ব্যাপারে লিখিত সম্মতি দিলেও পুরো জমি এখনও সংস্থার হাতে আসেনি। এনটিপিসি সূত্রের খবর, জমির পরে এখন কাজ আটকেছে কয়লার জটে। কাটোয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা কোথা থেকে মিলবে, এনটিপিসি এখনও সে ব্যাপারে অন্ধকারে। কয়লার সংস্থান না হওয়া ইস্তক তারা কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রকের কাছেও আবেদন করতে পারছে না। কয়লা নিয়ে এই সমস্যার মূলেও তৃণমূল সরকারের জমি নীতি।

এনটিপিসি সূত্রে জানা গিয়েছে, বাম আমলেই এই প্রকল্পে কয়লা জোগানোর জন্য আসানসোলের কাছে দামাগোড়িয়া পূর্ব খনিটি রাজ্যকে দিয়েছিল কেন্দ্রীয় কয়লা মন্ত্রক। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে জমি অধিগ্রহণ এড়াতে সেটি ফিরিয়ে দেয়। সম্প্রতি বীরভূমের মহম্মদবাজার ব্লকে দেউচা পাঁচামি কয়লা খনি রাজ্যকে দিয়েছে কেন্দ্র। এ বার সেখান থেকেই কাটোয়া প্রকল্পের জন্য কয়লা দিতে চায় রাজ্য। বিশ্ববঙ্গ সম্মেলনে ওই খনি প্রকল্প নিয়ে চুক্তিও হয়েছে। কিন্তু কয়লা মন্ত্রকের তরফে এখনও এ বিষয়ে ছাড়পত্র মেলেনি। ফলে কয়লার জোগান নিয়ে এখনও অনিশ্চিত এনটিপিসি। অরূপবাবুর আশা, এই সমস্যা দ্রুত মিটে যাবে।

অরূপবাবু জানিয়েছেন, গোল বেধেছে নির্মাণ সংস্থা নিয়েও। এর আগে নির্মাণের বরাত পেয়েছিল দক্ষিণ কোরিয়ার সংস্থা দুসান। অরূপবাবু বলেন, “যে দরপত্র ডেকে নির্মাণ সংস্থা বাছাই করা হয়েছিল, তা বাতিল করা হয়েছে। নতুন করে আবার দরপত্র ডাকা হবে।”

গত বছর ১৪ জুন প্রথম বার কাজের অগ্রগতি দেখার জন্য কাটোয়ায় এসেছিলেন এনটিপিসি-র চেয়ারম্যান। ছ’মাস পরে এসে এ দিন প্রথমেই শাঁখাইঘাটে গিয়ে ভাগীরথী থেকে কী ভাবে প্রকল্পে জল যাবে তার খোঁজখবর নেন তিনি। ভাগীরথী থেকে প্রকল্প এলাকার দূরত্ব আট কিলোমিটার। পাইপলাইনের বদলে সেচখাল কেটে জল নিয়ে যাওয়া যায় কি না বা অজয়ে কোথায় সেতু হবে, বেলা সাড়ে ১১টা থেকে ঘণ্টা দুয়েক ধরে সব তিনি ঘুরে দেখেন। পরে সংস্থার দফতরে ফিরে তিনি অতিরিক্ত জেলাশাসক (ভূমি ও ভূমি সংস্কার), কাটোয়া মহকুমাশাসক এবং সংস্থার আধিকারিকদের নিয়ে বৈঠকও করেন।

কয়লা ছাড়া আর যে বিষয়ে এখনও কিছুটা জট আছে, সেই জমির প্রসঙ্গও ফের উঠেছে। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরেই এনটিপিসি বারবার জানিয়েছিল, বাম আমলে অধিগৃহীত জমির বাইরেও ২০০-২৫০ একর জমি তাদের লাগবে, তা না হলে ১৩২০ মেগাওয়াটের ওই প্রকল্প করা কার্যত অসম্ভব। এই নিয়ে জলঘোলায় প্রকল্প যখন গুটিয়ে যাওয়ার জোগাড়, গত ফেব্রুয়ারিতে মমতা ঘোষণা করেন, সরকারের বিভিন্ন দফতরের হাতে থাকা প্রায় ১০০ একর জমি এই প্রকল্পের জন্য দেওয়া হবে। এর পরেই বাকি প্রায় ১৫০ একর জমি সরাসরি মালিকদের কাছ থেকে কিনতে রাজি হয় এনটিপিসি। সেই মতো স্থানীয় চাষিদের থেকে প্রথমে ‘সম্মতিপত্র’ নেওয়া হয়, পরে বেশ কিছু চাষির সঙ্গে চুক্তিও করে সংস্থাটি।

তার পরেও কেন এনটিপিসি জমি কিনতে নামছে না, এ দিন তা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন চাষিরা। তাঁদের বক্তব্য, ২০০৫ সাল থেকে কার্যত কোনও বাধা ছাড়াই ৫৫৬ একর জমি অধিগ্রহণ করেছিল বিগত বাম সরকার। এনটিপিসিকে বাড়তি জমি দেওয়ার জন্য তাঁরা মুখিয়ে রয়েছেন। কিন্তু বিষয়টি এগোচ্ছে না। এনটিপিসি সূত্রের খবর, সংস্থার পরিচালন পর্ষদ এখনও বাড়তি জমি কেনার ব্যাপারে অনুমোদন দেয়নি। তবে অরূপবাবু বলেন, “জমির দাম নির্ধারণ হয়ে গিয়েছে। কী ভাবে জমি রেজিস্ট্রি হবে, সে বিষয়ে চাষিরা সম্মতি দিয়েছেন। সরকারের সঙ্গেও আলোচনা চলছে। বিষয়টি মিটে গেলেই আমরা জমি কিনতে শুরু করব।”

কাটোয়ায় কিছু জটিলতা থাকলেও মুর্শিদাবাদের ফরাক্কায় এনটিপিসি-র তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রে ৬০০ মেগাওয়াটের সপ্তম ইউনিট গড়তে যে সমস্যা নেই, তা অবশ্য অরূপবাবু আগেই জানিয়ে দিয়েছেন। বৃহস্পতিবার সেখানকার কর্মীদের প্রস্তাব মেনে তিনি বলেন, “এখানে সংস্থার উদ্বৃত্ত জমি আছে। ঝাড়খণ্ড ছাড়াও জলপথে জিন্দল গোষ্ঠীর সাহায্যে কয়লা পাওয়ার সমস্যা নেই। ফিডার ক্যানাল দিয়ে জল পাওয়াও সহজ। সপ্তম ইউনিট গড়ার ব্যাপারে যত দ্রুত সম্ভব সমীক্ষার কাজ শেষ করা হবে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

NTPC katwa pinaki bandyopadhyay soumen dutta
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE