ঝাঁ-চকচকে ঘর। ভিতরে আলো-আঁধারি পরিবেশ। দেওয়ালে বড় বড় স্ক্রিন জুড়ে ভ্রমণ বিজ্ঞাপন। সোফায় বসে এক ব্যক্তি। সামনের সেন্টার টেবিলে ঠান্ডা পানীয়ের গ্লাস। ওই ব্যক্তির পাশে বসেই তাঁকে বন্ধুবৎসল সুরে ‘দেখব এ বার জগৎটাকে’ মার্কা আকাশকুসুম স্বপ্ন দেখাচ্ছেন স্যুট পরা এক যুবক। এক-একটি বাক্যের পরেই মোটা টাকার বিনিময়ে ওই ভ্রমণ সংস্থার সদস্য হতে পীড়াপীড়ি করছেন তিনি।
প্রস্তাব শুনে সন্দেহ হয়েছিল ওই ব্যক্তির। তিনিও পাল্টা প্রশ্ন জুড়ে দেন। বেগতিক দেখে ওই ব্যক্তিকে সদস্য না-করেই ছেড়ে দিতে বাধ্য হন যুবক। মানুষটি সচেতন বলেই রেহাই পেলেন। সমস্যা হল, পায়ের তলায় সর্ষে নিয়ে ঘুরতে ভালবাসেন, এমন অনেকেই তাঁর মতো সচেতনতার প্রমাণ দিতে পারেন না ঠিক সময়ে। পরিণামে পর্যটন-প্রতারকদের ফাঁদে পা দিয়ে নাস্তানাবুদ হন।
সম্প্রতি ‘কান্ট্রি ভ্যাকেশনস’ নামে একটি সংস্থার বিরুদ্ধেও এমন অভিযোগ উঠেছে। ক্রেতা সুরক্ষা দফতরে জমা পড়েছে শ’খানেক অভিযোগ। সেই খবর আনন্দবাজারে প্রকাশিত হওয়ার পরেই অভিযোগ নিয়ে পুলিশ-ক্রেতা সুরক্ষা দফতরে যোগাযোগ করছেন অনেকে। সেই সূত্রেই ঘনিষ্ঠ মহলে স্মৃতি উগরে দিয়েছেন ওই ব্যক্তি। যিনি পেশায় লালবাজারের দুঁদে অফিসার! তিনি গিয়েছিলেন ‘কান্ট্রিক্লাব’ নামে এক ভ্রমণ সংস্থার তপসিয়ার অফিসে। ‘কান্ট্রি ভ্যাকেশন’ নামে সংস্থাটিও ওয়েবসাইটে নিজেদের কান্ট্রিক্লাব সংস্থার শাখা বলেই দাবি করেছে। এমনকী তাদের অফিসও তপসিয়ায়!
পুলিশের একাংশ বলছেন, এই ধরনের সংস্থা এমন ভাবে লোক ঠকায় যে, অনেক বাঘা বাঘা মানুষও সেই ফাঁদ এড়াতে পারেন না। অনেকে প্রতারিত হয়েও পুলিশে জানান না। পুলিশের দাবি, অভিযোগের অভাবেই সে-ভাবে ব্যবস্থা নিতে পারে না তারা। যদিও অভিযুক্তদের একাংশের অভিযোগ, পুলিশে জানালেও অনেক সময়েই কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।
কেমন ফাঁদ পাতে ওই সব সংস্থা?
পুলিশি সূত্রের খবর, লটারির টোপ দিয়ে প্রথমে অফিসে ডেকে পাঠায় সংস্থাগুলি। তার আগেই অবশ্য ফোনে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মাসিক আয়, সম্পত্তির পরিমাণ, বেড়াতে যাওয়ার মানসিকতা জেনে নেওয়া হয়। এক গোয়েন্দা অফিসারের কথায়, “শিকার ধরার সেটাই প্রথম ধাপ। ওই সব তথ্য দিয়েই বুঝে নেওয়া হয়, মানুষটি ভ্রমণ সংস্থার কাছে সহজ শিকার কি না!”
লালবাজার সূত্রের খবর, ভ্রমণ সংস্থাগুলির অফিসে নানা ধরনের গ্রাহকের জন্য নানা ব্যবস্থা থাকে। সহজ শিকারদের নিয়ে বসানো হয় ঝাঁ-চকচকে ঘরে। আলো-আঁধারি পরিবেশে আকাশকুসুম স্বপ্ন দেখিয়ে সদস্যপদ দেওয়া হয়। কখনও বলা হয়, এই রাজ্যেই বড় ক্লাব তৈরি করা হচ্ছে। কখনও আবার বেড়াতে নিয়ে গিয়ে পাঁচতারা রিসর্টে রাখার প্রস্তাব দেওয়া হয়! এক গোয়েন্দা বললেন, “বড় স্ক্রিনে জমকালো বিজ্ঞাপন আর আকাশকুসুম প্রস্তাব শুনে অনেকেই কাগজে সই করে দেন। কী লেখা আছে, আলো-আঁধারিতে সেটা ভাল করে পড়তেও পারেন না।”
আর ‘শিকার’ যদি নরম না হয়? সে-ক্ষেত্রে চেয়ার-টেবিলে বসিয়েই কথা সারা হয়। চা-নরম পানীয় দূরের কথা, এক গ্লাস জলও সাধা হয় না!
পুলিশের কথায়, এক বার ওই ধরনের সংস্থার সদস্যপদ নিলেই শুরু হয় আসল খেলা। বেড়ানোর ক্ষেত্রে হাজারো অজুহাত লেগেই আছে। তার উপরে নানা কারণ দেখিয়ে বাড়তি টাকা চাওয়া হয় হামেশাই। কী রকম? এক পুলিশকর্তা বলেন, “কোনও সদস্য হয় তো কালিম্পং যেতে চান। সংস্থা তাঁকে উটি নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেবে! ট্রেন বা বিমানের ভাড়া জোগাতে হবে ওই সদস্যকেই।”
ওই সব প্রতারক সংস্থার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না কেন?
পুলিশের দাবি, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীরা পুলিশের কাছে অভিযোগ করেন না। এর আগে কান্ট্রিক্লাব বা কান্ট্রি ভ্যাকেশন সংস্থার নামে দু’-একটি অভিযোগ এসেছিল। তদন্ত শুরু হওয়ার পরেই ওই সংস্থা অভিযোগকারীর টাকা ফিরিয়ে দিয়ে মিটমাট করে নেয়। লালবাজারের এক কর্তার কথায়, “খুন-ডাকাতির মতো এমন অপরাধে সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার করা যায় না। সেই সুযোগটাকেই কাজে লাগায় সংস্থাগুলি।”
কান্ট্রি ভ্যাকেশন নিয়ে অবশ্য বিধাননগর (দক্ষিণ) থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন এক দম্পতি। তদন্তও শুরু করেছে পুলিশ। বিধাননগর কমিশনারেট সূত্রের খবর, ওই দম্পতির বাড়ি গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছে।
বিধাননগরের গোয়েন্দাপ্রধান কঙ্করপ্রসাদ বারুই জানান, তদন্ত শুরু হয়েছে। প্রতারিতদের বয়ান নেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে নতুন একটি এফআইআরও দায়ের করা হতে পারে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy