দিল্লির হাসপাতালের ভর্তি হওয়ার আগের দিন শুনেছিলেন, রডোডেনড্রনে কুঁড়ি আসতে শুরু করেছে। শুনে হাসি ফুটেছিল তাঁর মুখে। কিন্তু ফুল ফোটার আগেই চলে গেলেন দার্জিলিঙের বর্ণময় ব্যক্তিত্ব, সুবাস ঘিসিঙ্গ। বৃহস্পতিবার বিকেলে দিল্লির স্যার গঙ্গারাম হাসপাতালে জিএনএলএফ প্রধান ঘিসিঙ্গের মৃত্যু হয়। বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর। তাঁকে ঘিরে নানা বিতর্ক, তবু মৃত্যুর খবরে শোকের ছায়া নামে পাহাড়, সমতলে। ফুসফুসের সংক্রমণের জেরে তাঁর মৃত্যু হয়েছে।
প্রায় এক দশক ধরে ফুসফুস ও যকৃতের রোগে ভুগছিলেন সুবাস ঘিসিঙ্গ। এত দিন নিজস্ব কবিরাজি টোটকা চালিয়েছেন। বিশ্বাস ছিল, ওতেই সেরে উঠবেন। ঠিক যেমন পাহাড় থেকে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পরেও নিশ্চিত ছিলেন, ফের পাহাড়ের ‘রাজা’ হবেন। তার দিশা খুঁজতে কখনও বারাণসী, কখনও শিলং, আবার কখনও হিমাচলপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ডে নির্জন বাস করেছেন। কখনও দলের একান্ত অনুগতদের মোবাইলে বার্তা পাঠিয়ে তৈরি হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। আবার ক’দিন পরেই ‘ধীরে চলা’র পরামর্শ পাঠিয়েছেন। দোলাচলে থেকেও অনুগামীরা বিশ্বাস করেছেন, কোনও ম্যাজিক করবেন ঘিসিঙ্গ। যেমন করেছিলেন ২০০৪-এ, লোকসভা ভোটের আগে। গোটা পাহাড় তাঁর বিরুদ্ধে এককাট্টা হয়ে দাওয়া নরবুলাকে প্রার্থী করেছিল। কোণঠাসা ঘিসিঙ্গ এ বার কী করবেন এই প্রশ্নই তখন ঘুরছিল পাহাড়ে। ভোটের সাত দিন আগে দাওয়াকে সমর্থন করার কথা জানান ঘিসিঙ্গ। এই চালে হাওয়া ফের ঘুরে যায় তাঁর দিকে।
বারবার এমন চমকে দেওয়া পদক্ষেপ যিনি করেছেন, বৃহস্পতিবার তিনি মারা গেলেন হঠাৎই। যে খবর পেয়ে তাঁর দীর্ঘদিনের অনুগামী ইন্দ্রনারায়ণ প্রধান কান্নায় ভেঙে পড়ে বললেন, “জাদুকরই চলে গেলেন, আর কীসের ভরসা?”
জাদুবল না থাকুক, ঘিসিঙ্গের সম্মোহনী ক্ষমতা যেন সহজাত। মিরিকের প্রত্যন্ত এলাকায় মানজু চা বাগানে ১৯৩৬ সালের ২২ জুন জন্ম। সাত ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন ষষ্ঠ। দার্জিলিঙের সেন্ট রবার্ট হাইস্কুলের নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় বাবা মারা যান। তার পর স্কুল ছেড়ে সেনাবাহিনী। সেখান থেকে বেরিয়ে বছরখানেক শিক্ষকতা। তার পর কলেজ। কলেজে পড়ার সময় বারবার কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে সরব হন ঘিসিঙ্গ। শেষে দার্জিলিং সরকারি কলেজে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময়ে রাজনৈতিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে গ্রেফতার হন ঘিসিঙ্গ।
সালটা ১৯৬৮। ‘নীল (নেপালি ভাষায় নীলো) ঝান্ডা’ দল গড়ে পাহাড়ে আলাদা রাজ্যের দাবিতে প্রচারে নামেন। হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালার মতো তাঁর ডাকে কাতারে-কাতারে মানুষ সাড়া দেন। ১৯৮০ সালে গড়েন গোর্খা ন্যাশেনাল লিবারেশন ফ্রন্ট (জিএনএলএফ)। শুরু হয় পৃথক রাজ্যের আন্দোলন। ১৯৮৬ সালে তা তুঙ্গে ওঠে। আন্দোলনকারীরা হাতে অস্ত্র তুলে নেয় বলে অভিযোগ। একের পর এক চা বাগান বন্ধ হয়। সংঘর্ষে অন্তত ১২০০ জনের মৃত্যু হয়। আত্মগোপন করেন ঘিসিঙ্গ।
দু’বছরের সশস্ত্র আন্দোলনের পরে ১৯৮৮ সালে রাজ্য এবং কেন্দ্র দার্জিলিঙের জন্য একটি আংশিক স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা গঠনের ঘোষণা করেন। পৃথক গোর্খাল্যান্ডের দাবি ছেড়ে ত্রিপাক্ষিক চুক্তি সই করে সেই দার্জিলিং গোর্খা হিল কাউন্সিলে যোগ দেয় জিএনএলএফ। চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন ঘিসিঙ্গ। টানা ২০ বছর কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি।
এই দু’দশকে রাস্তা তৈরি থেকে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার কাজ করেন ঘিসিঙ্গ। কিন্তু ঘিসিঙ্গের নিত্যনতুন ফতোয়ায় পাহাড়বাসী ক্লান্ত হতে শুরু করেন শেষে। কখনও বাঁদরপুজো, কখনও পাথরপুজোর ফরমান। আবার কখনও ঘোষণা করেন, পাহাড় রডোড্রেনডনে ছেয়ে দেওয়া হবে।
এর মধ্যে ষষ্ঠ তফসিল নিয়ে দলের অন্দরেই ক্ষোভ দানা বাঁধে। ২০০১ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি দিল্লি থেকে আলোচনা সেরে দার্জিলিং ফেরার পথে ঘিসিঙ্গের কনভয়ে হামলা হয়। তাঁর নিরাপত্তা রক্ষী এবং চালকের মৃত্যু হয়। পালিয়ে বাঁচেন ঘিসিঙ্গ। ২০০৭ সালে ষষ্ঠ তফসিলের বিল ঠান্ডা ঘরে পাঠিয়ে দেয় সংসদীয় কমিটি। সেই বছরেই ‘বিদ্রোহ’ ঘোষণা করেন ঘিসিঙ্গের হাতে গড়া বিমল গুরুঙ্গ। তৈরি হয় গুরুঙ্গের গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা। তাতে সামিল হন পাহাড়ের সিংহভাগ মানুষ। ২০০৮ সালে কাউন্সিলের চেয়ারম্যান পদ থেকে ইস্তফা দেন ঘিসিঙ্গ। পাহাড় ছেড়ে জলপাইগুড়িতে বাড়ি ভাড়া করে থাকতে শুরু করেন তিনি। প্রায় তিন বছর পাহাড়ে ঢুকতেই পারেননি।
জিটিএ গঠনের পরে ইদানীং পাহাড়ে থাকছিলেন। কিন্তু, অসুস্থতার কারণে বেশির ভাগ সময়েই থাকতেন হরিয়ানা, দিল্লিতে। ঘটনাচক্রে, বৃহস্পতিবার ঘিসিঙ্গের মৃত্যুর দিন দিল্লিতে আছেন গুরুঙ্গও। যত বিরোধই থাকুক, ‘গুরুকে’ শ্রদ্ধা জানিয়েছেন গুরুঙ্গ। বলেছেন, “পাহাড়ের জন্য উনি যা করেছেন, তা চিরকাল মনে রাখব। ওঁর মৃত্যু পাহাড়ে একটা বড় শূন্যস্থান তৈরি হল। যা পূরণ হওয়ার নয়।”
‘শত্রু’র মৃত্যু হয়তো প্রতিদ্বন্দ্বীকে উদার হতে শেখায়। গুরু ঘিসিঙ্গ কিন্তু জীবদ্দশায় ‘শিষ্যের’ প্রতি বরাবরই উদারতা দেখিয়েছেন। একান্ত আলোচনায় নানা সময়ে প্রশ্ন করলেও গুরুঙ্গের বিরুদ্ধে একটি কটূ কথাও উচ্চারণ করেননি। তিনি বলতেন, “আমার সেরা শিষ্য। প্রকৃত গুরু কখনও শিষ্যের বিরুদ্ধে কটূ মন্তব্য করে না। আমি বিমলের বিরুদ্ধে কোনও মন্তব্য করতে পারব না।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy