রাজ্যের কৃষি দফতরে কিছু কর্মীর নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল সাত বছর আগে, বাম আমলে। অভিযোগের তির ছিল সেই জমানার কৃষি দফতরের একাধিক শীর্ষ কর্তার বিরুদ্ধে। এত দিন পরে সেই ঘটনায় পুলিশের কাছে নালিশ ঠুকে মামলা দায়ের করল ওই দফতরই।
লালবাজার সূত্রের খবর, নিয়োগ-দুর্নীতি নিয়ে রাজ্যের কৃষিসচিব সুব্রত বিশ্বাস গত সপ্তাহে হেয়ার স্ট্রিট থানায় এফআইআর করেছেন। তাতে মূলত কৃষি দফতরের দুই প্রাক্তন অতিরিক্ত অধিকর্তা-সহ পূর্বতন চার কর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, প্রতারণা এবং অন্যান্য অভিযোগ আনা হয়েছে।
বামেদের হটিয়ে তৃণমূলের ক্ষমতা দখলের তিন বছর হয়ে গেল। ওই দুর্নীতির ব্যাপারে থানায় অভিযোগ জানাতে এত দিন লাগল কেন?
কৃষি দফতরের বক্তব্য, সিআইডি ওই দুর্নীতির তদন্ত করছে। সেই তদন্তে প্রাথমিক প্রমাণ মেলার পরে তবেই এফআইআর করার সিদ্ধান্ত হয়। আর কৃষিসচিব সুব্রতবাবু নিজে বলেন, “সিআইডি-র প্রাথমিক তদন্তের পরে স্বরাষ্ট্র দফতরের পরামর্শ মেনে তৎকালীন কৃষি দফতরের প্রাক্তন চার কর্তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে।” তিনি আরও জানান, কাদের নির্দেশ মেনে ওই চার কর্তা নিয়োগে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছিলেন, তা-ও দেখতে বলা হয়েছে পুলিশকে।
অভিযোগটা ঠিক কী?
কৃষি দফতরের খবর, ২০০৭ সালে কৃষি অধিকর্তার অফিসে লোয়ার ডিভিশন ক্লার্ক বা এলডিসি-র ৩৩১টি পদে নিয়োগের বিজ্ঞাপন বেরিয়েছিল। তার ভিত্তিতে একটি পরীক্ষাও হয়। অভিযোগ ওঠে, সেই পরীক্ষায় প্রায় ৩১ হাজার প্রার্থীর কাছে অ্যাডমিট কার্ডই পাঠানো হয়নি। নিয়ম ভেঙে তড়িঘড়ি পরীক্ষা কেন্দ্র বদলে দেওয়া হয়। এই ধরনের কিছু অভিযোগের ভিত্তিতে ২০০৮ সালে পরীক্ষা বাতিল করে দেয় তৎকালীন বাম সরকার। সেই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে কিছু পরীক্ষার্থী প্রথমে স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ট্রাইব্যুনাল বা রাজ্য প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল (স্যাট) এবং পরে কলকাতা হাইকোর্ট, তারও পরে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেন।
কৃষি দফতরের এক কর্তা জানান, সেই মামলায় ২০১২ সালে হাইকোর্টে এবং পরে, ২০১৩ সালে সর্বোচ্চ আদালতে হেরে যায় রাজ্য সরকার। ওই দফতর সূত্রের খবর, মামলা চলার সময় দফতরে কর্মী নিয়োগ সংক্রান্ত বিভিন্ন ফাইলপত্র পাওয়া যায়নি। আর তাতে রাজ্য সরকারের মুখ পুড়েছে বলে মনে করছেন কৃষি দফতরের বর্তমান আধিকারিকেরা। মহাকরণে কৃষি দফতরের একাংশ অভিযোগ করছেন, ফাইল লোপাটের পিছনে ওই দফতরের তৎকালীন কিছু শীর্ষ কর্তার বড় ভূমিকা ছিল। সেই জন্যই ২০১৩ সালে বর্তমান রাজ্য সরকার নিয়োগের ফাইল লোপাট এবং বাম আমলে কৃষি দফতরের কিছু কর্তার বিরুদ্ধে স্বজনপোষণের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে বলে সিআইডি-কে।
ভবানী ভবন জানাচ্ছে, সেই নির্দেশের ভিত্তিতে সিআইডি-র ডিএসপি পদমর্যাদার এক অফিসার বাম আমলে ওই নিয়োগ সংক্রান্ত দুর্নীতির প্রাথমিক তদন্ত শুরু করেন। মাসখানেক আগে পুরো বিষয়টি যাচাই করে কৃষি দফতরে একটি তদন্ত রিপোর্ট জমা দেয় সিআইডি।
কী আছে সেই রিপোর্টে?
পুলিশি সূত্রের খবর, রিপোর্টে সিআইডি জানিয়েছে, আবেদনপত্র ঝাড়াইবাছাই থেকে শুরু করে অ্যাডমিট কার্ড পাঠানো, পরীক্ষা কেন্দ্র বদল এবং উত্তরপত্র নিয়েও অনিয়ম হয়েছে। পরীক্ষা নিয়ামকের দায়িত্বে থাকা কৃষি দফতরের এক উচ্চপদস্থ কর্তা বিষয়টি জানা সত্ত্বেও কোনও ব্যবস্থা নেননি। ওই পরীক্ষায় চাকরি পাওয়া অনেকেই কৃষিকর্তাদের আত্মীয়পরিজন, বলছে সিআইডি।
ওই রিপোর্টেই সিআইডি দাবি করেছে, পরীক্ষায় সরকারের প্রায় দু’কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। পরীক্ষার আর্থিক হিসেব পরীক্ষা করলে তার প্রমাণ মিলবে। কিন্তু সেই সব নথিই নেই কৃষি দফতরে। সিআইডি-র অভিযোগ, কৃষি দফতরের চার কর্তা ওই সব ফাইলপত্র নষ্ট করে দিয়েছেন।
পুলিশ জানায়, হেয়ার স্ট্রিট থানায় অভিযোগপত্রের সঙ্গে সিআইডি-র রিপোর্টটিও জুড়ে দিয়েছেন কৃষিসচিব। তার ভিত্তিতেই কৃষি দফতরের তৎকালীন যুগ্মসচিব এ কে সামন্ত, তদানীন্তন কৃষি অধিকর্তার ব্যক্তিগত সহায়ক কল্যাণ সুর, কৃষি দফতরের তখনকার অতিরিক্ত অধিকর্তা (প্রশাসন) উদয়ন মজুমদার এবং দফতরের অতিরিক্ত অধিকর্তা (উত্তরবঙ্গ) সার্থক বর্মার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এঁদের মধ্যে উদয়নবাবু বর্তমানে অন্য একটি দুর্নীতির মামলায় সাসপেন্ড হয়ে আছেন। সার্থকবাবু অবসর নিয়েছেন। ওই চার কর্তা ছাড়াও আরও কয়েক জন এই দুর্নীতিতে জড়িত থাকতে পারেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে। পুলিশি সূত্রের খবর, এই ব্যাপারে তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী এবং অন্য কয়েক জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে।
লালবাজারের এক আধিকারিক জানান, কৃষি দফতরের অভিযোগের ভিত্তিতে মামলা শুরু হয়েছে। রাজ্য সরকার চাইলে সিআইডি-ই শেষ পর্যন্ত তদন্ত চালিয়ে যেতে পারে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy