Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

নবান্নের নির্দেশ, তবু পিজি ফেরাল মদনকে

ক’দিন আগেই বিস্তর টালবাহানার পরে হাসপাতাল ছেড়ে জেলে ফিরেছেন। ফের তিনি আসছেন রুটিন চেক আপ করাতে। তা নিয়ে চাপা একটা উত্তেজনা ছিলই। তার মধ্যেই এসএসকেএম কর্তাদের কাছে পৌঁছে গেল নবান্নের বার্তা, মন্ত্রীর শরীর খুব একটা ভাল নয়। প্রয়োজন মনে হলে তাঁকে যেন আবার ভর্তি করে নেওয়া হয়।

এসএসকেএম হাসপাতালে মন্ত্রী। শনিবার।  —নিজস্ব চিত্র।

এসএসকেএম হাসপাতালে মন্ত্রী। শনিবার। —নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:১৬
Share: Save:

ক’দিন আগেই বিস্তর টালবাহানার পরে হাসপাতাল ছেড়ে জেলে ফিরেছেন। ফের তিনি আসছেন রুটিন চেক আপ করাতে। তা নিয়ে চাপা একটা উত্তেজনা ছিলই। তার মধ্যেই এসএসকেএম কর্তাদের কাছে পৌঁছে গেল নবান্নের বার্তা, মন্ত্রীর শরীর খুব একটা ভাল নয়। প্রয়োজন মনে হলে তাঁকে যেন আবার ভর্তি করে নেওয়া হয়।

জেলবন্দি মন্ত্রী মদন মিত্রকে হাসপাতালে ভর্তি করে নেওয়ার সেই আর্জি (পড়ুন আদেশ) শেষ পর্যন্ত অবশ্য রাখেনি পিজি-র মেডিক্যাল বোর্ড। মন্ত্রীর চিকিৎসার জন্যই এই বোর্ড গড়া হয়েছে। শনিবার তারা ঘণ্টাখানেক ধরে মন্ত্রীর নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানিয়ে দেয়, উদ্বেগজনক কিছু মেলেনি। অতঃপর, ‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিতে দিতে সামনে-পিছনে পুলিশের কনভয় নিয়ে পুলিশেরই একটি এসইউভি-তে চেপে মন্ত্রী ফিরে গেলেন আলিপুর জেলে। জেলবন্দি মন্ত্রীকে বিধি ভেঙে নানা রকম বাড়তি সুবিধা দেওয়া হচ্ছে বলে বিরোধীরা যে অভিযোগ তুলেছেন, এ দিন সকালে নবান্নের ওই ফোনের পর তা আরও বে-আব্রু হয়ে গেল বলেই মনে করছেন অনেকে।

যদিও বিরোধীদের সব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন মন্ত্রী নিজেই। জেলবন্দি হলেও তাঁরই আর এক প্রাক্তন দলীয় সহকর্মী কুণাল ঘোষের মতো কথা বলতে গেলেই পুলিশি বাধা হজম করতে হচ্ছে না মদনবাবুকে। ফলে সংবাদমাধ্যমের সামনে তিনি অবাধেই নিজের মতামত জানাতে পারছেন। এ দিন সব অভিযোগ উড়িয়ে বিরোধীদের উদ্দেশে পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে মন্ত্রী বলেন, “সবর্দল কমিটি গড়ে সিবিআই-কে নিয়ে জেলের ভিতরে আসুন। দেখে যান, সত্যিই কী অবস্থায় আছি। মিথ্যে হলে নাকখত দিতে হবে সাধারণ মানুষের সামনে!”

গ্রেফতারের পরে সিবিআই হেফাজতের মেয়াদ কাটিয়ে গত ১৯ ডিসেম্বর আদালতের নির্দেশে প্রথম বার জেলে যান মদন। জেলে মাত্র ঘণ্টাখানেক কাটিয়ে ওই রাতেই (১৯ ডিসেম্বর) ‘বুকের ব্যথা’ নিয়ে পিজি হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। কিন্তু তাঁর চিকিৎসার জন্য তৈরি মেডিক্যাল বোর্ড বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেও মদনবাবুকে হাসপাতালে রেখে দেওয়ার মতো যুৎসই কোনও কারণ খুঁজে পাননি। ফলে গত ২৮ ডিসেম্বর, সকাল সাতটায় হাসপাতাল থেকে জেলে ফিরে যান মন্ত্রী। ডাক্তাররা তখনই জানিয়েছিলেন, ‘অসুস্থ’ মন্ত্রীকে মাঝে-মাঝে পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে আসতে হবে। শুক্রবারই তাঁকে চোদ্দ দিনের জেল হেফাজত দিয়েছেন বিচারক। এই প্রেক্ষিতে এ দিন সকালেই পিজি হাসপাতালে ‘রুটিন চেক-আপ’-এ যান মন্ত্রী।

এ দিন সকাল ১০টা ১০ মিনিটে এসএসকেএমের উডবার্ন ওয়ার্ডে ঢোকেন মদনবাবু। কলকাতা পুলিশের একটি কালো স্করপিও থেকে বেগুনি রঙের পাঞ্জাবি পরা মদন যখন নামছেন, তখন এক সাংবাদিক তাঁকে

জিজ্ঞেস করেন, “কেমন আছেন?” মদন বলেন, “বুকে ব্যথা আছে।” এ কথা বলেই উডবার্ন ওয়ার্ডে ঢুকে যান তিনি। এ দিন মন্ত্রী হাসপাতালে ঢোকার অনেক আগে থেকেই অবশ্য নাটক শুরু হয়ে গিয়েছিল। সরকারি ভাবে এসএসকেএম কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছেন, রুটিন চেক-আপের জন্যই মন্ত্রীকে হাসপাতালে আনা হয়েছিল। কিন্তু হাসপাতালেরই একটি সূত্রের খবর, মন্ত্রী এসএসকেএমে পৌঁছনোর কিছুক্ষণ আগে নবান্ন থেকে একটি ফোন আসে। বলা হয়, মন্ত্রীর শরীর খুব একটা ভাল নয়। প্রয়োজন মনে হলে তাঁকে যেন আবার ভর্তি করে নেওয়া হয়।

ফোনের কথা জানাজানি হতেই মন্ত্রীর জন্য গঠিত মেডিক্যাল বোর্ডের কয়েক জন সদস্য তাঁর ‘রুটিন চেক-আপ’-এর সময়ে হাজির থাকতে অস্বীকার করেন। কোনও চাপের মুখে নতিস্বীকার করে তাঁরা কোনও সিদ্ধান্ত নেবেন না বলেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেন। গত বারই পরিবহণমন্ত্রীকে হাসপাতালে রাখা নিয়ে বিতর্কের মুখে পড়তে হয় ওই ডাক্তারদের। মদনবাবুর জন্য তাঁদের সিবিআই জেরার মুখে পড়তে হতে পারে বলে জল্পনাও তৈরি হয়েছিল।

পিজি হাসপাতাল সূত্রে খবর, এ দিন মেডিক্যাল বোর্ড-এর একাধিক সদস্য কর্তৃপক্ষকে সাফ জানিয়ে দেন, মন্ত্রীকে ফের ভর্তির সিদ্ধান্ত নিতে হবে স্বাস্থ্যভবনের শীর্ষকর্তাদেরই। পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে দেখে কর্তৃপক্ষ শেষ পর্যন্ত চিকিৎসকদের জানান, কারও কথা শুনে কিছু করার দরকার নেই। তাঁরা মন্ত্রীর স্বাস্থ্যপরীক্ষা করে যেটা উচিত মনে হয়, সেটাই করবেন। সেই মতো ঘণ্টাখানেক ধরে মন্ত্রীর পরীক্ষা করে বোর্ড জানিয়ে দেয়, উদ্বেগজনক কিছু পাওয়া যায়নি। এসএসকেএমের অধ্যক্ষ প্রদীপ মিত্র অবশ্য বলেন, “গত বার মন্ত্রীকে ছাড়ার সময়েই সাত দিন পর পর চেক আপের কথা লিখেছিলেন চিকিৎসকেরা। তা না হলে ডায়বেটিস, হাইপারটেনশন বা শ্বাসকষ্টের মতো অসুখ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সেই মতো তাঁকে এ দিন আনা হয়েছিল। আমাদের ভর্তির কোনও পরিকল্পনা ছিল না।”

‘বুকের ব্যথা’ নিয়ে ফিরে গেলেও জেলে তিনি বাড়তি সুবিধা পাচ্ছেন বলে যে অভিযোগ উঠেছে, তা নিয়ে কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই মন্ত্রীর। বরং এই নিয়ে প্রশ্নের জবাবে একটি সবর্দল কমিটিকে জেল পরিদর্শন করার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন তিনি। হাসপাতালে ভর্তি থাকাকালীন মদনকে যেমন ‘রাজার হালে’ রাখা হয়েছিল, তেমনই জেলেও তাঁকে কারাবিধি ভেঙে বাড়তি সুবিধে দেওয়া হচ্ছে বলে শুক্রবারই আলিপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগার কর্তৃপক্ষকে চিঠি লিখে অভিযোগ করেছে সিবিআই। একই অভিযোগ তুলেছেন সারদা-কাণ্ডে আর এক অভিযুক্ত, সাসপেন্ড হওয়া তৃণমূল সাংসদ কুণাল ঘোষ।

অভিযোগ মূলত তিনটি। এক, মন্ত্রীর সাগরেদরা যখন-তখন জেলে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করছেন। দুই, মন্ত্রী জেল থেকে মোবাইলেও কথা বলছেন। তিন, মন্ত্রীকে জেল থেকে বার করা ও জেলে ফেরত আনার সময়ে প্রিজন ভ্যানে ওঠানো হচ্ছে না। মন্ত্রী চড়ছেন এসইউভি-তে। শনিবারও প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী রীতিমতো কটাক্ষের সুরে বলেন, “মন্ত্রী অবস্থায় মদন মিত্রকে জেলে ঢুকিয়ে মুখ্যমন্ত্রী রেকর্ড করেছেন। জেলে রয়েছেন, অথচ বাড়ির খাবার খাচ্ছেন! সব সরকারি ব্যাপার!”

যদিও কারা দফতরের দাবি, অন্য বন্দিদের মতোই মন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর পরিচিতদের দেখা করতে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বেআইনি পথে জেলে ঢোকা মোবাইল থেকে মন্ত্রী কথা বলেছেন, এমন অভিযোগ পাওয়া যায়নি। কোনও বন্দিকে জেল থেকে কোন গাড়িতে বার করা হবে, সেটা পুলিশের দেখার বিষয় বলে দাবি কারাকর্তাদের। লালবাজারের এক শীর্ষকর্তা বলেন, “নিয়ম হল, গাড়িতে বন্দিকে জেল থেকে বার করা ও ঢোকানোর কথা। সেটা প্রিজন ভ্যান-ই হতে হবে, তার কোনও কথা নেই।”

অভিযোগ নিয়ে মন্ত্রী নিজে কী বললেন?

বেলা সওয়া ১১টার একটু পরে উডবার্ন ওয়ার্ড থেকে বেরিয়ে পুলিশের গাড়িতে উঠতে যাচ্ছিলেন মন্ত্রী। সাংবাদিকেরা যাতে কাছে না ঘেঁষতে পারেন, সে জন্য পুলিশ ঘিরে রেখেছিল মন্ত্রীর পথ। তখন মদন নিজেই হাত নেড়ে এক আলোকচিত্রীকে ডাকেন। তিনি কাছে গেলে মদন বলতে শুরু করেন, “জেলের মধ্যে আমি সুযোগ পাচ্ছি, এটা যাঁরা যাঁরা বলছেন...।” এই সময়ে মদনকে পুলিশ গাড়ির দিকে নিয়ে যেতে উদ্যোগী হলে রীতিমতো খেপে ওঠেন মন্ত্রী। পুলিশদের ধমক দিয়ে বলে ওঠেন, “দাঁড়ান, দাঁড়ান। দাঁড়ান এক মিনিট।” পুলিশ তাঁর কথা বলার সময়ে বাধা দেওয়ায় মন্ত্রীর চোখেমুখে তখন বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। মন্ত্রীর ধমক ও মুখচোখের চেহারা দেখে পুলিশ পিছু হটে।

মদন তখন বলেন, “যাঁরা যাঁরা বলছেন, জেলে আমি বিশেষ সুবিধা পাচ্ছি, তাঁদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। সবর্দল কমিটি গড়ে সিবিআই-কে নিয়ে জেলের ভিতরে আসুন। দেখে যান, সত্যিই কী অবস্থায় আছি। মিথ্যে হলে নাকখত দিতে হবে সাধারণ মানুষের সামনে!” এর পরেই পুলিশের সঙ্গে গাড়িতে উঠে জেলে ফেরেন মদন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

madan mitra saradha scam cbi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE