Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

নবম শতকের উপবিষ্ট দেবীমূর্তির সন্ধান সাঁতুড়িতে

বহুভুজা এক দেবীর উপবিষ্ট মূর্তি পাওয়া গেল পুরুলিয়ার সাঁতুড়িতে। সাঁতুড়ি থানা এলাকাতেই বিশ্রামজোড় খালের ধারে সম্প্রতি খুঁজে পাওয়া গিয়েছে বিরল শঙ্খলিপিতে রচিত অষ্টম শতকের একটি শিলালেখ। তার কাছাকাছি এলাকা থেকেই যে দেবীমূর্তিটির খোঁজ মিলল, সেটিও অন্তত নবম শতকের বলে অনুমান করা হচ্ছে। ওই দেবীমূর্তির সঙ্গেই মিলেছে একটি বিষ্ণু মূর্তি এবং যোগাসনে উপবিষ্ট স্ফীতোদর একটি পুরুষ মূর্তিও। ওই দু’টি মূর্তিও অষ্টম-নবম শতকের বলে অনুমান করছেন পুরাতত্ত্ববিদেরা।

সেই বহুভুজা মূর্তি।—নিজস্ব চিত্র।

সেই বহুভুজা মূর্তি।—নিজস্ব চিত্র।

অলখ মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ অগস্ট ২০১৪ ০৩:৫৭
Share: Save:

বহুভুজা এক দেবীর উপবিষ্ট মূর্তি পাওয়া গেল পুরুলিয়ার সাঁতুড়িতে। সাঁতুড়ি থানা এলাকাতেই বিশ্রামজোড় খালের ধারে সম্প্রতি খুঁজে পাওয়া গিয়েছে বিরল শঙ্খলিপিতে রচিত অষ্টম শতকের একটি শিলালেখ। তার কাছাকাছি এলাকা থেকেই যে দেবীমূর্তিটির খোঁজ মিলল, সেটিও অন্তত নবম শতকের বলে অনুমান করা হচ্ছে। ওই দেবীমূর্তির সঙ্গেই মিলেছে একটি বিষ্ণু মূর্তি এবং যোগাসনে উপবিষ্ট স্ফীতোদর একটি পুরুষ মূর্তিও। ওই দু’টি মূর্তিও অষ্টম-নবম শতকের বলে অনুমান করছেন পুরাতত্ত্ববিদেরা।

ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের প্রাক্তন মহা অধিকর্তা তথা বিশ্বভারতীর পুরাতত্ত্বের অধ্যাপক গৌতম সেনগুপ্ত বলেন, “যে চালচিত্রর উপরে সিংহবাহিনীর মূর্তিটি উৎকীর্ণ রয়েছে, তার গঠনশৈলী দেখে অনুমান করছি এটি আদি পাল যুগের মূর্তি, হয়তো সামান্য আগেরও হতে পারে।” তাঁর কথায়, দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলার এই এলাকায় দশম শতকের পর থেকে একাধিক মূর্তি ও মন্দির পাওয়া গিয়েছে। তবে তার আগে নবম শতকের গোড়ার দিকের এই দেবীমূর্তির সন্ধান মেলায় এই এলাকা সম্পর্কে গভীর অনুসন্ধান শুরু করা দরকার। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক রজত সান্যাল জানান, যেখান থেকে এই মূর্তিগুলি পাওয়া গিয়েছে তার চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে পাথরের তৈরি প্রাচীন মন্দিরের ভগ্নাবশেষ। এই এলাকায় দশম থেকে ত্রয়োদশ শতকের মধ্যে জৈন সংস্কৃতির অনেক পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে। তিনি বলেন, “এ বার যে শিলালেখ, মূর্তি ও মন্দিরের নিদর্শন মিলল তা থেকে এই অঞ্চলের আদি মধ্য যুগের ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি সম্বন্ধেও জানা গেল।”

মূর্তিগুলি ক্ষয়ে গিয়েছে। তবে মূল কাঠামো অনেকটাই বোঝা যাচ্ছে। বহুভুজা দেবী ললিতাসনে অর্থাৎ এক পা ভাঁজ করে ও অন্য পা নীচে ঝুলিয়ে বসে রয়েছেন। নীচে অস্পষ্ট অবয়বটি দেবীর বাহন সিংহের ক্ষয়ে যাওয়া রূপ বলেই মনে করছেন পুরাতত্ত্ববিদেরা। সিংহের নীচে দেবীর বাঁ দিকে রয়েছেন এক চামরধারিণী। উল্টো দিকে এক সহচরী কোমরে একটি হাত রেখে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। এই দু’জনেই দাঁড়িয়ে পদ্মের উপরে। দেবীর হাতগুলিতে ঢাল, ধনুক, অঙ্কুশের মতো দুর্গা বা চণ্ডীর আয়ুধ বলে পরিচিত একাধিক অস্ত্র রয়েছে।

এই মূর্তিটি দুর্গার কোনও রূপ বলেও অনুমান করছেন পুরাতত্ত্ববিদেরা। মার্কণ্ডেয় পুরাণের দেবীমাহাত্ম্যে দুর্গা চণ্ডী বলেও প্রতিষ্ঠিত। তিনি মহিষাসুরমর্দিনীও। খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকে বাংলাদেশের বগুড়া থেকে পোড়ামাটির যে চতুর্ভুজা মহিষমর্দিনী মূর্তিটি পাওয়া গিয়েছে, সেটিই এই গোটা এলাকায় দুর্গামূর্তির প্রাচীনতম পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন বলে মনে করা হয়। মহাস্থানগড় থেকে পাথরে নির্মিত যে চতুর্ভুজা মহিষমর্দিনী মূর্তিটি মিলেছে, তা খ্রিস্টীয় পঞ্চম বা ষষ্ঠ শতকের বলে দাবি করা হয়েছে। পূর্ব ভারতে ত্রিপুরার দেউলবাড়িতে সপ্তম শতকে সর্বাণী মূর্তি পাওয়া গিয়েছে। তবে নবম শতক থেকে বাংলায় দুর্গা বা তাঁর কোনও রূপের একাধিক দণ্ডায়মান ও উপবিষ্ট মূর্তি পাওয়া যায়। হাতের সংখ্যাতেও বৈচিত্র রয়েছে। বত্রিশ হাতের দণ্ডায়মান দুর্গা মূর্তি মিলেছে দক্ষিণ দিনাজপুরের বেতনা থেকে। তবে সাঁতুড়ির মূর্তিটিতে মহিষ নেই। দেবীর ভঙ্গিও আক্রমণাত্মক নয়। সৌম্য ভাবে বসে রয়েছেন। তবে সৌম্য ভঙ্গিতেও এই দেবীর অনেক মূর্তি এর আগেও মিলেছে।

স্থানীয় স্তরে মূর্তিগুলি পরিচিতই ছিল। সম্প্রতি সেগুলি বিশেষজ্ঞদের নজরে আসে। রাজ্য পুরাতত্ত্ব দফতরের পুরাতত্ত্ববিদ শর্মিলা সাহা বলেন, “দেবীমূর্তির সঙ্গে যে বিষ্ণুমূর্তিটি পাওয়া গিয়েছে, তা অষ্টম শতকের বলেই ধারণা। অনুমান, অন্য স্ফীতোদর উপবিষ্ট মূর্তিটিও সেই সময়েরই।”

সাঁতুড়ি থেকে সামান্য দূরে ঝাড়খণ্ডে চাণ্ডিলে একটি প্রাচীন শিলালেখ পাওয়া গিয়েছিল, যাতে ‘ভগবতী ত্রৈলোক্যবিজয়া’র মন্দির নির্মাণের কথা বলা হয়েছে। সেই লেখে কোনও তারিখের উল্লেখ না থাকলেও দীনেশচন্দ্র সরকার লিপিগত বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে এটিকে অষ্টম শতকের বলে মনে করেছেন। এই দেবী ব্রাহ্মণ্য শক্তির কোনও একটি রূপ। সম্ভবত দুর্গা। এ বার ওই কাছাকাছি এলাকা থেকে প্রায় সমসাময়িক এই উপবিষ্ট বহুভুজা দেবী মূর্তিটির খোঁজ মেলায় এই অঞ্চলে ওই সময়ে বিশেষ শক্তি উপাসনার কোনও প্রচলন হয়েছিল কি না, তা খতিয়ে দেখার প্রয়োজন রয়েছে বলে পুরাতত্ত্ববিদেরা মনে করছেন। স্থানীয় বাসিন্দা শিক্ষক মাধব মণ্ডল বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে এই পুরাতাত্ত্বিক উপাদানগুলি অবহেলায় পড়ে রয়েছে। এ বার বিশেষজ্ঞদের নজর পড়লে পুরুলিয়ার ইতিহাস সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য জানা যাবে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE