Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
অন্য পুজো

পেরোবি সব বাধা, তাই তো নাম দুর্জয়

গ্রামে ফোনে কথা বলায় খুব কষ্ট। তবু ঢাকার পুরানা পল্টনের অফিস থেকে খবরটা নিতে ব্যস্ত হয়ে উঠছেন দুলাল ভক্ত। ‘‘জুতার মাপ ঠিক হইসে তো ছেলেটার? জামার কালার পসন্দ হইসে?’’

ঋজু বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ অক্টোবর ২০১৫ ০৩:৪৫
Share: Save:

গ্রামে ফোনে কথা বলায় খুব কষ্ট। তবু ঢাকার পুরানা পল্টনের অফিস থেকে খবরটা নিতে ব্যস্ত হয়ে উঠছেন দুলাল ভক্ত। ‘‘জুতার মাপ ঠিক হইসে তো ছেলেটার? জামার কালার পসন্দ হইসে?’’

নমিতা ঝাঁঝিয়ে বলেন, ‘‘রাখো তোমার ছেলের কথা। নিজে কিনল। তার পর বলে, সব নাকি আমরা ওর ঘাড়ে চাপায়ে দিসি!’’

যশোরের বড়বাজার, কালেক্টরেট মার্কেট ঘুরে-ঘুরে ছেলেকে নিয়ে কেনাকাটা সেরে সবে গোপালগঞ্জে ফিরেছেন মা। ছেলের পছন্দের দু’জোড়া নীল জুতো, নতুন ইস্কুল ব্যাগ, দু’টো নতুন গেঞ্জি।

গোপালগঞ্জের ষোলোঘর গ্রাম। নমিতার মামাশ্বশুরবাড়ি। গ্রামে ফিরেই এক দৌড়ে চন্দ্র বসুর খালপাড়ে উধাও পনেরো বছরের কিশোর।

যাক যত খুশি! ছেলের কথা শুনে হাসতে হাসতে ভাবেন দুলাল। মনে মনে ছেলেকে বলেন, ‘‘সপ্তমী না হোক, অষ্টমীতে আমি ঠিক আসতিসি বাবা! কত বছর পর এ বার তোমারে নিয়ে পূজা দেখব আমরা সবাই।’’

নমিতাও পুজোয় বেরোবেন চার বছর বাদে। ছোট ছেলেটাকে নিয়ে এত কাল যশোরে বাপের বাড়িতেই বন্দি হয়ে থাকতেন পুজোর ক’টা দিন। ওদের বাবাও শোকে পাথর হয়ে ঢাকায় পড়ে।

দুলাল নিজেকে বলতেন, ‘‘আমার তো একাত্তরেই বাঁইচ্যা থাকার কথা সিল না। এক বার সব হারানোর পরে কি আবার আঘাত দিতেই বাঁচায়ে রাখল ঠাকুর?’’

ছেলেটা হারানোর পরে গোটা বাংলাদেশ ঢুঁড়ে ফেলা হয়েছিল। ঝিনাইদহ, সাতক্ষীরা, মাগুরা, নোয়াপাড়া, কুমিল্লা! কোনও ঠাকুরবাড়ি, কবিরাজবাড়ি বাদ নেই। যশোরের গরিব শাহ-র মাজারে খিচুড়ি বিতরণ, মানত করে কালীপুজো।

ফেরার পরে সে সব শুনে ছেলেটা বিরক্ত। গম্ভীর মুখে বলে, ‘‘তোমাদের মধ্যে তো দেখছি খুব অন্ধ বিশ্বাস!’’ যশোর থেকে বাসে গ্রামে ফেরার পথে সারা ক্ষণ মুখে খই ফুটছে। সাড়ে তিন-চার ঘণ্টার পথ যেতে যেতে বলে, ‘‘এর থেকে তো আগে কলকাতা পৌঁছে যেতাম।’’

তবে কলকাতার পুজো পছন্দ নয় ছেলের। শুধু এক বারই দেখার সুযোগ হয়েছিল। কামালগাজির ‘ইচ্ছে’ অনাথ-আশ্রমের কাকুদের সঙ্গে ঘুরে সল্টলেক, নাকতলা, বাগবাজার, কালীঘাট! এগরোল, জাঁকজমক ঠিক আছে। ‘‘কিন্তু আমার বোরিং লাগত।’’ এর থেকে গ্রামের মেলা, বিসর্জনের দু’দিন বাদে ‘বার দশেরা’য় জলিপারে নৌকাবাইচ অনেক ভাল! নমিতার মনে পড়ে, এ দিকে পুজোর আনন্দ এখন অনেক হাল্কা। পয়সাওয়ালা কত লোক পুজো করত, তারা ইন্ডিয়া চলে গেল। যশোর টাউনে বরং ঢের ধুমধাম। মোল্লাপাড়ায় ম-স্ত পুজোর গেট। বেজপাড়ায়, কালীবাড়িতে ক-ত ঠাকুর। কিন্তু ছেলেটা যে নৌকাবাইচ-নৌকাবাইচ করে পাগল করে দিল।

জন্ম থেকেই জলের পোকা! ষোলোঘরে ওর বাবার মামাতো ভাইদের বাসার কাছেই দেশভাগের আগের কালের জমিদার চন্দ্র বসুর নামে খাল। খাল তো নয়, যেন নদী! দস্যি ছেলে তৃপ্তির হাসি হাসে, ‘‘দেড়-দু’বছর বয়স থেকে সাঁতার কাটছি বলেই তো পালিয়ে আসতে পারলাম। মালিপুকুরের হোমের বদমায়েশ আঙ্কলগুলো কচু করতে পারল!’’

তবে পাকা সাঁতারু হওয়ার জন্য শুধু নয়। এ ছেলের রোমহর্ষক ঘরে ফেরার কাহিনির নেপথ্যে সমান দায়ী আর একটি অভ্যাস। ‘‘আমি রোজ পেপার পড়তাম!’’ তাতেই এল মুক্তির চিঠি। হাওড়ার মালিপুকুরে ‘খারাপ আঙ্কল’দের হোম থেকে পালানোর পরে কামালগাজিতে ঠাঁই হয়েছিল। ‘‘সেখানে কাকুরা ভাল!’’ পেপার পড়াও সেখানেই। ‘‘পলিটিক্স, হিস্ট্রি খুব ভাল লাগে আমার। আনন্দবাজারে সে সব পড়তে গিয়েই তো নিজের ছবিটা দেখতে পেলাম!’’

আনন্দবাজারের মাধ্যমেই হারানো ছেলেকে ফিরে পায় পরিবার। চার বছর ধরে না-দেখা চেহারাটা দেখে দেখে আশ মেটে না নমিতার। মাকে ছাড়িয়ে গিয়েছে মাথায়। ‘‘এখনও ক-ত সরু আমার ছেলেটা দেখুন! ওর কালো রঙেও একটা ‘জিল্লা’ ছিল। সেটা এখন নেই।’’ ভাল করে দেখলে ছেলের ডান গালে একটা দাগ বোঝা যায়। ছোটবেলায় কালীপুজোয় জোকার সেজে নাচতে গিয়ে নকল দাড়িতে আগুন ধরে মুখ পুড়ে যায়। সেই দাগটাই গাঢ় হয়েছে। ছেলে বলে, ‘‘মালিপুকুরের একটা আঙ্কল গরম খুন্তি চেপে ধরেছিল। প্রথম বার পালানোর পরে ধরা পড়ে গিয়েছিলাম তো! হোমে ওরা আমাদের চুল কাটিয়ে টাকলা করে রাখত। তাই আলমপুর অবধি যাওয়ার পরে ধরা পড়ে যাই।’’ সাঁকরাইল থানার পুলিশ মারতে মারতে ছেলেকে হোমে ফিরিয়ে দিলে শাস্তি জোটে খুন্তির ছেঁকা!

নমিতার চোখে ভাসে, ওর বাবার গালেও একই রকম দাগ। একাত্তরের স্মৃতি! মায়ের বুকে শুয়ে থাকার সময়েই খানসেনাদের গুলিতে সব শেষ হওয়ার কথা ছিল। দু’বছরের দুলালের ডান গাল ঘেঁষে গিয়েছিল বুলেটটা। নিহত মায়ের বুকে শুয়ে দুধ খাওয়ার চেষ্টা করছিল ছেলে। ঘরে তখন নিথর অন্য চার ভাইবোন। একই রকম বরাতজোরে বেঁচে যাওয়া পিঠোপিঠি এক দিদি শুধু কাঁদছিল পাশে বসে। দুলালের সে সব মনে থাকার কথাও নয়। তবে গালে দাগটা আছে। দুলাল ও তাঁর দিদিকে মাদারিপুর থেকে গোপালগঞ্জে নিয়ে আসেন দিদিমা!

বাবা না ছেলে, নতুন জীবন পাওয়াটা কার বেশি কঠিন ছিল? ঢাকায় সাইনবোর্ড কোম্পানির অফিসে বসে ভাবেন আজকের মধ্য-চল্লিশ। ‘‘আমি তো ভাইগ্যের হাতে ছেড়ে দিসিলাম। কিন্তু ওর মামার স্বার্থত্যাগের তুলনা নেই।’’

চার বছর আগে ছেলেটা কী ভাবে হারাল, কেউ বুঝতেই পারেনি। তখন ও যশোর টাউনে মামার বাড়িতে থেকে ক্লাস ফাইভে পড়ত। হঠাৎ উধাও। বছর দুই কেটে যাওয়ার পর এক বিশ্বকর্মা পুজোয় কোতোয়ালি থানার পুলিশ এসে খবরটা দেয়! সেই খবর সম্বল করে তড়িঘড়ি বর্ডার পেরিয়ে হাওড়ার মালিপুকুরে হাজির হন বাড়ির লোকেরা। কিন্তু খোঁজ মেলেনি ছেলের। এর পর থেকে বড়মামা সুব্রত মণ্ডল ভাগ্নেকে উদ্ধারের জন্য চাকরি-পড়াশোনা জলাঞ্জলি দিয়ে পড়ে থাকেন ভারতে। তবু পরের দু’টো বছরে কেউ কিচ্ছু বলতে পারেনি। শুধু কলকাতায় ডেপুটি হাই-কমিশনার, বালিগঞ্জে ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রকের স্থানীয় অফিস আর বিকাশ ভবনে সমাজকল্যাণ দফতরের কর্তাদের কাছে পড়ে থাকা! খবরটা আনন্দবাজারে বেরোনোর পরে অবশ্য এক বেলার মধ্যে খোঁজ মিলেছিল। ভাগ্যিস, সুব্রতর ভিসার মেয়াদ শেষ হতে আরও দু’টো দিন বাকি ছিল। পরের দিনই বেনাপোল পেরিয়ে দিদি নমিতাকে ইন্ডিয়ায় নিয়ে আসেন তিনি। ফিরে পাওয়া ভাগ্নেকে ঘিরে ছুটির দুপুরে এখন আহ্লাদের শেষ নেই মামাদের। বাড়িতে না-বলে বেনাপোলের কাছে কী এক মন্দির দেখতে গিয়ে ঢুকে পড়েছিল ইন্ডিয়ায়! খারাপ লোকের খপ্পরে পড়ে তার পরে! পুলিশকে এড়িয়ে জুতোর সোলের মধ্যে হেরোইন না কী যেন পাচার করতে হতো সারা ভারতে। কাশ্মীরের ডাল লেক থেকে কন্যাকুমারী, রাজস্থান, ওড়িশার খণ্ডগিরি— এ ভাবেই ঘুরে ফেলেছিল বিপন্ন শৈশব। নাসিক থেকে পালিয়ে কলকাতা ফিরেওছিল। কিন্তু বিপদ কাটেনি।

বাবার ফোন নম্বর পাল্টে গিয়েছিল। তাই কাউকে বলতে পারেনি সে কোথায়! ‘বাংলাদেশি’ বললে পুলিশ মারবে, এই ভয়টাও তাড়া করত। তাই পুলিশ মারফত হাওড়ার মালিপুকুরের হোমে ঠাঁই হয় ‘ইন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরী’ ছদ্মনামে। ‘‘ওখানে এক জনই ভাল লোক ছিল। পল্লব আঙ্কল। ওঁকে ভয়ে-ভয়ে বলেছিলাম আসল পরিচয়!’’ ‘হাওড়ার হোমে বাংলাদেশি কিশোর’-এর খবর তখনই নড়াচড়া শুরু করে অজস্র ফাইলের পথ ধরে। খবর যশোরে এসে পৌঁছনোর আগেই মারের হাত থেকে বাঁচতে মালিপুকুর থেকে আবার পালিয়েছিল ছেলেটা।

হোমের রান্নাঘরের পুরনো একটা জানলায় জং ধরানোর জন্য রাতের পর রাত নুন ছুড়ত আর হিসি করত ওরা ক’জন। এর পরে লোহার খুন্তির চাড় দিয়ে পাল্লাটা ভেঙে ফেলে দে-ছুট। ‘আঙ্কলগুলো’ টের পেয়ে যায়। অনেকে ধরাও পড়ে। সাঁতরে পুকুর পেরিয়ে ও কিন্তু ধূলাগড়ে পগার পার। হাওড়া হয়ে শিয়ালদহের চাইল্ডলাইন মারফত পরের ঠিকানা কামালগাজির আশ্রম। সেখানে আনন্দেই ছিল। স্কুল শুরু হয়। বিতর্ক, কুইজের পুরস্কার, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবিওয়ালা মেডেল এখন যশোরে মামাবাড়ির তাকে রাখা। এত কিছুর পরেও আসল নামটা ভয়ে বলতে পারেনি। ‘ভাল আঙ্কলদেরও’ নয়। তাই কেউ খুঁজেও পায়নি ওকে। যত দিন না ছবিটা বেরোয় আনন্দবাজারে।

চার বছর বাদে দেশে ফেরা ছেলে এখন বলে, ‘‘মালিপুকুরের হোমটা শুনেছি বন্ধ করে দেবে। বাকি ছেলেগুলো তা হলে প্রাণে বাঁচবে!’’ মুক্তির পুজোতেও তবু কাঁটা খচখচ করে। যশোর টাউনে আবার যদি সমস্যা হয়! সব দিক ভেবে তাই গোপালগঞ্জের গ্রামের স্কুলে ফের ক্লাস ফাইভে ভর্তি। এতগুলো বছর নষ্ট! শাকিব, আশিকদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। ওরা পরের বার স্কুল পেরোনোর পরীক্ষা দেবে। ইতিহাস নিয়ে পড়তে উন্মুখ কিশোরের চোখে জল আসে! আর কবে বড় হব আমি!

ছেলের সঙ্গে পুজো দেখার আশায় বিভোর বাবা হাসেন, ‘‘ওকে বলেছি, কিসু ভাবিস না! সব বাধা জয় করবি বলেই তো তোর নাম, দুর্জয়!’’

শারদ-সকালে নতুন আশায় সোনার বাংলার নদী-মাঠে চোখ মেলে অদম্য কিশোর। দুর্জয় ভক্ত!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

abpnewsletters
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE