শুধু শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস নয়, রোজ ভ্যালি-কাণ্ডে কয়েক জন বাম নেতার নামও উঠে এসেছে বলে তদন্তকারীদের দাবি। বুধবার ত্রিপুরায় রোজ ভ্যালির অফিস এবং কর্তাদের বাড়ি মিলিয়ে সাতটি জায়গায় হানা দিয়েছিল সিবিআই। সেখানেও উঠে এসেছে এক বাম বিধায়কের নাম। সিপিএম অবশ্য জানিয়েছে, অভিযোগ ছাড়া তথ্য পাওয়ার জন্যও অনেক সময়ে সিবিআই ডেকে পাঠায়। কেন্দ্রীয় তদন্তকারীরা তাদের কোনও নেতাকে ডেকে পাঠালে তাঁরা যাবেন, তদন্তে সহযোগিতা করবেন।
বুধবার এগারোটি রাজ্যের ৪৩টি জায়গায় একযোগে তল্লাশি চালিয়েছে সিবিআই। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের অভিনেতা-সাংসদ তাপস পাল, রোজ ভ্যালির মালিক-সহ সংস্থার একাধিক কর্তার বাড়ি ও অফিস মিলিয়ে মোট ২৭টি জায়গায় হানা দেন সিবিআই অফিসারেরা। তাঁদের দাবি, তল্লাশিতে বহু নথি, পেন ড্রাইভ, সিডি পাওয়া গিয়েছে যা তদন্তের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। বৃহস্পতিবার সংস্থার এক কর্তা জানান, আগেই বেশ কিছু নথিপত্র তাঁদের হাতে এসেছে। গত কাল তল্লাশি করে আরও কিছু কাগজপত্র পাওয়া গিয়েছে। এই সব নথি পরীক্ষা করে রাজনৈতিক দলের নেতা-সহ কয়েক জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হতে পারে।
রোজ ভ্যালির জন্ম বাম আমলে। তবে মূলত ২০০৯ সাল থেকেই তাদের ব্যবসার রমরমা শুরু। সিবিআইয়ের এক কর্তার ব্যাখ্যা, সারদার ব্যবসাও প্রায় একই সময় থেকে বাড়তে শুরু করেছিল। কিন্তু তখন পশ্চিমবঙ্গে পালাবদলের স্পষ্ট ইঙ্গিত পেয়ে মূলত তৃণমূলের হাত ধরে ফেলেন সারদার কর্ণধার। তার পর সরকার বদল হতে তাদের আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। কিন্তু রাজ্যে পালাবদলের আগে পর্যন্ত তৎকালীন বাম সরকার ও তাদের নেতাদের সঙ্গেই যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন রোজভ্যালি কর্তা। নতুন সরকার আসার পরে এই সংস্থা জার্সি বদল করে। তদন্তকারীদের দাবি, এই কারণেই রোজ ভ্যালি মামলায় একাধিক বাম নেতার উঠে এসেছে। সিপিএম নেতৃত্বের ব্যাখ্যা, ব্যবসার জন্য সরকারি দলের নেতা-মন্ত্রীদের সঙ্গে বাণিজ্যিক সংস্থাগুলি যোগাযোগ করে থাকেন। কিন্তু তার মানেই এই নয় যে তাদের অন্যায় সুযোগ দেওয়া হয়। রোজ ভ্যালির বিরুদ্ধে ত্রিপুরার বাম সরকারই প্রথম কড়া পদক্ষেপ নিয়েছে।
সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও সাংসদ মহম্মদ সেলিমের কথায়, “কোন স্তরে কার বিরুদ্ধে অভিযোগের কথা বলা হচ্ছে, জানি না। তবে ডাক পেলে আমাদের দলের যে কেউ তদন্তের মুখোমুখি হতে প্রস্তুত। অভিযোগ না থাকা সত্ত্বেও কারও কাছ থেকে তথ্য পাওয়ার জন্য তদন্তকারীরা ডেকে পাঠাতে পারেন। আমরা বরাবরই বলে আসছি, তদন্তে সহযোগিতা করতে তৈরি।” পাশাপাশি সিপিএম সূত্রে বলা হচ্ছে, অর্থলগ্নি সংস্থার কারবারের সঙ্গে কোনও নেতা জড়িয়ে পড়েছেন কি না বা আর্থিক সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন কি না, সেটাই বিবেচ্য। সারদার ক্ষেত্রে তৃণমূল নেতারা যেমন ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছেন বলে অভিযোগ, সে ভাবে তাঁদের দলের কেউ কোনও কেলেঙ্কারিতে জড়াবেন না বলেই সিপিএম নেতৃত্বের বিশ্বাস। সারদা মামলাতে সিপিএমের কোনও নেতার সংশ্রব সে ভাবে এখনও প্রমাণিত হয়নি। তদন্তে নেমে তথ্য চাওয়ার জন্য সিবিআই এক বার শুধু ডেকে পাঠিয়েছিল সিপিএম নেতা রবীন দেবকে।
সিবিআই সূত্রের খবর, রোজ ভ্যালি সংস্থাটি গড়েছিলেন গৌতম কুণ্ডুর দাদা কাজল কুণ্ডু। অভিযোগ, ২০০৩ সালের নভেম্বর মাসে স্ত্রী ও ছোট ছেলেকে নিয়ে গুয়াহাটি থেকে আগরতলা যাওয়ার পথে রহস্যজনক ভাবে সপরিবারে মারা যান কাজলবাবু। শিলং-এর কাছে তাঁদের গাড়ি নদীগর্ভে পড়ে গড়িয়ে পড়ে। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে গাড়ির চালক বেঁচে যান। ওই ঘটনার তদন্তে নামে পুলিশ। কিন্তু এর মধ্যেই দাদার ব্যবসায় জাঁকিয়ে বসেন গৌতমবাবু। তদন্তকারী সংস্থা জানাচ্ছে, প্রথমে এলআইসি-র এজেন্ট হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন গৌতম। পরে এলআইসি ছেড়ে একটি বেসরকারি বিমা সংস্থায় কাজ নেন।
তদন্তে উঠে এসেছে রোজ ভ্যালির শ্রীবৃদ্ধির অনেক ঘটনা। তদন্তকারীদের দাবি, কার্যত ২০০৯ সাল পর্যন্ত রোজ ভ্যালির নাম শোনা যায়নি। তখন গৌতমবাবুও ছিলেন আড়ালে। ২০০৯ সাল থেকে তিনি বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজের ব্যবসা দ্রুত ছড়িয়ে ফেলতে থাকেন। অর্থলগ্নির পাশাপাশি শুরু করেন হোটেল ব্যবসা। ধীরে ধীরে সিনেমার প্রযোজক হিসেবেও উঠে আসে রোজ ভ্যালির নাম। তদন্তকারী অফিসারদের দাবি, বাম জমানায় তৎকালীন শাসক দলের নেতাদের সাহায্য ছাড়া ব্যবসা বাড়াতে পারতেন না গৌতম কুণ্ডু। যদিও তার অনেক আগে থেকেই সিপিএম নেতাদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ শুরু।
সূত্রের খবর, রোজ ভ্যালির তদন্তে উঠছে কিছু তৃণমূল নেতা-নেত্রীর নামও। এক অফিসারের কথায়, “সারদার সুদীপ্ত সেন বাজার থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকা তুলেছিলেন। তার মধ্যে কয়েকশো কোটি টাকা ভাগ-বাটোয়ারা হয়েছিল। আর রোজ ভ্যালি সংস্থা বাজার থেকে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা তুলেছে। এর মধ্যে ১০ হাজার কোটি টাকা তোলা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ থেকে।” বাজার থেকে রোজ ভ্যালি যত টাকা তুলেছে, তার কত অংশ রাজনৈতিক নেতাদের ভাগ দিতে হয়েছে, তা দেখতে শুরু করেছে তদন্তকারী সংস্থা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy