Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

বৌদিমণির উষ্ণতা

রবীন্দ্রনাথ-কাদম্বরীর সম্পর্কে মন না শরীর? বৈশাখের তপ্ত দুপুরে জোড়াসাঁকোর দক্ষিণের বারান্দায় হাঁটতে হাঁটতে আলোচনা-মগ্ন কঙ্কনা-পরমব্রত। ছিলেন পরিচালক সুমন ঘোষ-ও। কান পাতলেন স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়।রবীন্দ্রনাথ-কাদম্বরীর সম্পর্কে মন না শরীর? বৈশাখের তপ্ত দুপুরে জোড়াসাঁকোর দক্ষিণের বারান্দায় হাঁটতে হাঁটতে আলোচনা-মগ্ন কঙ্কনা-পরমব্রত। ছিলেন পরিচালক সুমন ঘোষ-ও। কান পাতলেন স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়।

ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল।

ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল।

শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০১৫ ০১:০৩
Share: Save:

বাঙালির বৌদিবাজি কি রবীন্দ্রনাথ-কাদম্বরীর সম্পর্ক থেকে শুরু হয়েছিল?

কঙ্কনা: বৌদিবাজি কথাটা আপনার মুখে প্রথম শুনলাম। তবে একটা কথা স্পষ্ট বলছি এই বৌদি রোম্যান্সটা আসলে একটা সামাজিক সমস্যা। তখন অল্পবয়েসি মেয়েদের বুড়োদের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হত। বাইরে বেরোতে দেওয়া হত না। তাদেরও তো তখন বন্ধু দরকার হত। কোথায় যাবে তারা? তখন সমবয়সী দেওরেরাই বন্ধু হত।

পরমব্রত, বৌদিবাজি নিয়ে আপনি কিছু বলবেন না?

পরমব্রত: এটাকে দু’টো পার্টে দেখতে হবে। দেওর-বৌদির মাঝে একটা ইন্টেলেকচুয়াল রোম্যান্স কাজ করে... সেটা কাদম্বরী-রবীন্দ্রনাথ থেকেই এসেছে। কিন্তু পাড়ার বৌদিবাজিটা সেখান থেকে আসেনি। একটু ভেবে দেখুন, পরিবারে দাদার বৌ-ই একমাত্র পরনারী। তার সঙ্গে রক্তের কোনও সম্পর্ক নেই। অথচ তাকে ঘিরেই একটা নিষিদ্ধ নিয়ম চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই নিষিদ্ধ ব্যাপারে আমাদের সবচেয়ে বেশি আগ্রহ... সেখান থেকেই বৌদিবাজির শুরু।

আচ্ছা কাদম্বরী করতে গিয়ে এই বৌদিবাজিটা ফিরে আসেনি?

পরমব্রত: আরে আলবাত এসেছে। সুমনদা আর আমি ঠিক করেই নিয়েছিলাম, কাদম্বরী আর রবীন্দ্রনাথের দৃশ্যগুলো আমরা সাবটেক্সট দিয়ে কথা বলব। আমরা শ্যুট করতে করতে এমন ভাষায় কথা বলতাম সেটা বুঝতে না পেরে কঙ্কনা রেগে যেত।

কঙ্কনা: রেগে কোথায় যেতাম? ওদের টোনগুলো ক্রিপল্ড আর ইররেলিভেন্ট ছিল।

পরমব্রত: দেখছেন দেখছেন। শব্দগুলো খেয়াল করুন, যেন ইংরেজি সাহিত্যের ক্লাস হচ্ছে।

কঙ্কনা: আরে, তোমরা সব সময় বাংলায় কথা বলে যাচ্ছ! আর, আমি একটু ইংরেজি বললেই দোষ।

কিন্তু কী ভাষায় কথা বলতেন আপনারা সেটা তো বলুন...

সুমন: জানি না রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এ কথা বলা যায় কি না! ধরুন নন্দন কাননের একটি দৃশ্য। তো আমি পরমকে বললাম, পরম, কাদম্বরী ঢুকছে। ঝাড়িটা করে দিস। যেটাকে কঙ্কনার অভদ্র আর নোংরা মনে হত।

রবীন্দ্রনাথকে বলছেন কাদম্বরীকে ঝাড়ি করতে?

কঙ্কনা: (ভীষণ উত্তেজিত হয়ে) কিন্তু ঝাড়ি নিয়ে এত হাসাহাসি হচ্ছে কেন? ঝাড়ি মানে তো... ঝাড়... প্ল্যান্ট।

পরমব্রত: কী! এ তো দেখছি ঝাড়িকে পিছে ক্যায়া হ্যায় বলতে চাইছে।

(ততক্ষণে সুমন কঙ্কনাকে বুঝিয়ে দিয়েছে ঝাড়ির অর্থ)

কিন্তু ঝাড়ির গল্প দিয়ে কি আপনারা দর্শক টানবেন?

পরমব্রত: আমার কথা মিলিয়ে নেবেন। রবীন্দ্রনাথ-কাদম্বরীর সম্পর্কটা কতটা এস্থেটিক্যালি হ্যান্ডল করা হয়েছে, সেটা জানতেই লোকে ছবিটা দেখতে আসবে। আমিও তো আজও জানতে চাই, রবীন্দ্রনাথ আর ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সম্পর্কটা কেমন ছিল! আজও লোকে কাদম্বরী আর রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক নিয়ে আগ্রহ দেখাবে বলে মনে হয়।

কঙ্কনা: দেখুন, এই ছবির একটা তৈরি দর্শক আছে। আর এটা একটা সেফ বায়োপিক। কাদম্বরীর মৃত্যুদৃশ্য যে সবাই দেখেছে বা এর কোনও ছবি আছে— এমনটা নয়।

সুমন: ‘নষ্টনীড়’, ‘চারুলতা’র মধ্যে দিয়ে একটা কেচ্ছা কিন্তু তৈরি হয়েই আছে। মানুষ এটার ব্যাপারে সবসময় কৌতূহলী। সেই কারণে ছবিটা লোকে দেখতে আসবে বলেই মনে হয়।

কাদম্বরী নিয়ে সিরিয়ালও হচ্ছে। মনে হয় না বিশ্বভারতীর অনুশাসনের মতো কাদম্বরীরও অনুশাসন দরকার?

পরমব্রত: চারিদিকে রবীন্দ্রনাথ-কাদম্বরী নিয়ে যেমন যথেচ্ছ খেলাধুলো হচ্ছে সেটা হোক। আমরা কি ভাবতে পেরেছিলাম সিগনালে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজবে? এই ভাবনাগুলো বা মানুষগুলো কারও পৈতৃক সম্পত্তি নয়।

কঙ্কনা: অনুশাসনের কোনও প্রশ্নই ওঠে না।

পরমব্রত: আচ্ছা জিজ্ঞেস করছেন না তো আমার আর কঙ্কনার অফলাইন কেমিস্ট্রিটা এখন কেমন?

সুমন: শুনুন আমি বলছি কঙ্কনা কিন্তু পরমকে নিয়ে আমার কাছে খুব প্রশংসা করেছে। পরমও দেখলাম ডাবিং থেকে বেরিয়ে প্রথমেই বলল, ‘বুঝলে কঙ্কনার অভিনয়ের জাতটাই আলাদা।’

পরমব্রত নাকি কোনও এক দৃশ্যতে অভিনয় করতে গিয়ে একটু অস্বস্তিতে পড়েছিলেন!

পরমব্রত: কঙ্কনার সঙ্গে সেটাই আমার প্রথম দৃশ্য ছিল। রবি একটা করে কবিতার লাইন শোনাচ্ছে কাদম্বরীকে। আর কাদম্বরী সেটা বাতিল করছে... অগস্ট মাসে ও রকম চ্যাটচেটে ওয়েদার, সারা শরীরে আঠা মেখে ভারি উইগ পরে প্রথমেই অমন একটা দৃশ্যে অভিনয় করতে অস্বস্তি হবে না?

সুমন: সত্যি ওকে অনেক কিছু পরে অভিনয় করতে হয়েছে।

কঙ্কনা: আমরা তো সব সময়ই উইগ পরে অভিনয় করি। আমাদের তো কেউ বেচারা বলে না!

তা মায়ামির অধ্যাপকের হঠাৎ রবীন্দ্রনাথ-কাদম্বরী নিয়ে ছবি করার ইচ্ছে হল?

সুমন: রবীন্দ্রনাথ-কাদম্বরী সম্পর্ক নিয়ে বাঙালিদের মধ্যে মিথ তৈরি হয়ে গিয়েছে। এই সম্পর্কটা নিয়ে ফিসফিসানি আছে। গুজবও আছে। রবীন্দ্রনাথ-কাদম্বরীর সম্পর্কের মধ্যে যে ড্রামাটা আছে, সেটাই আমার ছবিতে দেখাতে চেয়েছি।

কাদম্বরীর মৃত্যু নিয়ে বাঙালিদের মধ্যে অনেক মতভেদ আছে। আপনারা তো এত রেফারেন্স ঘেঁটেছেন, আজ যদি বাঙালি জানতে চায় কাদম্বরীর মৃত্যুর কারণ। আপনি কী বলবেন?

সুমন: আমি কিন্তু কাদম্বরী-রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কোনও তথ্যচিত্র তৈরি করছি না। সকলে ভাবে রবীন্দ্রনাথ-কাদম্বরীর প্রেম ছিল। রবীন্দ্রনাথ বিয়ে করার পর কাদম্বরী আত্মহত্যা করেন। বিষয়টা এত সোজা নয়। অনেক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। সেই পরিস্থিতিগুলো আমার ছবিতে আছে। প্লিজ ছবিটা দেখলে সেটা বুঝতে পারবেন।

দেখুন ব্যোমকেশ নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করেছেন দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ নিয়ে অন্য রকম হলে বাঙালি কিন্তু ছেড়ে দেবে না।

সুমন: রবীন্দ্রনাথের বিষয়ে পান থেকে চুন খসলে আমি জানি বাঙালি আমাকে মেরে ফেলবে। বাঙালিরা রবীন্দ্রনাথকে দেবতুল্য করে রেখেছে। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু রক্তমাংসের মানুষ। আমার ছবিটাও তাই রক্তমাংসের মানুষের সম্পর্ক নিয়ে গল্প বলবে।

গল্প, নাকি সত্যি ঘটনা?

সুমন: এই ছবির চিত্রনাট্য মূলত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘প্রথম আলো’, মল্লিকা সেনগুপ্তর ‘কবির বৌঠান’ আর রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব লেখা ‘জীবনস্মৃতি’, ‘ছেলেবেলা’ থেকে নেওয়া। এ ছাড়াও আমি প্রশান্ত কুমার পাল, প্রভাত মুখোপাধ্যায়ও পড়েছি। গল্পটা সাজাতে যে যে ঘটনা আমার মনে হয়েছে নেওয়া উচিত, আমি সেগুলোই নিয়েছি।

ছবিতে কি সব সত্যি কথা বলা হয়েছে?

সুমন: সবটাই সত্যি নয়। আবার আজগুবিও নয়।

বাঙালি রেগে যাবে না তো?

কঙ্কনা: রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কিছু করতে চাইলেই বাঙালি রেগে যায়। তাই বলে কি কেউ কাদম্বরী-রবীন্দ্রনাথ নিয়ে ছবি করবে না?

আপনি কেন ছবিটা করলেন?

কঙ্কনা: কাদম্বরীর একাকিত্ব খুব টেনেছিল আমায়। রবীন্দ্রনাথ আর কাদম্বরীর একটা গভীর সম্পর্ক তো ছিলই। কিন্তু সেটা কতটা শরীরের আর কতটা মনের সেই প্রশ্ন অবান্তর!

পরমব্রত: না, ঠিক অবান্তর নয়। কাদম্বরী-রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে শরীরের প্রশ্নটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। লোকে ভাবে কতটা গভীরে গিয়েছিল তা।

ছবিতে শরীর না মন— কোনটাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে?

পরম: সুমনদা খুব ব্যালেন্স করেছে দু’টোর মধ্যে। আপাতত এটুকুই বলব।

কিন্তু কাদম্বরী করতে করতে ‘চতুষ্কোণ’, ‘গ্ল্যামার’ করেছেন। এই ব্যালান্সটা কী করে করলেন?

কঙ্কনা: পরমের প্রশ্নের আমি উত্তর দিচ্ছি। আড়াই বছর ধরে ছবিটা শ্যুট করা হয়েছে। অন্য ছবি না করে বসে থাকলে চলবে?

পরম: এটা যদি না করি তো প্রফেশনাল অ্যাক্টর হলাম কী করে? আমি পরমব্রত হয়ে রবীন্দ্রনাথ করেছি। রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠার চেষ্টা করিনি।

রবীন্দ্রনাথের চরিত্রে অভিনয় করতে ভয় করেনি?

পরমব্রত: রবীন্দ্রনাথ নিয়ে বাঙালির আদিখ্যেতা মাথায় রাখলে একলাইনও সংলাপ বলতে পারতাম না। রবীন্দ্রনাথ একেক জনের কাছে একেক রকম। পাঠভবনে আমরা ধূপ ধুনো দিয়ে পুজো করতাম। আবার যাদবপুরে রবীন্দ্রনাথকে ডি-কোড করতে শিখেছি। রবীন্দ্রনাথ গেছো দাদা
টাইপ চরিত্র।

আছা, অপর্ণা সেন ‘কাদম্বরী’ করতে চেয়েছেন কখনও?

কঙ্কনা: মা, আমায় কখনও বলেননি। তবে এই ছবি করার সময়, পোশাক নিয়ে, লুক নিয়ে মায়ের প্রচুর পরামর্শ নিয়েছি।

সুমন: শুধু পোশাকই নয়, তখন বাংলা শব্দের কেমন উচ্চারণ হত, তা নিয়েও পরামর্শ দিয়েছেন রিনাদি।

পরম: আমার মনে আছে, রিনাদি শ্যুটে এসে বলেছিল, ‘রবীন্দ্রনাথ হিসেবে তোকে দারুণ মানিয়েছে।’ ভরসা পেয়েছিলাম।

অপর্ণা সেন ‘কাদম্বরী’ বানালে কেমন হত?

পরম: আমি ঠিক বলতে পারব না...

কঙ্কনা: আমি একটা কথা বলতে চাই। রবীন্দ্রনাথ হিসেবে পরমকে খুব ভাল দেখিয়েছে কিন্তু।

তা হলে এমনিতে পরমব্রতকে ভাল দেখতে নয়?

কঙ্কনা: আরে, তা কেন! হি লুকস বেটার অ্যাজ রবীন্দ্রনাথ।

সুমন: দারুণ সার্টিফিকেট।

পরমব্রত: সার্টিফিকেটটা কিন্তু রবীন্দ্রনাথই পেলেন।

কাদম্বিনী

(চাঁপাডাঙার বৌ)

নারায়ণী

(রামের সুমতি)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE