Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

‘তোর কোনও কষ্ট হবে না, দেখিস!’

স্মৃতিচারণায় সুপ্রিয়া-কন্যা সোমা মা আমার কাছে মা-ই ছিলেন। জানতাম, অভিনয়টা মায়ের কাজ। আমার খুব গর্ব ছিল মাকে নিয়ে। সব না হলেও মায়ের অধিকাংশ ছবিই আমি দেখেছি।

সুপ্রিয়া

সুপ্রিয়া

শেষ আপডেট: ২৯ জানুয়ারি ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

মা চলে গেলেন। সে দিন ঘুম ভেঙে দেখলাম, মা তখনও ঘুমিয়ে আছেন। বুঝিনি, মা আর জাগবেন না। মায়ের উপর নির্ভর করে আমি সারাটা জীবন বেঁচেছি। আমিই ছিলাম মায়ের সব। যতটা ভাল সম্ভব তিনি আমাকে দেওয়ার চেষ্টা করতেন। মা যখন অসুস্থ হচ্ছিলেন, পা নিয়ে কষ্ট, এটা-ওটা, বলতেন, ‘আমার আশীর্বাদ তোর সঙ্গে থাকবে। তোর কোনও কষ্ট হবে না, দেখিস।’

মা আমার কাছে মা-ই ছিলেন। জানতাম, অভিনয়টা মায়ের কাজ। আমার খুব গর্ব ছিল মাকে নিয়ে। সব না হলেও মায়ের অধিকাংশ ছবিই আমি দেখেছি। বেছে নিতে বলা হলে, তিনটে ছবির কথা বলব— ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘মন নিয়ে’, ‘জীবন জিজ্ঞাসা’। ‘মন নিয়ে’তে দ্বৈত চরিত্রে মা কী অসাধারণ! অপূর্ব রান্না করতেন। কত পরিশ্রম করে যে সেই রান্না করতেন, নিজের চোখে দেখেছি। এই তো গত আট তারিখ মায়ের জন্মদিন গেল। যাঁরাই উইশ করতে মাকে ফোন করেছেন, মা সকলকেই বলেছেন, ‘আয় না একদিন, খেয়ে যা। তারা (নেপালি কুক, মায়ের ডান হাত) তো আমার কাছে থেকে এক্সপার্ট হয়ে গেছে!’

বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বাড়িতে চলে আসার পর লোকজনের আসা-যাওয়া কমে গিয়েছিল। মা নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছিলেন। তবে কোনও কিছু নিয়ে আক্ষেপ করা মায়ের ধাতে ছিল না। জীবনে তো অনেক লড়াই করেছেন। আমি তখন খুব ছোট। একবার বাড়ি ফিরে শুনলাম, বাবা (বিশ্বনাথ চৌধুরী) আর আমাদের সঙ্গে থাকছেন না। যদিও আমি বাবাকে খুবই ভালবাসতাম। কিন্তু মা যখন বললেন, ‘ও চলে গেছে’, আমি সেটাই মেনে নিয়েছিলাম।

আমি বরাবরই মায়ের উপর নির্ভরশীল ছিলাম। মা খুব শক্ত আর আমি দুর্বল বলেই এই নির্ভরতা। মায়ের ব্যস্ত জীবন। সেই কারণে বোর্ডিংয়েই আমার পড়াশোনা। পাঁচ বছর বয়সে দার্জিলিং কনভেন্টে চলে গেলাম। ১৯৬৪তে মা আমাকে কলকাতায় লোরেটোতে ভর্তি করে দিলেন। এক বছর পর সেখান থেকে চলে গেলাম নৈনিতালে। কলেজ করতে আবার ফিরলাম কলকাতায়। তার পরই মা আমার বিয়ে দেন। কুড়ি বছর বয়স, বি এ পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোয়নি। এর পর আমার মেয়ে (তুলি) জন্মাল। প্রসূন (গোস্বামী) এসেছিল মায়ের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে।

আরও পড়ুন: আপন করে নেওয়ার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল

তুলি প্রথম নাতনি বলে খুব আদর পেয়েছে মায়ের কাছে। মা-ই ওকে মানুষ করেছেন। বিয়ের পর তুলি যখন প্যারিসে চলে গেল, মা ওকে খুব মিস করতেন। আমি যখনই তুলির কাছে যেতাম, মা নিজের গয়না ওর জন্য পাঠাতেন। আসলে সব কিছু বিলিয়ে দেওয়ার মধ্যেই ছিল তাঁর আনন্দ।

মায়ের সঙ্গে সোমা

মা জীবনে কত খারাপ কথা শুনেছেন, তবু ভেঙে পড়েননি। অদ্ভুত ঠান্ডা চরিত্রের মানুষ ছিলেন। আঘাত সহ্য করতেন, পালটা আঘাত দিতেন না। মায়ের সৌন্দর্য, ফিগার, পোশাক নিয়ে সবচেয়ে সরব ছিল মেয়েরাই। সাজগোজের ব্যাপারে মা মনে করতেন, তাঁকে যা মানায়, যা তিনি ক্যারি করতে পারেন সেটাই তিনি পরেন। হিন্দি সিনেমায় সায়রা বানুর স্টাইলের সঙ্গে মায়ের মিল পান অনেকে। আসলে এ ব্যাপারে মা তাঁর সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিলেন।
অনেক সময় আমার মনে হয়েছে মা হয়তো ‘মেল গেজ’কে ধাক্কা দিতেই পোশাকের ব্যাপারে এত ডেয়ারিং ছিলেন। তবে শালীনতার সীমা পার করেননি।

মা ছিলেন অকপট। নিজের শর্তে জীবন কাটিয়েছেন। ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে বলতেন, ‘আমি এ নিয়ে একটা কথাও বলব না। আমার সঙ্গে জীবনের না-বলা কথাগুলো হারিয়ে যাবে। যদি কখনও জবাবদিহি করতে হয়, একমাত্র সোমার কাছে করব।’ পরিণত বয়সে এসে মা প্রায়ই আমাকে বলতেন, ‘এটা ভুল করেছি রে, ওটা আমার করা ঠিক হয়নি’। আমি বলতাম, ‘মা, ছেড়ে দাও। যা হওয়ার হয়ে গেছে। আমি তো তোমার সব মেনে নিয়েছি। হয়তো তোমার কিছুটা স্বার্থপর হওয়ার দরকার ছিল। নিঃস্বার্থ হয়ে বাঁচতে চাইলে কষ্ট পেতে হয়।’

আজ আমি জানি না আমার এই শোকের শেষ কোথায়। দিল্লি থেকে নীল (বড় ছেলে) এসেছে। তুলি এখন পুণেতে। বনি (ছোট ছেলে) অবশ্য কলকাতায়। মায়ের মতো তুলিও শক্ত মনের। তবুও কাঁদছে! আর কিছু দিন পরে ওরা চলে যাবে। শুধু আমি কী করব, জানি না।

অনুলিখন: সুদেষ্ণা বসু

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE