Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
অমিতাভ সংখ্যা ২

অমিতাভ এবং

রোল চাইছ না চিকেন রোল? নবাগত ছ’ফিট তিন ইঞ্চিকে তীব্র বিদ্রুপসহ বলেছিলেন বলিউডের জনপ্রিয় পরিচালক। আরেক জন বিখ্যাত অভিনেতা কাম ডিরেক্টর দিয়েছিলেন বোবার রোল। এমন সব তাচ্ছিল্যের স্তূপ থেকে জীবনে কী করে উত্তরণ ঘটেছিল তাঁর? গৌতম ভট্টাচার্য-র সামনে শীতের শেষ বিকেলে খোলামেলা অমিতাভ বচ্চনরোল চাইছ না চিকেন রোল? নবাগত ছ’ফিট তিন ইঞ্চিকে তীব্র বিদ্রুপসহ বলেছিলেন বলিউডের জনপ্রিয় পরিচালক। আরেক জন বিখ্যাত অভিনেতা কাম ডিরেক্টর দিয়েছিলেন বোবার রোল। এমন সব তাচ্ছিল্যের স্তূপ থেকে জীবনে কী করে উত্তরণ ঘটেছিল তাঁর? গৌতম ভট্টাচার্য-র সামনে শীতের শেষ বিকেলে খোলামেলা অমিতাভ বচ্চন

শেষ আপডেট: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০০:১৫
Share: Save:

ছবির স্ক্রিপ্ট যখন হাতে পেলেন, অস্বস্তি হয়নি? আপনি অমিতাভ বচ্চন! আপনাকে কিনা বলতে হবে আমার পটি হচ্ছে না, আমার মোশনের সঙ্গে ইমোশন জড়িয়ে, এই সব?

না, আমার অস্বস্তি কিছু হয়নি। বরং মনে হয়েছিল একটা চ্যালেঞ্জ, যার সামনে পড়ে আমাকে লড়তে হবে। একটা রাস্তা কিছু বার করতে হবে।

‘পিকু’ দেখে আপনার মেয়ের কেমন লেগেছিল?

শ্বেতার দারুণ লেগেছিল। ও বলেছিল, লাভলি ফিল্ম।

আপনার জীবনে এমন কোনও ভাস্কর ব্যানার্জিকে চিনতেন, যে বৃদ্ধ বয়সে নিজের শরীর নিয়ে এত স্বার্থপর যে মেয়েকে জ্বালিয়ে মারে?

আমি হয়তো দেখিনি। কিন্তু লেখিকা দেখেছেন। পরিচালক দেখেছেন। ওঁরা আমায় আন্দাজ দিয়েছিলেন চরিত্রটার রূপরেখা সম্পর্কে। কী জানেন, আমার বরাবরের ধারণা হল একটা ফিল্মের মধ্যে যখন সততা থাকে, তখন সেটা লোকের ভাল লাগে। ‘পিকু’র মধ্যে অনেস্টিটা খুব বেশি।

একটু আগে আপনি বলছিলেন ফিল্ম সংক্রান্ত ধ্যানধারণায় আমরা বড় বেশি সেলিব্রিটি আচ্ছন্ন। স্টার ড্রিভেন। তা হলে কি আপনি বলতে চান, সেই মোহের আবহাওয়ায় চিত্রনাট্যকার তার প্রাপ্য পায় না?

অবশ্যই পায় না। সবাই হিরো-হিরোইন নিয়ে দৌড়য়। কেউ ভাবে না একটা ফিল্ম কেন একটা নির্দিষ্ট ভাবে লেখা হল? কেন চরিত্রগুলো এ ভাবে ভাবা হল? আমার কাছে গল্পলেখক ফিল্মের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ, যে কেবল লিখছেই না। সে অভিনেতা-অভিনেত্রীকে স্ক্রিপ্ট পড়েও শোনাচ্ছে। এক হিসেবে সে ডিরেক্টরও।

কী বলছেন? অভিনেতার ইম্পর্ট্যান্স কিছু কম নাকি? ‘দিওয়ার’‌য়ের সংলাপ যা-ই লেখা হোক, আপনি ওই রকম অ্যাক্টিং না করলে ছবি দাঁড়াত?

‘দিওয়ার’‌য়ের অত শক্তিশালী স্ক্রিন প্লে আর তুখড় পরিচালনা ছবিটার সাফল্যের সবচেয়ে বড় কারণ। ‘দিওয়ার’ এমন একটা ফিল্ম যে চল্লিশ বছর পরেও লোকের মধ্যে প্রতিক্রিয়া জাগায়। এক সময় অবাকই লাগে। ‘দিওয়ার’ তৈরির সময় যারা কিনা জন্মায়নি, তারাও আজ ছবিটার সঙ্গে রিলেট করতে পারে। তার মানে ছবিটার মধ্যে কী পরিমাণ স্ট্রেংথ লুকিয়ে রয়েছে যে, এত দশক পরেও তার চুম্বক অক্ষত।

মিস্টার বচ্চন, আসল স্ট্রেংথ আপনার অভিনয়। ‘দিওয়ার’ রিলিজ করে ১৯৭৫-এ। আর তার চার বছর আগে রিলিজ হয় গাওস্কর ইন ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সত্তর দশকে বড় হওয়া স্কুলছাত্রদের সামনে ছিল মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব, নকশাল আন্দোলন আর দারিদ্র।

ভারতের তখনও কোনও বিলিওনেয়র ছিল না। একবারও ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ হতে তারা দেখেনি। বলা হত, ধূসরতম সেই আর্থসামাজিক পটভূমিতে একমাত্র রুপোলি রেখা ছিল পর্দায় অমিতাভ বচ্চনের বাঁ হাত আর বাইশ গজে সুনীল গাওস্করের ডান হাত।

এই বিশ্লেষণ মানেন?

মানি না। কী তুলনা করছেন? সুনীল গাওস্কর একজন এক্সেপশনাল ট্যালেন্ট! কেউ ওর জন্য স্ক্রিপ্ট লিখে দেয়নি। কেউ ওর জন্য লাইটিং করেনি। কেউ ওকে পরিচালনা করেনি। মানুষটা যা করার নিজে করেছে। একা করেছে। ওর দুনিয়াটা কী হিংস্র ছিল ভেবে দেখুন তো। ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাঠে ভয়ঙ্কর সব ফাস্ট বোলাররা ক্রমাগত হানা দিচ্ছে। একটা ভুল মানে মৃত্যু। আর সেখানে কিনা লোকটা শিরস্ত্রাণ ছাড়া একা যুদ্ধ করে জিতেছে। কী পরিমাণ ট্যালেন্ট দরকার। কী পরিমাণ সাহস দরকার!

আমি তো সেখানে স্ক্রিপ্ট রাইটার কি ডিরেক্টরের হাতের পুতুল। ওঁদের আজ্ঞাবহ। ওঁরা যে ভাবে বলেছেন, সেই নির্দেশ মেনে কাজ করেছি। ‘দিওয়ার’‌য়ের জন্য লেখককে ক্রেডিট দিন। ডিরেক্টরকে ক্রেডিট দিন। আমি তো অভিনেতা। আমি আর যাই হোক স্ক্রিপ্টের ওপর কী করে উঠতে পারি?

আপনার ডায়ালগ ডেলিভারি। ওই ব্যারিটোন, ওই হাইট, সেগুলোও তো ফ্যাক্টর ছিল?

ওভাবে বলেছি কারণ লাইনগুলো ও ভাবে লেখা হয়েছিল। আমার মনে হয়েছিল এই অসাধারণ সব সংলাপ এ ভাবেই বলা উচিত। সেটা ক্লিক করে গিয়েছে এই সত্যটা অব্যাহত রেখেই যে মূল কৃতিত্ব পরিচালক আর সংলাপ লিখিয়েদের।

‘দিওয়ার’ যখন পরবর্তী কালে দেখেছেন খুব উজ্জীবিত লেগেছে কি? আজও বলা হয়ে থাকে, সিস্টেমের বিরুদ্ধে ব্যক্তির একক সংঘর্ষ — এমন সামাজিক চেতনা তখনকার দিনে ‘দিওয়ার’ দিয়েছিল।

আমি ‘দিওয়ার’ নিয়ে পরবর্তী কালে যখন ভেবেছি, মনে পড়েছে একটা পারফেক্ট স্ক্রিপ্টের কথা। শ্যুটিংয়ের ফাঁকে কাটানো অবিস্মরণীয় কিছু মুহূর্তের কথা। আমার দেখে চমৎকৃত লাগে নতুন জেনারেশন কী করে ফিল্মটার সঙ্গে এত ভাল আয়ডেন্টিফাই করে। আবার বলি লিখিত শব্দের ম্যাজিক।

এটা বিশ্বাস করতে হবে যে, আপনাকে কেউ কখনও বলেনি পর্দায় আপনার অভিনীত রাগী যুবকের চরিত্রগুলো কত অনুপ্রেরণামূলক ছিল?

এটুকু বলতে পারি, যখন দেখতে পাই ভারতীয় হিসেবে কারা কারা আন্তর্জাতিক দরবারে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে এবং সেই তালিকায় কোনও ক্রমে নিজের নামটা থেকেছে, তখন একটা তৃপ্তির অনুভূতি হয়। ভারতীয় হিসেবে তখন নিজেকে গর্বিত লাগে।

কোনওক্রমে থেকেছে? আপনি এত বিনয়ী যে আপনাকে ইন্টারভিউ করাটাই সমস্যা।

আরে না না। বিনয় নয়। আমি যা বলছি মন থেকে বলছি।

বহু বছর আগে আপনি একটা ছবি করেছিলেন, যা একেবারেই চলেনি। নাম ছিল ‘আলাপ’।

হুম।

লোকের মনে হয়েছিল, বাঁ হাতে বন্দুক কোথায়? এ তো বসে সেতার বাজাচ্ছে। এই ছবি দেখা কেন? আজকের দিনে কি মনে হয়, অডিয়েন্স অনেক বেশি ম্যাচিওর্ড? আজ এই সব ঝুঁকি নেওয়াই যায়?

অফ কোর্স। অডিয়েন্স অনেক বেশি ম্যাচিওর্ড। যদিও আমরা কতটা বদলেছি, জানি না। কোনও কোনও জিনিস দর্শক নেয়। কোনও কোনও জিনিস প্রত্যাখ্যান করে। কোনও সর্বসম্মত গ্রামার নেই। মনে রাখবেন, জন ওয়েন কখনও ঘোড়ায় চড়েননি। অথচ ওঁকে ধরা হয়, গ্রেটেস্ট এভার আমেরিকান অ্যাক্টর।

আপনার কি এখনও প্রতি শুক্রবার ছবি রিলিজের টেনশন হয়?

নিশ্চয়ই। সেই শুক্রবারগুলো ভয়ঙ্কর যায়। আপনি কখনও বুঝবেন না, ভাগ্যে কী আছে? ভয় থাকে। নানান রকম আশঙ্কা ভিড় করে আসে।

আজ এত বছর বাদেও হয়?

সব সময় হয়। ইট হ্যাজ বিন উইথ মি।

প্রায় লেবার পেন?

অলমোস্ট সে রকম।

সেই সত্তর-আশির দশকে আপনি কিন্তু অ্যাকশন ছবিতে কাজ করার পাশাপাশি, হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের ফিল্মগুলোতে এক্সপেরিমেন্ট করে যাচ্ছিলেন।

আমি এক্সপেরিমেন্ট শব্দটা একেবারেই বলব না। সেটা হৃষীদাকে খুব অশ্রদ্ধা করা হবে।

সরি। এক্সপেরিমেন্ট শব্দটা সত্যিই ঠিক না।

আসলে হৃষীদা এমন একজন — হি ওয়াজ এক্সেপশনাল। ইন্ডাস্ট্রির এত সব এস্কেপিস্ট ফ্যান্টাসির দুনিয়াতেও হৃষীদা নিজের জন্য একটা মিডল পাথ বেছে রাখতে পেরেছিলেন। উনি খুব লেফটও ছিলেন না। রাইটও না। কিন্তু মাঝামাঝি রাস্তাটাই কী দুরন্ত বেছেছিলেন!

আজও কলকাতায় লোকে বসে টিভিতে মুগ্ধ হয়ে ‘অভিমান’ দেখে। ‘মিলি’ দেখে। কৌতূহল হয় আপনি বা জয়াজি কখনও এই ছবিগুলো নিয়ে আলোচনা করেন?

বাড়িতে যে খুব ডিসকাশন হয়, তা নয়। তবে লোকে এসে অনেক সময় বলে। পুরনো স্মৃতিগুলো ভিড় করে আসে। কী কী সব মুহূর্ত কাটিয়েছি ছবিগুলো হওয়ার সময়! ভুলতে পারি না। ভীষণ নস্টালজিক লাগে সময় সময়।

আপনার জীবন একটা বৈশিষ্ট্য পেশ করে রেখেছে। টার্নিং সেট ব্যাকস ইনটু কামব্যাকস।

আমার জীবন মোটেও এক্সট্রা অর্ডিনারি কিছু নয়। ব্যর্থতায় গড়িয়ে গিয়ে জীবনে ওঠার চেষ্টা তো অনেকেই করেছে। আমি নতুন কী করলাম?

কী বলছেন? ধারাবাহিক ব্যর্থতার স্তূপ থেকে এমন অকল্পনীয় উদ্ধার। আর তার পর টানা এত দশক রাজত্ব — এমন নমুনা ক’টা আছে?

আমি এটুকু বলতে পারি যে, ব্যর্থতা জীবনে খুব উপকারী। কারণ ব্যর্থতাই পথনির্দেশ করে। সাফল্য নয়। ব্যর্থতাই শেখায়। বোঝায় এই ভুলগুলো আবার কোরো না। তা হলে আবার প্রত্যাখ্যাত হবে। ব্যর্থতার আলোই জীবনের রাস্তা চলার পক্ষে আদর্শ।

আপনার বেলা তো শুধু ব্যর্থতা ছিল না। ছিল প্রচণ্ড অপমানিত হওয়ার নানা ঘটনা। শুনেছি মনমোহন দেশাইয়ের সঙ্গে নিউকামার আপনি দেখা করেছিলেন। সত্যি মিথ্যে জানি না। তখন আপনার সেই সময়কার চেহারা দেখে আঁতকে উঠে নাকি মনমোহন বলেছিলেন, ‘‘ভাই, কী চাইছ ঠিক করে বলো তো। রোল না চিকেন রোল?’’

(অমিতাভের মুখচোখ দেখে মনে হল, প্রশ্নটা একেবারে অতর্কিতে এসেছে। এত বছর পর উঠবে ভাবতে পারেননি। দ্রুত অবশ্য সামলে নিলেন।)

কী করে আশা করেন প্রতিষ্ঠিত একজন পরিচালক সড়ক থেকে উঠে আসা একটা ছেলের ওপর নিমেষে সদয় হয়ে যাবে? আপনার জন্য তো কোনও রেফারেন্স পয়েন্ট নেই। কোনও পারফর্ম্যান্স নেই। যতক্ষণ না কেউ আপনাকে সুযোগ দিচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত নিজের জন্য স্বীকৃতি আপনি কী করে আশা করতে পারেন? যাদের কাছে কাজ চাইছেন, তাদের মধ্য থেকে পারফর্ম করলে তবেই না তাদের বিশ্বাস জাগবে। নিউকামারকে তো অপেক্ষায় থাকতেই হয়।

কিন্তু সুযোগ দিয়েও তো লোকে চরম তাচ্ছিল্য করতে পারে। সুনীল দত্ত আপনাকে সুযোগ দিয়েছিলেন ‘রেশমা অউর শেরা’ ছবিতে।

অথচ দিয়ে আপনার রোলটা করে দিলেন বোবা আর কালা। আপনার এক বন্ধু (নামটা বললাম না এখানে। অমর সিংহ নামটা শুনলে আজকের অমিতাভ কী ভাবে রিঅ্যাক্ট করতেন জানি না।) আমায় বলেছিলেন, এর চেয়ে অবিচার কেরিয়ারের শুরুর দিকে আর কী হতে পারে? দেশের সবচেয়ে বিখ্যাত কণ্ঠস্বরকে কিনা করে দিল বোবা!

দেখুন আমি এগ্রি করব না। আমার কাছে ওটাও ছিল একটা ইন্টারেস্টিং রোল। আজ পিছনে ফিরে তাকিয়ে অনেক কিছু বলে ফেলা সম্ভব। কিন্তু তখন তো তাৎক্ষণিক ভাবেই সিদ্ধান্তটা নিতে হয়েছিল। কেউ কি সুনির্দিষ্টভাবে জানে যে, ওটা ইচ্ছাকৃতভাবে আমার প্রতি অবিচারের জন্য করা হয়েছিল? কোনও প্রমাণ আছে? তা ছাড়া এটা ধরে নেওয়া খুব ঔদ্ধত্বপূর্ণ হবে যে, আমার গলা একটা দারুণ কিছু। গোটা দেশে অনেক মানুষ আছেন যাদের গলা ভাল। তো আমি কী এমন হনু! কেন লোকে এই রোলটা নিয়ে আজও কথা বলে জানি না। উচিত নয় এ ভাবে বলা।

কী বলছেন?

ঠিক বলছি। তা ছাড়া রিজেকশন তো জীবনের অঙ্গ। কোনও না কোনও স্টেজে লোকে আপনাকে ফিরিয়ে দেবেই। এ বার সেই ফিরিয়ে দেওয়াটাকে নিয়ে আপনি কী করবেন, কী ভাবে ব্যবহার করবেন, বাকি জীবনে সেটা একান্ত আপনার ব্যাপার। হয়তো সেই প্রত্যাখ্যান আপনাকে হুড়হুড় করে নীচে নামিয়ে দিল। আবার শুরু করুন সেই তলদেশ থেকে।

এই রকম একটা ভাবনা থেকেই কি আপনি ‘কুলি’র শ্যুটিংয়ে ওই সিনটা করেছিলেন?

ওই সিন বলতে?

আপনি যখন শ্যুটিংয়ে চোট পেয়ে প্রায় মৃত্যুমুখে, কেউ ভাবেনি ক্যামেরার সামনে ফেরা সম্ভব হবে বলে। অথচ আপনি শুধু ফিরলেন না, ঠিক ওই দৃশ্যটা থেকে শ্যুটিং শুরু করতে বললেন, যে সিনটায় আপনার চোট লেগেছিল। এটাও তো রক বটম থেকে এক ধরনের কামব্যাক।

আরে, না, না। আজ ভাবলে মনে হয় স্টুপিড ব্রাভাডো ছিল ওটা। বোকা বোকা বাহাদুর হওয়ার চেষ্টা। ওই হয় না লোকে বলে যে, ভাই ঘোড়া থেকে পড়ে শেষ কোরো না। শেষ করো আবার সেই ঘোড়ায় চেপে। (হাসি) আজ হাসি পায়। চাইল্ডিশ ব্রাভাডো।

রাজনীতিতে বিধ্বস্ত হতে হতে ভিপি সিংহের সঙ্গে লড়াইটাও তো খুব রোমহর্ষক।

হুম (সোজা হয়ে বসলেন যেন ঘরের কোথাও ভিপি বসা)।

ভিপি নাকি হুমকি দিয়েছিলেন ক্ষমতায় এলে আপনাকে প্রথম জেলে পুরবেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়া মাত্র আপনি নাকি চিঠি লিখে বলেন, তিন মাস দিচ্ছি। ক্ষমতা থাকলে আমায় জেলে পুরে দেখান।

এ সব অনেক পুরনো দিনের কথা। আজকাল আর মাথাতেও আসে না (হাসি)।

কিন্তু এই স্পর্ধাটাও তো নীরব কামব্যাক?

আমি কেবল এটুকুই বলতে পারি, আপনি যদি জানেন, ন্যায়ের পথে আছেন, কোনও রকম অন্যায়ের সঙ্গে আপনি যুক্ত নন, তা হলে বাকি পৃথিবী উল্টো ভাবলেও কিছু আসে যায় না। সাহস আপনাআপনি আসবে। আমার মনে হয়েছিল উনি ক্ষমতাশালী তো কী! আমি তো কোনও দোষ করিনি। আমি খামোখা মাথা নোয়াতে যাব কেন?

এবিসিএল-ও তো আপনার জীবনে সাঙ্ঘাতিক ব্যর্থতা নিয়ে হাজির হয়েছিল। সেই উথাল পাথাল থেকে কী শিখেছিলেন?

এবিসিএল বোধহয় তার সময়ের আগে আবির্ভূত হয়েছিল। ব্যর্থতা থেকে আমি শিখি যে, সফল ব্যবসায়ী হওয়ার প্রয়োজনীয় উপাদান আমার মধ্যে নেই। এবিসিএল আমাকে শেখায়, তুমি যেটুকু পারো, তার মধ্যে থাকো। বাইরে যাওয়ার আহাম্মকিটা কোরো না। এবি কর্প নিয়ে অভিজ্ঞতা আমায় এটাই শিখিয়েছিল যে তোমার যে অঞ্চলটায় দুর্বলতা, সেখানে ঘোরাঘুরি করাটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তুমি এ সব জায়গায় না ভিড়লেই বরঞ্চ সুখী থাকবে।

কিন্তু এবিসিএল-এর তো ইন্ডাস্ট্রির উপর ঐতিহাসিক প্রভাব।

(কিছুটা আনমনা অথবা পুরনো ব্যর্থতার স্মৃতিতে কাতর) আজকের দিনে ইন্ডাস্ট্রিতে কর্পোরেটাইজেশন তীব্র গতিতে চালু হয়ে গিয়েছে। আমরা তো অনেক তফাত দেখছি। ম্যানেজমেন্ট প্রসেস চালু হয়েছে। সব কিছু কম্পার্টমেন্টালাইজড। আমার মনে হয়েছিল, এ ভাবে ব্যক্তিগত খামখেয়ালিপনা বা অধিকারের ওপর এত বড় ইন্ডাস্ট্রি চলতে পারে না। সিস্টেম দরকার। অ্যাকাউন্টেবিলিটি দরকার। আমি সেই সময় ব্যক্তিগত সফরে আমেরিকা গিয়েছিলাম। তখনই প্রথম মনে হয়, আমাদের দেশে এ জিনিসটা চালু হওয়া উচিত।

সে জন্যই তো বলছি, তখনকার মতো ব্যর্থ হলেও এবিসিএল গেম চেঞ্জার।

নাহ্, পারিনি আমরা। রাস্তা ঠিক বেছেছিলাম কিন্তু কাজটা করে উঠতে পারিনি। উই কুড নট ডু ইট। রূঢ় বাস্তব এটাই।

মিস্টার বচ্চন, আপনাকে যত দেখি তত মনে হয় লোকে আপনার অভিনয়ের কথা বলে। হাইট নিয়ে চর্চা করে। ব্যারিটোন নিয়ে গদগদ থাকে। কিন্তু কোথাও যেন মনে হয়, আপনার আসল ক্যারিসমা ইস্পাতকঠিন মন। আপনি একমত?

হাঃ হাঃ হাঃ। তাই মনে হয় বুঝি? আই ডোন্ট নো (হাসি)। নিজেকে আমি সেই কাটাছেঁড়া করে দেখিনি। আপনার কেন মনে হল?

আপনার এই নেভার সে ডাই অ্যাটিটিউড দেখে। কোনও কিছুই যেন আপনার বিক্রমকে দমাতে পারে না। আপনি কি মনেও কখনও হারেন না? মাঠের হিসেব বাদ দিলাম...

মনে হারি কি না? হু হু হু... কখনও সখনও হারি না কে বলল!

দু’-একটা হারার কথা বলুন না।

থাক। অল অব হোয়াট গোজ অন ইন্টারনালি ডাজ নট নিড টু গেট পাবলিক। সব কিছু বাইরে বার হওয়ার দরকার নেই।

খুব সুন্দর বললেন। কিন্তু একটা ব্যক্তিগত প্রশ্নের উত্তর আপনাকে দিতেই হবে।

সেটা কী?

তৃতীয় ও শেষ কিস্তি আগামী সোমবার

আপনি চারপাশ থেকে উড়ে আসা ঈর্ষার বিষ কী ভাবে সামলান?

(বচ্চনের নীরব কৌতূহলী চাউনি বলতে চাইছে, হঠাৎ এই প্রশ্ন?)

একটু ব্যাখ্যা করি। টপ পারফর্মারদের অনেকে বিভিন্ন সময়ে অসম্ভব সাফল্য পেয়েও এই একটা জিনিস সামলাতে বিপন্ন হয়ে গিয়েছেন। হিংসে। আপনার সম্পর্কেও তো বিভিন্ন সময়ে নানান কথা বলাটলা হয়েছে। আপনার ঘনিষ্ঠ ইন্ডাস্ট্রির লোকজনই বলেছে। অথচ আপনি কখনও রিঅ্যাক্ট করেননি।

যদি কারও আমার সম্পর্কে কিছু বলার থাকে, তা হলে সেটা একান্তই তাদের মতামত। আমি সেই মতামতের সঙ্গে একমত হতে পারি। দ্বিমত পোষণ করতে পারি। কিন্তু সেটা পাবলিক করতে যাব কেন? আমি তার প্রয়োজন দেখি না। মনে করুন, আপনি আমার সম্পর্কে তীব্র সমালোচনামূলক কিছু বলেছেন। এ বার আমি তো আপনাকে ডেকেই সেটা পরের দিন বলতে পারি। পাল্টা বিবৃতি দিতে আবার প্রিন্ট মিডিয়ায় ছুটব কেন? জাস্ট বিকজ লোকে সেটা পড়বে বলে!

কারণ আমি আপনাকে কোটি কোটি ফ্যানের সামনে বেইজ্জত করেছি। আপনি আমায় একান্তে প্রতিবাদ করলেন, কি ক্ষোভ প্রকাশ করলেন — কেউ তো জানতেও পারল না।

হতে পারে। দ্যাট’স ইয়োর ওয়ে অব লাইফ। দিস ইজ মাই ওয়ে অব লাইফ।

আপনার মধ্যে কি এই বৈশিষ্ট্যটা বরাবর ছিল? না কি সময়ের সঙ্গে তৈরি করা?

তৈরি করতে যাব কেন? আমি বরাবর এ রকম। বরাবর আমার প্রবৃত্তি, আমার অ্যাটিটিউড, আমার রুচি এ রকমই। এ ভাবেই নিজেকে চালাতে চেয়েছি। আর চালিয়েওছি।

মন থেকে প্লিজ বলুন। যত উড়িয়ে দিন, যত উপেক্ষা করুন, হিংসের এই সব বিষে ভেতরে ভেতরে রক্তক্ষরণ হয় না? ডোন্ট ইউ ব্লিড ইন্টারনালি?

হোয়াট উইল ইউ গেট বাই ব্লিডিং? কী পাবেন মনের মধ্যে যুদ্ধ করে? কোনও ফায়দা হবে? সিস্টেমের বাইরে বরং বার করে দেওয়া ভাল। আপনি নিজে যদি জানেন, আপনি কে! সেটাই তো যথেষ্ট।

কে কী ভাবল? কে কী বলল নিয়ে অনর্থক নেগেটিভিটিতে আক্রান্ত হতে যাবেন কেন?

ছবি: সাত্যকি ঘোষ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE