Advertisement
১৭ এপ্রিল ২০২৪

বন্ধু বোধহয় বছরের সেরা ছবিটা বানিয়ে ফেলেছে

তাঁর নাকি ইচ্ছে ছিল ‘পিকু’ সিনেমাটা বানানোর। কিন্তু বন্ধু সুজিত সরকার আগেই বানিয়ে ফেলল। হাসতে হাসতে বললেন সুজয় ঘোষ। শুনলেন ইন্দ্রনীল রায় তাঁর নাকি ইচ্ছে ছিল ‘পিকু’ সিনেমাটা বানানোর। কিন্তু বন্ধু সুজিত সরকার আগেই বানিয়ে ফেলল। ‘স্যাক্রিফাইসিং বাঙালি’, তাই এ বারের জন্য ছেড়ে দিলাম। কিন্তু এটার জন্য ছাড়লাম না যে ও বাঙালি, ছাড়লাম কারণ আমার বন্ধু সুজিত সরকার বড্ড ভাল একজন মানুষ। হাসতে হাসতে বললেন সুজয় ঘোষ। শুনলেন ইন্দ্রনীল রায়

শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০১৫ ০০:০১
Share: Save:

সারা জীবন ওর উপর একটা ‘জেলাসি’ ঠিক থেকে যাবে।

বানালি তো বানালি, তুই ‘পিকু’ বানালি!

আরে মানছি তোরটায় ‘ইউ’ আর মানিকবাবুরটায় দু’টো ‘ও’— কিন্তু ‘পিকু’ তো!

বহু দিনের সুপ্ত বাসনা ছিল ‘পিকু’ টাইটেলটা ব্যবহার করব নিজের কোনও ছবিতে। কিন্তু ঠিক আমাকে মেরে বেরিয়ে গেল ব্যাটা।

‘স্যাক্রিফাইসিং বাঙালি’, তাই এ বারের জন্য ছেড়ে দিলাম। কিন্তু এটার জন্য ছাড়লাম না যে ও বাঙালি, ছাড়লাম কারণ আমার বন্ধু সুজিত সরকার বড্ড ভাল একজন মানুষ।

‘স্যর, নো টিথ ক্লিঞ্চিং ফর দিস রোল’

আমার আর সুজিতের একটা বিরাট মিল, আমরা দু’জনেই অমিতাভ বচ্চনের অন্ধ ভক্ত। এ ব্যাপারে আমার কাছে কিন্তু একটা কিংবদন্তি গল্প আছে।

মনে আছে, একদিন আড্ডা হচ্ছে আমার, সুজিত আর মিস্টার বচ্চনের। সুজিত ওঁকে একটা রোল শোনাচ্ছে। চরিত্রটা চুপচাপ, শান্ত একজন মানুষের। হঠাৎ করে সুজিত দেখি মিস্টার বচ্চনকে বলছে, ‘‘স্যার, নো টিথ ক্লিঞ্চিং ফর দিস রোল।’’ যার বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়, ‘কোনও দাঁতমুখ খিঁচানো নেই এই রোলটায়’।

অমিতাভ বচ্চনের সামনে কেউ যে এমন বলতে পারে, আমি সুজিতকে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। বস, এটা বলতে প্রচুর সাহস লাগে ওই মানুষটার সামনে।

কিন্তু পরে বাড়ি গিয়ে ভেবে দেখেছি, এই অনেস্ট আর সিম্পল স্টাইলের জন্যই সুজিত আজ এই জায়গায় পৌঁছেছে। ওই একটা লাইনে কিন্তু ও একজন অভিনেতাকে বুঝিয়ে দিল ও ঠিক কী চাইছে তার কাছে।

ওই মানুষটার প্রতি আমাদের অসীম শ্রদ্ধা

অনেকে আমাকে এটাও জিজ্ঞেস করেছে, কী এমন পাসওয়ার্ড জানা আছে আমার আর সুজিতের যে, মিস্টার বচ্চন আমাদের এত ভালবাসেন—বার বার আমাদের সুয়োগ দেন ওঁর সঙ্গে কাজ করার।

আমার কাছে এই প্রশ্নের একটাই উত্তর। ওই মানুষটার প্রতি আমাদের দু’জনেরই অসীম শ্রদ্ধা। এটা হয়তো মিস্টার বচ্চন নিজেও জানেন। এবং সত্যি বলতে আমি আর সুজিত যতই তাঁর সঙ্গে আড্ডা ইয়ার্কি মারি, ওই মানুষটার সঙ্গে একটা সীমা রেখেই আমরা মিশি, তার বেশি না। ওই মাপের মানুষের এই স্পেসটা দরকার হয়। আর আমরা সসম্মান তাঁকে সেই স্পেসটা দিই।

মিস্টার বচ্চন আর একটা জিনিসও জানেন আমাদের দু’জনের ক্ষেত্রেই। তাঁর এতদিনকার ইমেজ, ইন্ডাস্ট্রিতে তাঁর সম্মান— অমিতাভ বচ্চনের এনিগমা-টা আমরা কোনও মতেই আমাদের সিনেমাতে ছোট করব না। যে মর্যাদা উনি ডিজার্ভ করেন, সেটা তাঁকে দিতে আমরা দু’জনেই বদ্ধপরিকর। এটাই বোধহয় মানুষটার ভেতরে ঢোকার পাসওয়ার্ড।

‘কহানি’র সঙ্গে অদ্ভুত যোগ রয়েছে

অনেকেই জানে না, ‘কহানি’র সঙ্গে কিন্তু আমার বন্ধু সুজিতের একটা গোপন সম্পর্ক রয়েছে। সে কথায় পরে আসছি।

এমনিতে আমরা ভীষণ ভাল বন্ধু, একদম তুই-তোকারি সম্পর্ক। আজও মনে আছে ওর সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ হয়েছিল বিশাল-শেখরের স্টুডিয়োতে।

আমার ‘আলাদিন’ তত দিনে রিলিজ করে ফ্লপ করেছে। ‘কহানি’র কাজ শুরু করেছি এবং তার জন্য ক্যামেরাম্যান খুঁজছি। বিশাল-শেখরের স্টুডিয়োতেই সুজিত আমাকে ক্যামেরাম্যান রঞ্জন পালিতের সঙ্গে কথা বলতে বলে। যেমন আদেশ, তেমনই কাজ। রঞ্জনদার সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম র়ঞ্জনদা তত দিনে ‘সাত খুন মাফ’ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।

রঞ্জনদাই তখন আমাকে ওঁর ভাইপো সেতুর সঙ্গে কথা বলতে বলে। সেতুই পরবর্তী কালে ‘কহানি’তে আমার ডিওপি ছিল। ভাবলে কাকতালীয় লাগে কিন্তু সব সময়ই মনে হয়েছে কী অদ্ভুত একটা ইনডায়রেক্ট যোগাযোগ সুজিতের সঙ্গে রয়ে গিয়েছে ‘কহানি’র। মাঝে মধ্যে অনেকেই জিজ্ঞেস করে, কালকে ‘ভিদ্যা বাগচি’ যদি ওর ছবিতে কাজ করে তা হলে আমার কেমন লাগবে? তাদের একটাই উত্তর দিই। আমার কোনও রিঅ্যাকশনই হবে না। জিরো রিঅ্যাকশন ইজ মাই রিঅ্যাকশন।

আমি ভাবতেই পারিনি তুই এ রকম ছবি বানাতে পারিস

এমনিতে সুজিতের সবচেয়ে বড় গুণ, ও অসম্ভব অনেস্ট আর স্ট্রেট ফরোয়ার্ড। ‘মুখে লজ্জা, পেটে খিদে’— ব্যাপারটাই নেই ওর মধ্যে।

মনে আছে ‘কহানি’ রিলিজের পর একদিন ফোন করল সুজিত। অনেকেই ফোন করে তখন কনগ্র্যাচুলেট করেছিল। কিন্তু সুজিতের ফোনটাই ছিল অন্য রকম। ফোন করে সোজা বলল, ‘‘শোন, আমি ভাবতেই পারিনি তুই এ রকম ছবি বানাতে পারিস।’’

ভাবা যায় কেউ ও রকম বলছে! ও কিন্তু এতটাই অনেস্ট।

আর একটা জিনিস সুজিতের খুব ভাল লেগেছিল, সেটা অমিতাভ বচ্চনের গলায় ‘একলা চলো রে’। ওই গানটা গাইবার জন্য আমি অমিতাভ বচ্চনের সামনে প্রায় বাচ্চাদের মতো জেদ করেছিলাম। মিস্টার বচ্চন প্রস্তাবটা শুনে আমাকে প্রথমেই বলেছিলেন, ‘‘আমি রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে গেলে যদি কোনও ভুল হয়, আমি কিন্তু বৌয়ের কাছে প্রচণ্ড মার খাব সুজয়।’’ পরে ওঁকে রাজি করানোর পর দেখেছি মানুষটা এতটাই পারফেকশনিস্ট যে প্রত্যেকটা শব্দের উচ্চারণের ব্যাপারে কী সাঙ্ঘাতিক সাবধানী তিনি।

সুজিত সেই ফোন করেই বলেছিল, ‘‘অমিতাভ বচ্চনকে দিয়ে ‘একলা চলো রে’ গানটা গাওয়ানো ‘কহানি’র মাস্টারস্ট্রোক।’’

বন্ধুকে যেহেতু এত ভাল চিনি, জানতাম আমার প্রতি কতটা ভালবাসা, কতটা অনেস্টি ছিল ওই কথাগুলো বলার মধ্যে।

কিন্তু শুধু একটা জায়গাতেই ও ব্যাটা ডিসঅনেস্ট। দেখা হলেই বলে, ও নাকি অসম্ভব ভাল রাঁধে। বিশ্বাস করুন, আজ অবধি কোনও দিনই ও রান্না করে খাওয়ায়নি। এটুকু বুঝেছি, রান্নার ব্যাপারে ‘পিকু’র পরিচালক পুরোটাই মুখেন মারিতং জগৎ...

আজকাল তো খাবার কথা বললেই বলে ও ডায়েট করছে। আরে, অত ডায়েট করে, অত ফুটবল খেলেও একটা লোকের যে কী করে একটা নোয়াপাতি ভুঁড়ি থাকে কে জানে?

কথায় কথায় আর একটা কথা আপনাদের বলতে ইচ্ছে করছে। অমিতাভ বচ্চনের প্রতি অসম্ভব শ্রদ্ধা ছাড়াও আরও একটা মিল আছে আমাদের দুজনের। তা হল, কলকাতা, বাঙালিয়ানার প্রতি একটা অদ্ভুত ভালবাসা আর দায়িত্ব।

আমি না-হয় কলকাতায় বড় হয়েছি। সুজিত বড় না হলেও ও অসম্ভব ভালবাসে শহরটাকে। ওর ফ্যামিলি তো কলকাতাতেই থাকে। কলকাতার প্রতি, সকালের লুচি-তরকারি, রোববারের মাংস-ভাতের প্রতি আমাদের ভালবাসার জন্যই আমরা কলকাতাকে কিছু ফেরত দিতে চাই। জীবনের যেখানেই আমরা পৌঁছে থাকি না কেন, সেই জায়গায় পৌঁছনোর পিছনে কলকাতার যে একটা বিরাট হাত আছে, সে ব্যাপারে আমরা দুজনেই একমত। সে জন্যই বোধহয় শহরটাকে কিছু ফেরত দিতে চাই। সে জন্যই তো সুজিত ‘ওপেন টি বায়োস্কোপ’ প্রোডিউস করে, সে জন্যই তো আমি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ওপর শর্ট ফিল্ম বানাই।

মন থেকে ফেরত দিতে চাই বলেই তো ‘ভিদ্যা বাগচি’ কলকাতা পৌঁছে যায়। ফেরত দিতে চায় বলেই তো শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড়ে অমিতাভ বচ্চনকে দিয়ে সাইকেল চালানোর শট নেয় আমার বন্ধু।

নো ঘ্যানঘ্যান টাইপস

সময়টা যদি একটু পিছিয়ে দিই তা হলে এটা বলতেই হয়, আমি কিন্তু সুজিতের ফ্যান ওর প্রথম ছবি থেকেই। ‘ইয়াহা’ দেখে মনে হয়েছিল কী সুন্দর, শান্ত একটা ছবি বানিয়েছে সুজিত। সেই সময় মানে ২০০৫-০৬য়ে মুম্বইয়ে কিন্তু ওর প্রধান পরিচয় ছিল, ও একজন বড় অ্যাডফিল্মমেকার। কিন্তু অনেক অ্যাড ফিল্মমেকারদের দেখেছি, অ্যাড ফিল্ম বানাতে বানাতে ঘ্যানঘ্যান করে, কবে ফিচার ফিল্ম বানাবে তা নিয়ে। সুজিত কিন্তু একেবারে ‘নো ঘ্যানঘ্যান টাইপস’।

‘সোল’ বিক্রি করে দিচ্ছিস

এমনিতে ওর সঙ্গে যে আমার ঝগড়া হয় না, তা কিন্তু নয়। আমরা এমন একটা ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করি যেখানে সব কথা সোজাসুজি বলা যায় না বা বলা ঠিকও নয়। যেমন ধরুন কোনও ছবি দেখলাম, সেটা ভাল না-লাগলেও যেহেতু সেটা বন্ধুবান্ধবের ছবি, তাই হয়তো টুইটারে দু’-একটা ভাল কথা লিখে দিলাম।

সুজিতের এ ব্যাপারে রয়েছে প্রচুর আপত্তি। এ রকম কিছু দেখলেই পরের দিন আমাকে ফোন করে বলে, ‘‘আমি কি তা হলে সিনেমা একেবারেই বুঝছি না? আমার তো ছবিটা ভাল লাগেনি। কিন্তু টুইটারে দেখলাম তুই লিখেছিস তোর ভাল লেগেছে! সত্যিই কি ভাল লেগেছে?’’ আমি হয়তো আমতা আমতা করছি। ঠিক সেই সময় শুরু হবে ওর ঝাড়। ‘‘তুই নিজের সোল বিক্রি করে দিচ্ছিস’’, ‘‘ভাল লাগেনি তো কেন লিখলি’’— অনেকক্ষণ ধরে চলল এই ঝগড়া। এই হল সুজিত।

হাতির ব্যাপারে সব জানে

আচ্ছা, হাটে যখন হাঁড়ি ভাঙছি, তখন আরও কিছু কথা বলেই ফেলি আজকে আপনাদের সুজিতের ব্যাপারে।

আপনারা অনেকেই জানেন না, সুজিত কিন্তু হাতির ব্যাপারে সব জানে। হ্যাঁ, সব জানে। আর প্লিজ মনে করবেন না আমি ইয়ার্কি মারছি।

ও যখন ছোটবেলায় ডুয়ার্সে ছিল, তখন প্রচুর হাতি ছিল ওদের বাড়ির আশেপাশে। হাতিকে কী ভাবে পোষ মানানো যায়, বাচ্চা হাতিকে তার মায়ের কাছ থেকে কী ভাবে সরাতে হয়, হাতি কী ভাষায় কথা বলে— সব সুজিতের নখদর্পণে। কোনও দিন যদিও আমি দেখিনি, কিন্তু ওর সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি হাতি সম্পর্কে কী সাঙ্ঘাতিক ওর প্যাশন। এটা বোধহয় ওর চরিত্রের এমন একটা দিক যেটা ও চট করে মানুষকে বলতে চায় না।

এ ছাড়া আর একটা দিক আছে আমার বন্ধুর। ও সাঙ্ঘাতিক রাজনীতি সচেতন এক মানুষ। সকালবেলা খুঁটিয়ে পেপার পড়ে, নিয়মিত টিভিতে রাজনৈতিক বিতর্ক দেখে। ভারতের কোথায় কী হচ্ছে— সব কিছুর খবর রাখে। মানে ও এতটাই সচেতন যে মাঝেমধ্যেই মনে হয়, ফিল্ম মেকার না হলে আরামসে আমাদের সুজিত পলিটিশিয়ান হতে পারত। এতটাই গুরুগম্ভীর ওর জ্ঞ্যান।

এ মাসের শেষে যখন কলকাতায় আসব তার এক সপ্তাহ পরেই ৮ মে অমিতাভ-দীপিকা-ইরফান অভিনীত ‘পিকু’ রিলিজ করবে। ওর ঘনিষ্ঠ বলে বলছি না, কিন্তু যতটুকু ট্রেলারে দেখেছি মনে হয়েছে, এ বছরের সেরা হিন্দি ছবিটা ও বানিয়ে ফেলেছে।

হয়তো আমি বাঙালি বলে, আরও আইডেন্টিফাই করতে পারছি চরিত্রগুলোর সঙ্গে। কিন্তু বেসিক ইমোশনগুলো (এবং মোশনগুলো তো বটেই) পৃথিবীর সর্বত্র এক। এটাই ‘পিকু’র ইউএসপি। আর এটার জন্যই মন বলছে পুরো দেশে ‘পিকু’ সুপারহিট হবে।

কিন্তু অনেকক্ষণ ধরে এত সব ভাল ভাল কথা বলেও বলছি, সুজিতের ওপর আমার ‘জেলাসি’টা কিন্তু গেল না।

আমার আগে ‘পিকু’র টাইটেলটা নিয়ে ঠিক ছবি বানিয়ে দিল ব্যাটা...

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE