Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

গুরুদক্ষিণা

নাটকের সেন কি ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছেন সিনেমায়? উত্তর খুঁজতে কৌশিক সেন -এর মুখোমুখি দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়নাটকের সেন কি ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছেন সিনেমায়? উত্তর খুঁজতে কৌশিক সেন -এর মুখোমুখি দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়

‘কিরীটী ও কালো ভ্রমর’‌য়ে কৌশিক সেন

‘কিরীটী ও কালো ভ্রমর’‌য়ে কৌশিক সেন

শেষ আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০০:০৯
Share: Save:

• অনেকে বলছেন, সিনেমায় এখন ‘নুন’-এর কাজটা করছেন কৌশিক সেন?

(হা হা হা) বাংলা ছবির চরিত্রাভিনেতাদের যদি দেখেন, তো তাঁরা বরাবর এই কাজটাই করেছেন। অত্যন্ত উৎকৃষ্ট লবণের কাজ করেছেন। আশির দশকে যে ধরনের ছবি হতো, তাতে এটা একদম হারিয়ে গিয়েছিল। আবার ফিরে এসেছে নতুন ভাবে। ঋতুপর্ণ ঘোষ যদি এই নতুন ধরনের ছবির জনক হন... সেই থেকে আজকে সৃজিতদের আসা। অনেক আগে অপর্ণা সেনের একটা লেখা মনে পড়ে, যেখানে উনি আমার বা রুদ্রনীলের (ঘোষ) কথা বলে বলেছিলেন, চরিত্রাভিনেতারা বাংলা ছবিতে গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে। সেই কথাটা কিন্তু আজ সত্যি হয়ে যাচ্ছে। একে একে দেখুন, রজতাভ দত্ত, শঙ্কর চক্রবর্তী, সুদীপ্তা চক্রবর্তী... সব থেকে প্রমিনেন্ট নাম এখানে শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়...

• শাশ্বত তো আজ ‘বিরিয়ানি’...

সে তো আজকে। আমি তার আগের কথা বলছি। ‘কহানি’-তেও ওকে হিরো বলব না। কিংবা ব্যোমকেশ-এ। ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘এবার শবর’ তো পরে...

• আপনি কবে ‘বিরিয়ানি’ হবেন?

নায়ক হতে গেলে এক ধরনের ‘কিলার ইন্সটিংক্ট’ লাগে। ইচ্ছে লাগে, স্বপ্ন লাগে। বাংলা কথায়, লেগে থাকাটা চাই। সেটা আমার নেই। আর আমার মধ্যে থিয়েটারি সত্তাটা এত প্রবল...এবং সেখানেও অভিনয় নয়, নির্দেশনা। নিজেকে সব সময় অভিনেতা হিসেবে দেখতে ভালও লাগে না। আর এখানে একটা কথা, ইদানীং এক ধরনের ফোবিয়ায় ভুগছি।

• সেটা আবার কী?

সম্প্রতি এডি রেডমেইনের ছবি ‘ড্যানিশ গার্ল’ দেখলাম। বাপস্! অমন কাজ দেখলে নিজেকে চরিত্রাভিনেতা ভাবতেও বাধে।

• আর ‘কালো ভ্রমর’ হয়ে ‘মাওবাদী’-দের সঙ্গে লড়াই করতে বাধে না?

এগুলো কিছু বাঙালি পরিচালকের টিপিক্যাল সমস্যা। থ্রিলার করতে গিয়েও তাঁরা ভেবে বসেন, শুধুই থ্রিলার বানাব? একটু সোশ্যাল মেসেজ দেব না? আগে এ সব নিয়ে তক্কটক্ক করতাম। আজকাল আর ভাল্লাগে না...

• কৌশিক সেন স্ট্র্যাটেজি বদলাচ্ছেন!

মানে? কী বলতে চাইছেন?

• মানে, আর তক্কো করছেন না।

ও, বুঝতে পারছি আপনি কী বলাতে চাইছেন। দেখুন, ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনের আগে পর্যন্ত আমার পরিবার, আমার কেরিয়ারকে বাজি রেখে আমি অনেকটা দূর গেছি। তারপর একটা সময়ের পর ব্যাপারটা তো আর ব্যক্তির ওপর নির্ভর করে না... এখন দেখছি সবার কাছেই কেমন একটা ‘অ্যাকসেপটেন্স’ তৈরি হয়ে গেছে। ‘এই বেশ ভাল আছি’। সবাই উন্নয়নের গল্প শোনাচ্ছেন। তার মধ্যেও আমি সাধ্যমতো আমার বিশ্বাসের কথা বলছি। নির্বাচনের ঠিক আগে আমার দলের নাটক ‘দ্রোহকাল’ মঞ্চস্থ হল। তার মূল জায়গাটা দেখুন ...‘সংখ্যাগরিষ্ঠরা সব সময় সত্যি কথা বলে না’। এটা কী বার্তা দেয়? শুনুন, স্ট্র্যাটেজি যদি বদলাতাম, তা হলে তো সরকারের শিবিরভুক্ত হয়ে যেতাম... সেটা কখনওই চাইনি। চাইবও না।

• এখন কি মনে হয়, এই সব প্রতিবাদ করাটা ভুল হয়েছিল?

না, ভুল কখনওই মনে হয় না। তার অসংখ্য পজিটিভ জায়গা আমি দেখতে পাই। একটা টাটকা উদাহরণ দিই— এ বারের নির্বাচনে পুলিশি তৎপরতা। ওটা কিন্তু লাগাতার সিভিল সোসাইটির চাপেরই একটা ফল।

• আপনার কি আজকাল একা লাগে?

হয়তো লাগে। তবে একটা কথা বলি, নানা রকম আলটপকা মন্তব্য প্রায় দিন, কাগজে কাগজে নানা লেখালেখি... এক-একটা রাত এমনও গেছে, বাড়িতে আমি-ঋদ্ধি-রেশমি একসঙ্গে চুপচাপ বসে থাকতাম, কারও মুখে কোনও কথা নেই। আমাদের থিয়েটার চলাকালীন অ্যাকাডেমিতে আগুন লাগার পর যখন ওখানে আর থিয়েটার না করার সিদ্ধান্ত নিই, তখনকার কথা মনে পড়ছে। প্রতিবার চ্যালেঞ্জ। চ্যালেঞ্জ। আর চ্যালেঞ্জ। ভয়, অনিশ্চয়তা। কাঁহাতক আর ভাল লাগে বলুন তো! কিন্তু আমি আপস করতে পারিনি। কোনও দিন পারবও না।

• কিন্তু যে-প্রযোজকের সঙ্গে পর পর কাজ করছেন, তারা তো বর্তমান শাসকের পক্ষে। এটা আপস নয়?

না, নয়। ওদের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা বাণিজ্যিক। তার বাইরে নয়। যেমন, শাসক দলের কোনও অনুষ্ঠান, সেখানে ওঁরা আমাকে কিন্তু যেতে বলেন না...। দু’পক্ষই এই বিষয়টা সচেতন ভাবেই এড়িয়ে চলি।

• বোঝা গেল। এর পরও তো কৌশিক সেন অনেক কিছুতে তাঁর পুরনো অবস্থান থেকে সরছেন!

যেমন?

• এই যে, এখন মিডিয়াকে আপনি নাটকে আমন্ত্রণ জানান। সুজাতা সদনে নাগাড়ে থিয়েটার করার সময় যে-আপনি ঠিক করেছিলেন, খবরের কাগজে আপনার নাটকের রিভিউ পর্যন্ত করাবেন না।

ওখানে একটা উদাহরণ তৈরির চেষ্টা ছিল যে, সরকারি হল বা মিডিয়াকে না পেয়েও থিয়েটার করা যায়। সেটা দেখানোরও ছিল। তার সঙ্গে এটাও মানছি, আমার মধ্যে একটা নায়কোচিত ব্যাপারও কাজ করেছে। যেটা অনভিপ্রেত। সবটাই যে ঠিক করেছি, বলব না। কিন্তু তাতে ক্ষতিটা হয়েছে আমাদেরই। আর কারও নয়। রেশমির তো বটেই। ওর মতো দলের অনেকেরই প্রচুর ভাল কাজ ঠিক ভাবে প্রজেক্টেড হয়নি। এর পর ব্যাপারটা নিয়ে অনেক ভেবেছি। পরিস্থিতিও পাল্টেছে, সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্তেও কিছু বদল এনেছি।

• সিনেমা পাড়ার পুজো নাকি এ বার যতটা বুম্বাদার, ততটাই বাবানদার...

(এতক্ষণের সিরিয়াস মুখটা হঠাৎ ঝিকিয়ে উঠল) এটা আমার প্রাপ্তি। ‘কালো ভ্রমর’-এর ক্ষেত্রে একটা অন্য সেন্টিমেন্ট ছিল। আমার বাবা শ্যামল সেন এক সময় বিবিধ ভারতী-র একটি রেডিয়ো ধারাবাহিকে ‘কালো ভ্রমর’ করতেন। সন্ধেবেলা সম্প্রচারিত সে-অনুষ্ঠানটার সময় রাস্তা ফাঁকা হয়ে যেত। সবার বাড়িতে রেডিয়োয় তখন ‘কালো ভ্রমর’। বাবা শুধু গলা দিয়ে এই অ্যাট্রাকশনটা তৈরি করেছিলেন। এটা আমার অসম্ভব সুখস্মৃতি। তাই এই কাজটা পেয়ে আমি আপ্লুত। আর ‘জুলফিকার’? মনে আছে, এক দিন সবে স্নান সেরে বেরিয়েছি। হঠাৎই সৃজিতের ফোন। বলল, ‘জুলফিকার’-এ ব্রুটাস করতে হবে। কিন্তু তার পরই বলল, নরমসরম নয়, ও চায় পেশিবহুল, টাফ অ্যান্ড রাফ চেহারা। কথাবার্তাতেও...

• তার পরই ‘প্যাক’ তৈরি!

(হেসে উঠে) আরে না না। প্যাক-ট্যাক নয়। ওই সক্কালে উঠে রোজ শরীরচর্চা আমার পোষায় না। বাগুইহাটি থেকে একটা ছেলে বাড়িতে আসত, বাপি। ইন্ডাস্ট্রির অনেকে চেনে। ও দু’দিনেই বুঝে গেছিল, আমি এ সব ব্যাপারে কতটা গেঁতো। বলল, বাড়িতে হবে না কৌশিকদা, জিম-এ আসুন। ওর কথাতেই জোর করে বাগুইহাটি যাওয়া। ঠিক জিম বলব না, ওটা একটা আখড়া গোছের।

• ‘জুলিফকার’-এ আপনার কাজ দেখে নাকি সৃজিত মুখোপাধ্যায় অভিভূত।

(হাসি, তার পরেই ছদ্মরাগ দেখিয়ে) তবে ওফ্! ওর মতো নিষ্ঠুর, সাঙ্ঘাতিক ডিরেক্টর দেখিনি। কী খাটান খাটায়। ভোরবেলা। শীতের সকাল। চারটে-সাড়ে চারটে। মাঝগঙ্গায় আমাকে, পরমকে, দেবকে, বুম্বাদাকে বেঁধেটেধে জলে ফেলে দিল। টানা তিন দিন। কত বার যে উঁচু উঁচু জায়গা থেকে ঝাঁপাতে বলেছে! মারপিট করিয়েছে। একবার তো দৌড়তে গিয়ে আমার মারাত্মক অ্যাক্সিডেন্ট হল। শিপইয়ার্ড। চার দিকে লোহালক্কড়। ছিটকে পড়ে কানের পাশে রক্তারক্তি কাণ্ড। আর প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে সৃজিতকে দেখতে হয়, যেন কিচ্ছুটি হয়নি, এমন নির্লিপ্ত মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকত! তবে হ্যাঁ, ও শেক্সপিয়রের ট্র্যাজেডির ফ্লেভারটা রেখে চিত্রনাট্যে যে ভাবে আধুনিকতা এনেছে, সত্যিই দেখার মতো। আর একটা ব্যাপার।

• কী?

ছবিতে তো নায়ক-নায়িকা ঠাসাঠাসি। যে কোনও সময় টক্কর লেগে যেতে পারত। কিন্তু সৃজিত চিত্রনাট্যটাকে এমন সাজিয়েছে, টেক্কা দেওয়ার খেলায় নেমেছ কী, গেলে। নিজের অভিনয়ের দিকে নজর দিতেই হবে।

• শেক্সপিয়র, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, বুদ্ধদেব বসু করেও এখনও আপনার পরিচয় ‘কালপুরুষ’ টিভি সিরিয়ালের ‘অর্ক’, কিংবা হালে কিরীটীর ‘কালো ভ্রমর’। খারাপ লাগে না?

লাগে। তবে যখন মনে পড়ে, উৎপল দত্ত, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়কেও তো এই একই জিনিস সহ্য করতে হয়েছে, তখন ভাবি, আমি কে ভাই! তবে এর মধ্যে ‘পজিটিভ’ দিকও আছে। ইদানীং কেউ হোয়াটসঅ্যাপ-এ ছবির প্রশংসা করলে, ওঁদের আমার থিয়েটারেও আসতে বলি। তেমন কেউ কেউ আবার থিয়েটারের নিয়মিত দর্শক হয়ে গেছেন।

• কালো ভ্রমর, ‘জুলফিকার’, ব্যোমকেশ। তার পর?

সুজয় ঘোষের ‘কহানি টু’, দেবারতি গুপ্তর ‘কুহেলি’, অগ্নিদেব চট্টোপাধ্যায়ের ‘গহিন হৃদয়’। প্রকাশ ভরদ্বাজের বাংলা-ইংরেজি বাই লিঙ্গুয়াল একটা ছবি ‘কালারস অব লাইফ’। আর হলিউডের ছবি গার্থ ডেভিস-এর ‘লায়ন’। এটাতে নিকোল কিডম্যান আছেন....

• ‘ঈগলের চোখ’-এর পর অনির্বাণ ভট্টাচার্যকে নিয়ে যে মাতামাতি হচ্ছে, কী মনে হয়, বাড়াবাড়ি?

রিয়্যালি প্রাউড অফ হিম। মফস্সল থেকে কলকাতার থিয়েটারে আসা একটা ছেলের জার্নিটা আমি তো জানি। শুধু দেখতে চাই, এই ‘হাইপ’টা ও ঠিক কী ভাবে ট্যাকল করে। আর দেখা হলে ওর অভিনয় নিয়ে কথাবার্তা তো হবেই। আমার অনেক কিছু বলার আছে ওকে।

• কেউ কেউ বলেন, কৌশিক সেনের পেছনে একজন কিরীটী রায় লাগালে অনেক রহস্যের উদ্ঘাটন হতো!

(হাসি) যেমন?

• পৃথিবীর একমাত্র স্বামী যিনি বৌকে জানিয়েই দিব্যি পরকীয়া করেন। আবার টানা বিভুঁই-এ শ্যুটিং করলে হোমসিক হয়ে পড়েন কিংবা ভাঙা পা নিয়ে বৌ মঞ্চে উঠতে চাইলে প্রকাশ্যে আবেগে কেঁদে ফেলেন....

(ঈষৎ গম্ভীর হয়ে) স্টেলা এডলারের একটা লেখা পড়ছিলাম। বিখ্যাত অ্যাক্টিং ট্রেনার। মার্লন ব্রান্ডো, রবার্ট ডি নিরো, এমনকী স্তানিস্লাভস্কির সঙ্গেও কাজ করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘‘তুমি ব্যক্তিজীবনে ক’টা সত্যি বলো? যা সত্যি সবই তো বলো মঞ্চে।’’ এটা আমি মানি। তুমি ডাক্তারই হও বা মোক্তার, কাজের জায়গাটা ছাড়া বাকি সবখানেই তুমি ক্যামোফ্লেজড। তার সঙ্গে এটাও বলব, আমি জানি, আমি একটা অসম্পূর্ণ মানুষ। আর এও জানি, আমার একটা ‘অলটার ইগো’ আছে। সারাক্ষণ তার সঙ্গে যুদ্ধ চলে আমার। কিন্তু আমি সত্যিটা স্বীকার করতে জানি। অন্য অনেকের সঙ্গে এখানে আমার ফারাক। তাই আমার অনেক রহস্যই আজ উন্মোচিত। বরং অনেকের জীবনেই এমন ‘কিরীটী রায়’ লাগালে...(ঠোঁটে অর্থবহ হাসি নিয়ে থেমে গেলেন)।

• হাইলি সাসপিসিয়াস!

(এ বার অট্টহাসি)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Kaushik Sen Interview Ananda Plus
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE