করুণাময়ী রানি রাসমণি
সপ্তাহ, পক্ষ কিংবা মাস ধরে নয়— এ বার পিরিয়ড ফিরে আসছে রোজ। নেহাতই শাশুড়ি-বৌমার ঝগড়া দেখতে দেখতে যে দর্শক ক্লান্ত, তা বোঝাই যাচ্ছিল। তাই দর্শকের চাহিদার কথা মাথায় রেখে প্রযোজনা সংস্থা এবং চ্যানেল কর্তৃপক্ষ বারবার ফিরিয়ে আনছেন ভিন্ন ধারার গল্প। গত এক-দু’বছর থেকে যা চালু হয়েছিল, সেই ট্রেন্ড এখন ঊর্ধ্বমুখী।
সাহিত্যের গন্ধ
বাংলায় সাহিত্যনির্ভর ধারাবাহিক এক সময়ে ভীষণই জনপ্রিয় হয়েছিল। তবে নির্দিষ্ট সময়সীমার পরে তা শেষ হয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। শাশুড়ির কূটকচালি, একাধিক প্রেম ও বিয়ে থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া দর্শককে আবার টিভির চ্যানেলমুখী করতে তাই এ বার বাছা হচ্ছে এমন বড় উপন্যাস, যা চলবে বেশি দিন। অর্থাৎ আর পাঁচটা মনগ়ড়া চরিত্রের মতোই সাহিত্যনির্ভর চরিত্ররা জাঁকিয়ে বসে রোজ সন্ধেয় রাজত্ব করতে পারবে বাংলার বৈঠকখানায়। তাই ‘দেবী চৌধুরানি’ কিংবা ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’র মতো কাহিনি অবলম্বনে তৈরি হচ্ছে ধারাবাহিক।
এই স্বাদবদলের কারণ কিন্তু দর্শকের বোরডম। তিনটি ধারাবাহিকের ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর অদিতি রায় যেমন বলছেন, ‘‘একটা সময় পরে দর্শক চাইবেনই নতুন কিছু আসুক। তবে এই বদলটা চেনাজানা। অর্থাৎ দর্শক চান, লোকনাথ-চৈতন্য কিংবা সাহিত্যের সত্যবতীর মতো গল্প পর্দায় দেখতে যাদের নাম চেনা, চরিত্রটা খানিক জানা। আরও ভাল করে খুঁটিয়ে দেখতে চাওয়া থেকেই হয়তো বা এই বদল।’’
কিন্তু সাহিত্যনির্ভর ধারাবাহিক তৈরি করতে গিয়ে সত্যবতী বা চৌধুরানির মতো চরিত্র বেছে নেওয়ার কারণটা কী? অদিতির কথায়, ‘‘বাংলা সাহিত্যে হাই পিচ ড্রামার তো অভাব নেই কোনও। এই ড্রামাগুলো ভীষণ ভাবে টেলিভিশনের জন্য তৈরি। একটা ধারাবাহিকের গল্প যা দর্শককে টেনে ড্রয়িংরুমে আটকে রাখবে, তার সব মালমশলা এ ধরনের চরিত্রে ভরপুর।’’ নারী স্বাধীনতা, লড়াই করার মানসিকতা ও শেষ পর্যন্ত যুদ্ধজয়ও অস্বীকার করা যায় না মোটেও।
দেবী চৌধুরানি এবং লোকনাথ
ধর্মের শিক়ড়
মেলোড্রামার পাশেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে এমন সব মানুষকে নিয়ে গল্প, যাঁরা আমাদের সমাজে পূজনীয়। মা সারদা, চৈতন্যদেব, লোকনাথ, রানি রাসমণি... গোটা পরিবারের ছোট-বড় সমস্ত সদস্য যে ধারাবাহিকটা একসঙ্গে বসে দেখতে পারবে, তেমনই গল্প দেখানো হয় এতে। ‘করুণাময়ী রানি রাসমণি’ ধারাবাহিককে যেমন সাধারণ কোনও ছকে ফেলা যাবে না। কারণ, যে ছোট মেয়েটি এক দিন রানি হয়ে ওঠে, ইংরেজদের চোখে চোখ রেখে প্রতিবাদ করে, আবার একই রকম ভাবে ঈশ্বরে আস্থাও রাখে, তাকে একটি বন্ধনীতে মেলানো যায় না। তাই রানি রাসমণি একই সঙ্গে সমাজের, পরিবারের পাশাপাশি অধ্যাত্ম ও ইতিহাসের গল্প বলে। ধারাবাহিকটির একটি মুখ্য চরিত্রের অভিনেতা গৌরব চট্টোপাধ্যায় বললেন, ‘‘যে কোনও রকম ফ্যামিলি সাগার চাইতে এই ধরনের চরিত্রে অভিনয় করা অনেক বেশি ভাল। চরিত্র কতটা অংশ জুড়ে রয়েছে, সেটা না ভেবে চরিত্রের গুরুত্বটা ভাবা উচিত। এ ধরনের চরিত্রে অভিনয় করলে একঘেয়েমি থেকে বেরিয়ে আসা যায়। আবার দর্শকও অন্য স্বাদের গল্প পান।’’
স্বাদবদলের নানা রূপ
যে কোনও পিরিয়়ড ড্রামার ক্ষেত্রে বদলে যায় তার ক্যানভাস। একই সঙ্গে পাল্টায় চরিত্রের সাজপোশাক, আলোর কাজ, মিউজ়িকের অনুষঙ্গ। সর্বোপরি এই বদলে যাওয়া মেজাজ আসলে যোগ করে আলাদা গ্র্যাঞ্জারের। সিলভার স্ক্রিনের সেই গ্র্যাঞ্জার ছোট পর্দায় দেখার সুখও কম কিসের? বিশেষ সময়কালকে তুলে ধরতে রাসমণির রাজকীয় সাজপোশাক হোক কিংবা নিতান্ত মেঠো সত্যবতীর গ্রাম... গরপড়তা ধারাবাহিকের ফ্ল্যাটের চৌখুপি ছাড়িয়ে দর্শকের মন কাড়ে সহজেই। পাশাপাশি অনুঘটক হিসেবে সেই বিশেষ পিরিয়ডের পরিবেশ, গন্ধ, আবহ আর গল্প তো রয়েছেই। স্টার জলসা এবং জলসা মুভিজ়ের ইভিপি, চ্যানেল জিএম সাগ্নিক ঘোষের বক্তব্য, ‘‘দর্শকের একঘেয়েমি কাটিয়ে আলাদা কিছু করাই আমাদের লক্ষ্য। সেই মতোই গল্প বাছাই করি। যেমন ‘দেবী চৌধুরানি’।’’
লাভের গুড়
টিআরপি-র দিকে খেয়াল করলে অঙ্কটা সহজেই অনুমেয়। বহু ঘরেই সন্ধে শুরু হয় এই জাতীয় ধর্ম বা সাহিত্যনির্ভর ধারাবাহিক দিয়ে। চলে টানা রাত পর্যন্ত। ফলে পিরিয়ড ড্রামার প্রতিফলন শুধু দর্শকের ঘরে নয়, পড়ছে লাভের ঊর্ধ্বমুখী হিসেবেও। প্রতিনিয়ত জনপ্রিয় হতে থাকা এই সব ধারাবাহিকের ট্রেন্ডও অদূর ভবিষ্যতে বদলাবে বলে মনে হয় না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy