Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

পিঙ্কি ছবিতে থেকেও নেই

পিঙ্কির ভূমিকায় কমলিকা চন্দার প্রচেষ্টা ভাল। কিন্তু বাদ সাধল দুর্বল চিত্রনাট্য। লিখছেন রতন চক্রবর্তী পিঙ্কির ভূমিকায় কমলিকা চন্দার প্রচেষ্টা ভাল। কিন্তু বাদ সাধল দুর্বল চিত্রনাট্য। লিখছেন রতন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১৫ জুন ২০১৫ ০১:১৭
Share: Save:

বিরিয়ানির মশলা মজুত ছিল। তা দিয়ে রান্নার চেষ্টাও হল, কিন্তু সেটা শেষ পর্যন্ত সুখাদ্য হল না।

বাংলার বিতর্কিত অ্যাথলিট পিঙ্কি প্রামাণিকের জীবনটাই নাটকীয় উপাদানে ভর্তি। দোহা এশিয়াডের আন্তর্জাতিক মঞ্চে প্রথম সোনা জয় থেকে, তিনি স্ত্রী না পুরুষ এই প্রশ্নের মীমাংসা নিয়ে তৈরি হওয়া নানা ঘটনার মশলাকে সামনে রেখেই তৈরি হয়েছে রাজা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি ‘শি...?’। কিন্তু ছবিটা দেখে মনে হয়েছে, বাণিজ্যিক দিক বেশি ভাবতে গিয়ে আসল উদ্দেশ্যটাই মাটি হয়ে গিয়েছে। ফলে ছবিতে পিঙ্কি আছেন, আবার নেই-ও।

নানা সমস্যার কথা ভেবে পিঙ্কির নাম বা পদবি ছবিতে অবশ্য বদলে দেওয়া হয়েছে। ছবিতে রিঙ্কি পুরকাইতের জীবনটা শুরু হয়েছে অবশ্য সেই মানভূমের গ্রাম থেকেই। তবে দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে এসে রাজ্য মিটে খালি পায়ে একের পর এক সোনা জেতা মেয়েটি বা তাঁর বাবা-মাকে যে ভাযায় কথা বলানো হয়েছে তা আরোপিত। ওঁরা ওভাবে কথাই বলেন না। আবার শহরে এসে ডান্স বারে গিয়ে সেই গ্রামের মেয়ের বান্ধবী খোঁজার ব্যাপারটা বা রিঙ্কির ফ্যাশন শো-তে যাওয়াটাও হাস্যকর ভাবনা। বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামের এক মেয়ে অ্যাথলিটের পক্ষে যা বেমানান।

আসলে পিঙ্কির সেই অর্থে কোনও কোচ-ই ছিল না কোনও দিন। বলা যায় নানা কারণে বা তাঁর আচরণের জন্য কারও কাছেই থিতু হতে পারেননি বাংলার এক সময়ের সোনার মেয়ে। সিনেমায় রিঙ্কির অবশ্য একজন কোচ ছিলেন। যিনি তাঁকে বারবার সাহায্য করেছেন, উদ্বুদ্ধ করেছেন। ভেঙে পড়তে দেননি। রিঙ্কি এবং কোচের একে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা এবং বিশ্বাস ফুটিয়ে তোলাটা এই ছবির অলঙ্কার, সন্দেহ নেই। ‘কোনি’ ছবির কিছু দৃশ্যকে মনে করায়। রিঙ্কির ভূমিকায় কমলিকা চন্দার অভিনয় বেশ ভাল। সঙ্গে কোচ সোমনাথ রায়ের ভূমিকায় রাজেশ শর্মাও সাবলীল। চিত্রনাট্যে তাঁর অভিনয়ের সুযোগ কম থাকা সত্ত্বেও।

পিঙ্কি ওরফে রিঙ্কির চরিত্র পুরোপুরি ফুটিয়ে তোলা কঠিন। তবে কমলিকা চেষ্টা করেছেন। কালো বা নীল ডোরাকাটা টি শার্ট পরে হাঁটার সময় তাঁকে কখনও কখনও পিঙ্কির মতোই মনে হয়েছে। তবে কমলিকা নিজে কখনও পিঙ্কির মুখোমুখি হননি বলেই সম্ভবত তাঁর কথা বলার স্টাইল বা দৌড়ের ভঙ্গি পুরোপুরি করায়ত্ত করতে পারেননি। ছেলেদের সঙ্গে লকআপে পুলিশের কাছে তাঁকে বাঁচানোর জন্য আর্তির দৃশ্য বা লক আপে সওয়াল চলাকালীন ভেঙে পড়ার সময়ের রিঙ্কিকে দেখে দর্শক আবেগে চোখের জল ফেলতেই পারেন।

আসল পিঙ্কির বিরুদ্ধে জোর করে সহবাসের অভিযোগ এনেছিলেন তাঁর বাড়িতে কাজ করতে আসা এক ভদ্রমহিলা। এখানে অবশ্য বাণিজ্যিক কারণে একজন মডেল—সোহিনীকে দেখানো হয়েছে সেই জায়গায়। তবে রিঙ্কির সঙ্গে সোহিনীর ‘বন্ধুত্ব’ তৈরি করতে যে ভাবে গল্প সাজানো হয়েছে তা জমেনি। সে জন্য ক্যাবারে নাচ বা ফ্যাশন ডিজাইনার অভির সঙ্গে সোহিনীর শয্যা দৃশ্য বারবার না দেখালেও চলত। ছবিটায় গতি থাকত। কিন্তু বারবার দেখানোয় একশ্রেণির দর্শক হয়তো আসবেন অন্য কারণে, তবে দৃশ্যটি বেশ বিরক্তিকর। মডেল সোহিনীর ভূমিকায় ঐশ্বর্যা মুখোপাধ্যায় কাজ চালিয়ে দিয়েছেন। অভির ভূমিকায় নাটকের লোক শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়ও তাই। রিঙ্কির সঙ্গে সোহিনীর নৌকোর মধ্যে বা গাছের নীচের ‘প্রেম’-এর দৃশ্যও বাড়াবাড়ি মনে হয়েছে। এসব আর একটু কম দেখালেও চলত।

বাস্তবে বিতর্কিত অ্যাথলিট পিঙ্কির ক্ষেত্রে সমকামিতার অভিযোগ এনেছিলেন তাঁর বাড়িতে কাজ করতে আসা একজন মেয়ে। সেটা অভিযোগ। প্রমাণ হয়নি। ছবিতে অবশ্য রিঙ্কি এবং মডেল সোহিনীর সমকামিতা বেশ রগরগে করে দেখানো হয়েছে। রিঙ্কি পুরুষ না মেয়ে তা নিয়ে নাটকীয় কিছু মুহূর্ত হাজির করানোর চেষ্টা করেছেন পরিচালক। কিন্তু দুর্বল চিত্রনাট্য তাতে বাদ সেধেছে। রিঙ্কির লিঙ্গ পরীক্ষা করার আগে ডাক্তার খলনায়কের মতো গ্লাভস পরে হাসছেন, নার্সরা ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে, এটা কোনও নার্সিংহোমে হয় না কি! ছবিতে হয়েছে।

বেশ কিছু জায়গায় চিত্রনাট্য টানটান হলে ছবিটা আকর্ষণীয় হতে পারত। বিশেষ করে আদালতে সওয়াল চলাকালীন চোখাচোখা শব্দ, যা সাধারণত ছবিতে পাওয়া যায় তা এখানে অনুপস্থিত। উল্টে ‘তোমার তো দু’মিনিটের বেশি করার ক্ষমতা নেই’ বা ‘তুমি একটা মাগিবাজ’—ফ্যাশান ডিজাইনার অভিকে উদ্দেশ্য করে মডেল সোহিনীর বলা কথাগুলো মানানসই হয়নি। সিরিয়াস বিষয় নিয়ে করা ছবিতে এ সব বাজারি শব্দ ব্যবহার করলে ছবির গুণমান নষ্ট হয়। সেটা পরিচালকের বোঝা উচিত ছিল। রাজার এটা প্রথম ছবি। তাই অনেক খামতি থেকে গিয়েছে।

মিলখা সিংহ, মেরি কম-সহ বহু ক্রীড়াবিদকে নিয়ে ছবি হয়েছে। কিন্তু পিঙ্কিকে নিয়ে ছবিটার মশলা ছিল অন্য। এটা নিছক একজন স্পোর্টসম্যানের উত্থান-পতনের ছবি নয়। পিঙ্কির জীবনকাহিনির পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে আরও অনেক সামাজিক প্রশ্ন।

পিঙ্কিদের মতো কাঠখোট্টা মেয়েদের সমাজ যে চোখ নিয়ে দেখে বা তাদের যেভাবে পদে পদে অপমানিত হতে হয়, হেনস্তা হতে হয় তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর একটা দুর্দান্ত সুযোগ ছিল।
সেটা শেষ পর্যন্ত হল না। বিরিয়ানির মশলা পেয়েও চচ্চড়ি রান্না হলে যা হয় আর কী!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE