ব্যস্ত কলকাতায় তখন ‘এসেছে রাত’। এই ‘অক্টোবর’-এ সেখানে পেলাম সুরকার শান্তনু মৈত্রকে। টোনড জিন্স, শার্ট আর লাল গামছা কাপড়ের স্কার্ফে সুরকার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতেই। সামনেই পুজো। কিন্তু পুজোর গানে তিনি নেই কেন? ‘‘ভাল কোনও স্ক্রিপ্ট পাইনি বলেই পুজোর গান নিয়ে চিন্তাভাবনা করিনি।’’ পুজোর গানের জনপ্রিয়তা কমে যাওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বললেন, ‘‘পুজোর গান শুধু হারিয়ে যাচ্ছে না। আমরা হারিয়ে যাচ্ছি। গানের দোষ দিলে হবে না। আমরা হারাচ্ছি বলেই গানগুলো হারাচ্ছে। এই তো আমি ‘সা রে গা মা’–র সেট থেকেই এলাম। ওই এপিসোডে সব ক’টি পুরনো দিনের পুজোর গান ছিল। আমি তো প্রবাসী বাঙালি। কিন্তু আপনারাও ওই গান শুনেছেন বলে মনে হয় না। নতুন গান, নতুন গান বলে আমরা গলা ফাটাই। অথচ পুরনো পুজোর গান কতটা আমরা সংরক্ষণ করি বলুন তো! কলকাতার বাইরে পুজোর কোনও শো হলে লোকসঙ্গীত ও কীর্তনের অনুরোধই বেশি আসে।’’
পুজোর গানে না থাকলেও অন্য প্রজেক্টে ব্যস্ত শান্তনু। একটি চ্যানেলের টাইটেল মিউজ়িক কম্পোজ় করেছেন। সেই সূত্রেই কলকাতায় এসেছিলেন। ‘‘এই প্রথম কোনও চ্যানেলের টাইটেল মিউজ়িক কম্পোজ় করলাম। অসাধারণ কনসেপ্ট। ‘বুনো হাঁস’ ছবির পর শ্রেয়া ঘোষাল ও শ্রীজাতর সঙ্গে আবার জুটি বেঁধে কাজ করলাম।’’ বাংলা ছবিতে ইদানীং তাঁকে তেমন পাওয়া যাচ্ছে না। জানালেন, পছন্দ মতো কাজ না পাওয়াই তার কারণ। শান্তনু লোকসঙ্গীত নিয়ে কাজ করতে ভালবাসেন। বাংলা গান নিয়ে যেমন এক্সপেরিমেন্ট করতে আগ্রহী, তেমনই পছন্দ করেন নতুন শিল্পীদের উৎসাহ জোগাতেও। ‘‘নতুন ছেলেমেয়েরা বাংলা গানকে যে ভাবে উপস্থাপন করছে, তা দেখে অবাক হয়ে যাই। একটা গানেই বেস গিটার আছে, তবলা আছে, আবার খোলও আছে। ‘সা রে গা মা’র বিচারক হওয়ার সুবাদে আমিও অনেক কিছু শিখছি।’’
অবসর সময়ে রেডিয়োতে গান শোনেন। কিন্তু বাংলা রেডিয়ো চ্যানেলে কেন বেশি করে বাংলা গান বাজানো হয় না, তা নিয়ে বেজায় ক্ষোভ শিল্পীর। বলছিলেন, ‘‘মুম্বইতেও আমি হিন্দি গান শুনি। আবার কলকাতায় এলেও। কেন? আমাদের বাংলায় তো গানের খনি আছে। প্রতিটি রেডিয়ো চ্যানেলে নিয়ম করে এক ঘণ্টা বাংলা গান বাজবে, এমন নিয়ম করা গেলে ভাল হয়। আর শুধু সিনেমার গান নয়, ঠুমরি, টপ্পা, গজ়ল, শাস্ত্রীয় সঙ্গীত সব কিছুই চালানো উচিত।’’
চ্যানেলে চ্যানেলে রিয়্যালিটি শো। কিন্তু আর একটা শ্রেয়া ঘোষাল বা অরিজিৎ সিংহ তো উঠে এল না? ‘‘সকলকেই শ্রেয়া বা অরিজিৎ হতে হবে, এমন নয়। সিনেমায় প্লে-ব্যাক করাটাও প্রধান নয়। আমার কাছে রিয়্যালিটি শোয়ের ভ্যালু একেবারেই আলাদা। উদাহরণ দিয়েই বলি, একটি শোয়ে একটি বাচ্চা ছেলে এসেছিল। যার বাবা শিয়ালদহে সুটকেস সেলাই করে সংসার চালান। কিন্তু বাচ্চাটিকে গান শেখাবেন বলে একবেলা খেয়েও গানের শিক্ষক রেখেছিলেন। ছেলেটি সেই শোয়ের ফাইনালে পৌঁছতে পারেনি। কিন্তু তার এক বছর পরে ছেলেটি ও তার বাবা আমার সঙ্গে দেখা করেন মিষ্টির বাক্স হাতে। জানতে পারি, তাদের নিজেদের একটি বাড়ি ও গাড়ি হয়েছে। গানবাজনা করে সংসার চালানো যায়। আমার কাছে এটাই যথেষ্ট। সে বলিউডে গাইছে কি মাচাতে গাইছে, সেটা প্রধান নয়।’’
খুব কম সুরকারই বলেন, নিজের পছন্দ আগে, শ্রোতার পছন্দ পরে। তাঁর কথায়, ‘‘আমার ছাত্রদেরও বলি, কখনও অডিয়েন্সের কথা ভেবে গান গাইবে না বা তৈরি করবে না। গান সব সময় নিজের জন্য।’’ তিনি নিজে সব রকম গান শুনতে পছন্দ করেন। হেসে বললেন, ‘‘এই জন্যই বোধহয় আমি সুরকার। একটা জ়োন যদি ভাল লাগত তা হলে এত কাজ করতে পারতাম না। ‘পরিণীতা’, ‘মুন্না ভাই...’, ‘থ্রি ইডিয়টস’, ‘পিঙ্ক’ বা ‘অক্টোবর’... প্রতিটি ছবিতে প্রতিটি গানের সুর আলাদা। আর এটাই আমার স্টাইল। কখনও লোকসঙ্গীত তো কখনও বলিউডি প্লে-ব্যাক আবার কখনও জ্যাজ়।’’ নিজের দুটো গান তিনি সব সময় শুনতে ভালবাসেন, ‘পরিণীতা’র ‘রাত হমারি তো’ আর ‘অন্তহীন’-এর ‘যাও পাখি’।
সঙ্গীত বাদ দিলে তাঁর প্যাশন বেড়াতে যাওয়া। ট্রেকিং ভালবাসেন। যে কারণে বন্ধু রাজকুমার হিরানির ‘সঞ্জু’তে কাজ করতে পারেননি। জীবনকে কখনও সিরিয়াসলি নেননি বলেই অনেক দিকে নিজেকে মেলে ধরতে পেরেছেন। কিন্তু আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করেননি কোনও কিছুই...
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy