Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

বাস্তবের বন্ধুত্বই বড় পর্দায়

বাংলা চলচ্চিত্র জগতের দুই কিংবদন্তি তারকা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও তনুজার সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় আনন্দ প্লাসবাগান খুব প্রিয় জায়গা তাঁর। এখন তনুজার বেশির ভাগ সময়ই কাটে বাড়ির বাগানে গাছের যত্ন করে বা লাইব্রেরিতে। অনেক বছর বাদে তিনি আবার বাংলা ছবিতে।

সৌমিত্র ও তনুজা। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক ও ছবি: সুদীপ্ত চন্দ

সৌমিত্র ও তনুজা। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক ও ছবি: সুদীপ্ত চন্দ

শেষ আপডেট: ০৩ জুলাই ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

হলুদ শাড়ি ও মুক্তোর মালায় আজও তিনি টেক্কা দিতে পারেন নতুন প্রজন্মের নায়িকাদের। শহরের এক অভিজাত হোটেলে সম্ভ্রান্ত সাজে নজর কাড়ছিল তনুজার ব্যক্তিত্ব। কিন্তু কাছে যেতেই অতি পরিচিতের মতো হাত দুটো ধরে বললেন, ‘‘এসির মধ্যে বসে থেকে আমার হাত কী ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে! চলুন, আমরা বাগানে বসে কথা বলি।’’

বাগান খুব প্রিয় জায়গা তাঁর। এখন তনুজার বেশির ভাগ সময়ই কাটে বাড়ির বাগানে গাছের যত্ন করে বা লাইব্রেরিতে। অনেক বছর বাদে তিনি আবার বাংলা ছবিতে। ফিরতে এতটা সময় নিলেন কেন? তনুজার স্পষ্ট উত্তর, ‘‘স্ক্রিপ্ট ভাল লাগেনি। এখন সব গল্পই বড় বলিউড ঘেঁষা, পাশ্চাত্য প্রভাবে আচ্ছন্ন। কোনও নিজস্বতা নেই, বার্তা নেই। অনেক দিন বাদে পরমব্রতর (চট্টোপাধ্যায়) ‘সোনার পাহাড়’-এর স্ক্রিপ্টটা পড়ে খুব ভাল লাগল। ছবিতে মা-ছেলের সম্পর্ক সুন্দর ভাবে দেখানো হয়েছে। একটা বার্তাও রয়েছে।’’

বহু বছর পর স্ক্রিন শেয়ার করলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও তনুজা। যদিও বাস্তবে তাঁদের মধ্যে যোগাযোগ ছিল অক্ষুণ্ণ, দু’জনেই ভাল বন্ধু যে! তাই হয়তো সৌমিত্রর জন্মদিনে তনুজা মুম্বই থেকে চলে আসেন কলকাতায়। তনুজা বললেন, ‘‘কত দিন পর দেখা হচ্ছে, কোথায়, কখন দেখা হচ্ছে, সেগুলোয় কিছু যায় আসে না। বন্ধুত্ব থাকলে, দেখা হলেই কথা শুরু হয়ে যায়।’’ এ ব্যাপারে সৌমিত্রও একমত, ‘‘সেই ‘তিন ভুবনের পারে’র সময় থেকে যে বন্ধুত্বের সূচনা, তা এখনও অটুট।’’ দু’জনে বেশ কয়েকটি ছবিতে একসঙ্গে কাজ করলেও তনুজা অভিনীত প্রিয় ছবি বলতে সৌমিত্রর মনে পড়ে গেল ‘লুকোচুরি’, ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ ও তাঁর সঙ্গে ‘প্রথম কদম ফুল’-এর কথা। অন্য দিকে প্রিয় সৌমিত্রের ছবি বলতে তনুজার ঠোঁটের ডগায় এসে গেল ‘বেলাশেষে’র নাম।

ওঁদের বাস্তব জীবনের বন্ধুত্বই ফুটে উঠেছে ‘সোনার পাহাড়’-এ। ছবিতে তনুজার চরিত্রের নাম উপমা। তার সঙ্গে ছেলের (যিশু সেনগুপ্ত) সম্পর্কের টানাপড়েনের মাঝেই আলাপ হয় রজতশুভ্রর (সৌমিত্র)। উপমার মানসিক সঙ্কটে পাশে এসে দাঁড়ায় রজত। তাকে মানসিক অবসাদ থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করে সে।

তনুজা ও সৌমিত্র দু’জনেই প্রথম কাজ করলেন পরমব্রতর সঙ্গে। পরিচালকের কাজের প্রসঙ্গে তনুজা বললেন, ‘‘পরমের সঙ্গে কাজ করে তপনদার (সিংহ) কথা মনে পড়ে গেল। পরম যেমন অভিনেতাকে নিজের মতো অভিনয় করার স্বাধীনতা দেয়, তেমন ওর নিজের যা চাই, সেটাও আদায় করে নেয়।’’ সৌমিত্রর মতেও পরমব্রত খুব ভাল পরিচালক, ছবিটা সে বেশ ভালই বোঝে।

ছবির শিশুশিল্পী বিটলু ওরফে শ্রীজাত বন্দ্যোপাধ্যায়ের বুদ্ধিমত্তার তারিফ করলেন দু’জনেই। শুটিংয়ের সময় শ্রীজাত প্রশ্নবাণে কাত করে দিত তনুজাকে। শ্রীজাতর প্রসঙ্গ উঠতে নিজের নাতির কথায় চলে এলেন তনুজা। ‘‘ওকে বলতাম তুমি আমার নাতি যুগের (কাজলের ছেলে) মতো। এখনকার বাচ্চাদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া খুব শক্ত। শ্রীজাতকে কথা দিয়েছি মুম্বইয়ে গেলে যুগের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব।’’ বাচ্চাদের সঙ্গ তিনি উপভোগ করেন। তাই হয়তো বাচ্চাদের হাতে দিনরাত মোবাইল একেবারেই সহ্য করতে পারেন না। নিজের নাতি-নাতনিকেও তনুজা পরিষ্কার বলে দিয়েছেন, ‘‘আমার বাড়িতে আসতে হলে মোবাইল ছাড়াই আসতে হবে। মোবাইলের দিকে তাকিয়ে হুঁ-হাঁ করায় আমার ঘোর আপত্তি। বরং যদি দুটো কথা বলে, তাতেই আমার মনের খোরাক পাই। টেকনোলজি নির্ভর হয়ে মানুষ এখন বোধবুদ্ধি হারিয়ে ফেলছে। এখন তো ওরা শর্ট ফর্মে বানান লিখে মেসেজ করে। এর ফলে না শিখছে শুদ্ধ বানান, না শিখছে ঠিক ব্যাকরণ। বরং ভুলটাই শিখছে। কেউ চিঠি লেখে না, বইও পড়ে না। যদিও বা পড়ে তা-ও আবার ডিজিটাল বই। ও আমার একদম পছন্দ না। বইয়ের পাতার গন্ধ পাব, আঙুল দিয়ে পাতা উল্টাব, তবেই তো মনে হয় বই পড়ছি।’’

বইয়ের কথা শুনেই মেজাজ ফুরফুরে হয়ে গেল সৌমিত্রর, ‘‘আমাদের সময় তো আর মোবাইল ছিল না। তাই ছেলেবেলায় পড়তে ভাল না লাগলে গল্পের বই পড়তাম। ওই পড়ার নেশাই আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।’’ এখনও বই ছাড়া থাকতে পারেন না তিনি। সদ্য শেষ করেছেন জেমস সাপিরোর ‘১৬০৬: উইলিয়াম শেক্সপিয়র অ্যান্ড ইয়ার অব লিয়র’ এবং শম্পা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বাম্মার কথা’।

বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি, মরাঠি, গুজরাতি ইত্যাদি অনেক ভাষায় তনুজা সাবলীল। তিনি মনে করেন, কোনও নতুন জায়গায় গিয়ে সেখানকার মানুষের সঙ্গে তাঁদের ভাষায় কথা বললে, তাঁরা একাত্ম বোধ করেন, আপন করে নেন সহজেই। এখন আর শুটিং নয়, নিজের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন নিয়ে ব্যস্ত তিনি। সেই সংগঠন বাচ্চাদের শিক্ষা দেওয়ার কাজ করে। এখনকার দিনে বাচ্চাদের পড়াশোনার ধরন তাঁর একেবারে পছন্দ নয়। তিন বছর বয়স থেকেই বাচ্চাদের স্কুলে ভর্তি করে দেওয়ার পক্ষে নন তিনি, ‘‘এখনকার স্কুলে বাচ্চাদের শুধু পড়তে শেখায়, ভাবতে শেখায় না। বোধ বুদ্ধি, যুক্তি একেবারেই তৈরি হচ্ছে না।’’

দুই প্রবীণ অভিনেতা বয়সের ভারে ন্যুব্জ নন। মানসিক ও শারীরিক ভাবে তাঁরা তরুণ। তিরাশিতে এসেও রোজকার রুটিন থেকে শারীরচর্চা বাদ পড়েনি সৌমিত্রর। ‘‘খিদে পেলে খাই, তেষ্টা পেলে জল খাই। ওয়র্কআউট করতে ভাল লাগে না। তবে নিয়মিত হাঁটি। আমার চর্চা তো মস্তিষ্কের,’’ ভুবনভোলানো হাসি নিয়ে বললেন তনুজা।

ঊর্মি নাথ, নবনীতা দত্ত

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE