Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

পুরুষের প্রেম-প্যাশন-পাপ

কিন্তু সুতো ছিঁড়ে শেষ অবধি গোঁত্তা খেল ঘুড়ি। লিখছেন গৌতম চক্রবর্তী।তিনটি কাহনের প্রথমটি ‘রাণুর প্রথম ভাগ’-এর লেখক বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের গল্প। সারা গায়ে সত্যজিৎ রায়ের আবেশ। দ্বিতীয়টি সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, ছবির শেষে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের সাররিয়ালিজম্-এর গন্ধ। তৃতীয়টি পরিচালক বৌদ্ধায়ন মুখোপাধ্যায়ের নিজের গল্প। অহেতুক চমকসর্বস্ব!

শেষ আপডেট: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০০:৪৭
Share: Save:

তিনটি কাহনের প্রথমটি ‘রাণুর প্রথম ভাগ’-এর লেখক বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের গল্প। সারা গায়ে সত্যজিৎ রায়ের আবেশ। দ্বিতীয়টি সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, ছবির শেষে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের সাররিয়ালিজম্-এর গন্ধ। তৃতীয়টি পরিচালক বৌদ্ধায়ন মুখোপাধ্যায়ের নিজের গল্প। অহেতুক চমকসর্বস্ব!

গল্প তিনটি নারী-পুরুষের বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক নিয়ে। আরও ভাল ভাবে, পুরুষের প্রেম ও প্যাশন নিয়ে। প্রথম গল্প ‘নাবালক’ পঞ্চাশের দশকের গন্ধমাখা সাদাকালো ছবি। রেডিওতে বন্যার খবর, কাগজে ‘অগ্নিপরীক্ষা’ রিলিজের বিজ্ঞাপন। বৃষ্টিতে খরাজ মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে তেলেভাজার আড্ডা, তাঁর বন্ধু সুমন মুখোপাধ্যায় মাঝে মাঝে লংফেলোর কবিতা আওড়ান, ছেলেবেলার প্রেমের গল্প বলেন। গ্রামের বাড়িতে আট বছরের ছেলে তখন কিছু না বুঝে পাড়ার ষোলো বছরের বউদি নয়নতারার প্রেমে পড়েছিল। শরীর তখনও জাগেনি, মনও কিছু বুঝত না। তবু ভাল লাগত নয়নতারাকে। সেই কালো মেয়ে পাড়ার বউমহলে আড্ডা দিত, বালকের নিস্পাপ নয়ন তাকে দেখে যেত। অভীক মুখোপাধ্যায়ের সিনেমাটোগ্রাফি এবং অর্ণব চক্রবর্তীর সঙ্গীত ছবিটাকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গিয়েছে। মাটির নিকোনো বাড়ি, তালগাছে সোঁ সোঁ হাওয়া, গ্রামের কাদামাখা রাস্তা... সবেতেই কোথায় যেন মায়া রহিয়া গেল।
সুমন মুখোপাধ্যায়ের মেক আপ চমৎকার। বাবরি চুল, সরু গোঁফ, মিহি কণ্ঠ, সব কিছু নিয়ে তিনি সেই সময়ের প্রেমিক চরিত্রে মানিয়ে গিয়েছেন। আরও ভাল আট বছরের বালক চরিত্রে বর্ষণ ও ষোলো বছরের মেয়ের চরিত্রে অনন্যা। সম্ভবত, এরাই ছবির সেরা দুই কাহন। বাকিটা সত্যজিৎ জানেন! পথের পাঁচালীর তুলসী চক্রবর্তীর মতো এখানে আছেন গুরুমশাই মনু মুখোপাধ্যায়। ‘সমাপ্তি’র অপূর্বর জলকাদায় আছড়ে পড়ার মতো গ্রামের কাদা রাস্তায় জুতো, বাক্সপ্যাঁটরা নিয়ে হাঁটে নয়নতারার স্বামী অক্ষয় (বিশ্বনাথ)। ‘আমি তোমার প্রেমে হব সবার কলঙ্কভাগী’ রবীন্দ্রসঙ্গীতটি চমৎকার ব্যবহার করা হয়েছে, কিন্তু বাড়াবাড়ি অন্যত্র। সাবটাইটেলে ব্র্যাকেট দিয়ে লেখা, ‘রবীন্দ্রনাথের গান’!

দ্বিতীয় গল্প ‘পোস্ট মর্টেম’-এ বর্ষার সকালে জয় সেনগুপ্তের বাড়িতে ভিজে ঝুপ্পুস হয়ে হাজির মোটা ফ্রেমের চশমা পরা সব্যসাচী চক্রবর্তী। সব্যসাচীর স্ত্রী জয় সেনগুপ্তের সঙ্গে প্রেম করতেন। দিঘা, গোপালপুরেও বেড়াতে গিয়েছেন। গত রাত্রে তিনি হঠাৎ আত্মহত্যা করেছেন। সব্যসাচী কারণ বুঝতে এসেছেন। আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিল কে? প্রেমিক না স্বামী? মোটা চশমার কাচের আড়াল থেকে সব্যসাচী যখন মৃত স্ত্রীর প্রেমিককে বলেন, ‘আপনার চিঠির কথাগুলি আমারই কথা, যেগুলি আমি ওকে বলতে পারতাম না’, চমৎকার! জয় প্রেমিকার চিঠি কলের তলায় ধোয়ামোছা করে ছিঁড়ে ফেলছেন, সেই দৃশ্যটিও ভাল। গোলমাল অন্যত্র। মর্গে থইথই জল, এগজস্ট ফ্যান, জয় সেনগুপ্ত মৃতদেহের সাদা কাপড় উঠিয়ে দেখছেন। আচমকা বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের প্রভাব। পরকীয়া প্রেম সাররিয়ালিস্ট স্বপ্ন হতে যাবে কোন দুঃখে? অবৈধ প্রেমে পরনারীরা নিজেদের পতিদেবতাটিকে উদার, মহানুভব ইত্যাদি বলে থাকেন, ঘোর বাস্তব। সিনেমাটিক পরাবাস্তবের ছিদ্র সেখানে নেই!

বৌদ্ধায়নের কাহিনি অবলম্বনে তৃতীয় গল্প ‘টেলিফোন’ আরও সাঙ্ঘাতিক। হোয়াট্সঅ্যাপে পরকীয়া, ইন ভিট্রো ফার্টিলিটি অনেক কিছুই আছড়ে পড়েছে। নো মেক আপ লুক, ভেজা চোখে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত সেখানে চমৎকার। তাঁর স্বামী আশিস বিদ্যার্থী পুলিশের সহকারী কমিশনার। খুনের তদন্তে গিয়ে এক নর্তকীর সঙ্গে আলাপ। অতঃপর বউ ঘুমিয়ে পড়লে হোয়াটস অ্যাপে মধ্যরাতের প্রেম। শেষে বাবার ফেলে যাওয়া লোডেড রিভলভার নিয়ে খেলতে খেলতে শিশুপুত্র মায়ের বুকে গুলি চালায়, রক্তে ভেজা ঋতুপর্ণার মৃত্যু। এমনই নাকি ছিল পুলিশ স্বামীর পরিকল্পনা! রোয়াল্ড ডালের গল্পের মতো চমক, শেষ দৃশ্যে অপরাধী-পুলিশ সব উল্টে যায়। কিন্তু প্রেমিকা হোয়াটস অ্যাপে উত্তর না দিলে আশিস বিদ্যার্থী ভিক্টোরিয়ার সামনে জিপ রেখে কেন যাত্রাপালার মতো চিৎকার করবেন, বোঝা যায় না।

তিনটি গল্পই তাই পুরুষের প্রেম-প্যাশন-পাপ নিয়ে। অহেতুক ‘তিন কন্যা’ টেনে লাভ নেই। সন্দীপ রায় একদা তৈরি করেছিলেন ‘চার’। রূপা গঙ্গোপাধ্যায়, অরিন্দম শীলেরা ছটি রিপুকেন্দ্রিক ছোট গল্প নিয়ে ‘ছয়’ নামে এক ছবি করেছিলেন। শরদিন্দু ও পরশুরামের তিনটি গল্প নিয়ে জয়দীপ ঘোষ তৈরি করেছিলেন ‘মায়াবাজার’। সুমন মুখোপাধ্যায়ের ‘মহানগর@কলকাতা’ তিনটি গল্পের সমাহার। সকলেই চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু এঁদের কারও ইমতিয়াজ আলি ছিলেন না।

সবচেয়ে বড় কথা, প্রথম ও শেষ গল্পে এত আকাশপাতাল তফাত কারও ছবিতে ছিল না। বাঙালির ইতিহাস নাই, সিনেমাও নাই!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE