গৌরব, মৌমিতা, সৌরভ (বাঁ দিক থেকে)
স্টুডিয়ো পাড়া থেকে আর্ট ডিরেক্টর এসে আলপনা দিতেন। ভিয়েন বসিয়ে মিষ্টি তৈরি হতো। গোটা বাড়ি জুড়ে সে এক এলাহি ব্যাপার-স্যাপার! ১৯৫০ সালে ছেলে গৌতম জন্মালেন, ওই বছরই মহানায়ক উত্তমকুমারের ইচ্ছেয় ভবানীপুরে গিরিশ মুখার্জ্জি রোডের চট্টোপাধ্যায় পরিবারে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো শুরু হল। শোনা যায়, অভিনেতা ছবি বিশ্বাসের বাড়ির কোজাগরী লক্ষ্মী পুজো দেখেই উত্তমকুমারের সাধ হয় নিজের বাড়িতেও লক্ষ্মীদেবীর আরাধনা করার।
কিন্তু মহানায়ক চলে যাওয়ার পরও পুজোর ধারা একই ভাবে বজায় রেখেছে চট্টোপাধ্যায় পরিবারের নতুন প্রজন্ম। তাঁর নাতি-নাতনি গৌরব, নবমিতা ও মৌমিতার হাতেই এখন পুজোর দায়-দায়িত্ব। হয়তো পুজোর ঠাঁটবাট কমেছে, কিন্তু ভক্তি বা নিষ্ঠায় ঘাটতি নেই। আলপনা থেকে বিসর্জন পুজোর সব কাজেই হাত লাগান গৌরব চট্টোপাধ্যায়। নবমিতা-গৌরব দু’জনেরই সিরিয়ালের শুটিং চলছিল। কিন্তু এ দিন দুই ভাই-বোন শুটিং সামলে পুজোর কাজে মেতে উঠেছিলেন। সঙ্গে ছিলেন মহানায়কের দুই ভাই তরুণ কুমার ও বরুণ কুমারের নাতি-নাতনিরাও।
পুজোর আগের রাতে পরিবারের ছেলেরা দেবী প্রতিমা নিয়ে আসেন কুমোরটুলি থেকে। চেনা ছাঁচে ফেলা যেমন লক্ষ্মীর মুখ হয়, এই দেবীর মুখের আদল কিন্তু একেবারেই আলাদা। এর পিছনে অবশ্য একটি গল্প আছে। ‘যদুভট্ট’ ছবির শুটিংয়ে মূর্তি গড়ছিলেন নিরঞ্জন পাল। শুটিং ফ্লোরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ে সেই দৃশ্য চোখে পড়ে উত্তমকুমারের। তিনি শিল্পীকে বাড়িতে ডাকেন লক্ষ্মী প্রতিমা গড়ার বায়না দেবেন বলে। শিল্পী বাড়িতে পৌঁছে উত্তমকুমারের খোঁজ করতে দেখলেন, গৌরীদেবী ঘর মুছছেন। তিনি ঘোমটার ফাঁক থেকে এক ঝলক তাকিয়ে শিল্পীকে বসতে বললেন আর তার পরে উত্তমকুমারকে ডেকে দিলেন। কিন্তু ওই মুহূর্তেই শিল্পীর চোখে মা লক্ষ্মীর ছবি আঁকা হয়ে যায়। তিনি ছাঁচ ভেঙে গৌরীদেবীর মুখের আদলে লক্ষ্মী মূর্তি গড়লেন। আজও প্রতিমার মুখের গড়নে রয়েছে সেই চেনা ছাপ।
কুমোরটুলি থেকে আনা দেবীমূর্তির পরনে থাকে লাল পাড় সাদা শাড়ি। পরিবারের তরফে জানা গেল, পুজোর সকালে দেবী সাজেন নতুন শাড়ি ও সোনার গয়নায়। বিসর্জনের সময় আবার দেবীকে লাল পাড় শাড়ি পরানো হয়। আর এই শাড়িটি প্রতি বছর পরিবারের কোনও মেয়ের হাতে তুলে দেওয়া হয়। পঞ্জিকা মেনে নিষ্ঠা সহকারে যে ভাবে উত্তমকুমারের হাতে পুজোর সূচনা হয়েছিল, আজও সেই ধারা চলছে।
লুচি, পাঁচ রকম ভাজা, বাঁধাকপির তরকারি, ফুলকপির ডালনা, পোলাও, চাটনি ও মিষ্টি দেওয়া হয় মা লক্ষ্মীর ভোগে। আগে বাড়িতে ভিয়েন বসিয়ে তৈরি হতো পান্তুয়া, দরবেশ ও গজা। এখন সে সব পাট চুকে গিয়েছে। কিন্তু আজও পাত পেড়ে খান প্রায় চারশো-পাঁচশো জন অতিথি। উত্তমকুমারের সময় থেকেই শুরু হয় এই আতিথেয়তার। ভোজনরসিক মহানায়কের কাছে পুজো বাড়িতে পেট পুরে না খেয়ে যাওয়াটা ছিল একেবারেই অনভিপ্রেত। শোনা যায়, তিনি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সকল নিমন্ত্রিতদের খাওয়াতেন। তার পরেই নিজে খেতে বসতেন। মেনুতে অবশ্যই থাকত লুচি, ছোলার ডাল, বেগুন বাসন্তী, আলুর দম, ধোকার ডালনা, ছানার ডালনা, মিষ্টি। ইদানীং মেনুতে ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার মেলবন্ধন ঘটেছে। পুজোর পরের দিন দরিদ্র নারায়ণ সেবা করতেন মহানায়ক। তিনি নিজেই সকলের পাতে খাবার পরিবেশন করতেন। কিন্তু এখন লোকবলের অভাবে সেই সেবা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। অবশ্য শোভাযাত্রা সহকারে প্রতিমা বিসর্জনের যে ধারা বজায় ছিল, তা কিন্তু আজও অমলিন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy