Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

মান্না দে-র মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা ছিল খুব

সবার সঙ্গে সমানভাবে মেলামেশা করতে তিনি— লিখছেন দেবপ্রসাদ চক্রবর্তীশান্তিভাই চলে গেছেন অনেক দিন। মান্নাদার আর এক প্রাণের বন্ধু ওম সেগান। এখনও আছেন তার প্রিয় শহর মুম্বইতে। মান্নাদা জন্মসূত্রে বাঙালি নিশ্চয়, কিন্তু তাঁর গান-বাজনা বলুন আর মেলামেশা বলুন, তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থে সর্বভারতীয়।

শেষ আপডেট: ১১ অগস্ট ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

শান্তিভাই চলে গেছেন অনেক দিন। মান্নাদার আর এক প্রাণের বন্ধু ওম সেগান। এখনও আছেন তার প্রিয় শহর মুম্বইতে। মান্নাদা জন্মসূত্রে বাঙালি নিশ্চয়, কিন্তু তাঁর গান-বাজনা বলুন আর মেলামেশা বলুন, তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থে সর্বভারতীয়। প্রিয় দুই বন্ধু—শান্তিভাই গুজরাতের মানুষ আর ওম সেগান পঞ্জাবী। সেগানজি কাজ করতেন এয়ার ইন্ডিয়াতে। গান-পাগল মানুষ। বিশেষ করে মান্নাদার গানের অন্ধ ভক্ত। কপাল এমন ভাল যে একসময় সেগানজির উপর দায়িত্ব পড়ল এয়ার ইন্ডিয়ার গান সংক্রান্ত সমস্ত বিষয়ের দেখাশোনার। নেশা এবং পেশা একসময় এক হয়ে গেল। কর্মসূত্রেই তাবড় তাবড় সঙ্গীত শিল্পীদের সঙ্গে সেগানজির যোগাযোগ হতে থাকে। সবাইকে ছাপিয়ে মান্নাদার সঙ্গে সম্পর্কটা ব্যক্তিগত পর্যায়ে চলে যায়। একটা পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে দুটি পরিবারের মধ্যে। একটা অদ্ভুত ব্যাপার মান্নাদার জীবনে বারবার ঘটেছে— জীবনের সমস্ত সংকটকালে ত্রাতা হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে সেগানজি। এমন কখনও হয়নি মান্নাদা বিপদের মধ্যে আর কোনও কারে সেগানজিকে পাওয়া যায়নি। ভুল করে আততায়ীরা মান্নাদাকে ছুরি মারল—গুরুতর আহত হলেন। দৌড়ে এলেন সেগানজি। সব কিছু সামলালেন। মান্নাদার বাইপাশ সার্জারি। সত্তরের উপর বয়স। বেশ মেজর অপারেশন। সামলালেন সেগানজি। বন্ধু তো মুখের কথা নয়, জীবনই বারবার পরীক্ষা নেয় কে কার সত্যিকারের বন্ধু। মান্নাদা চলে গেলেন ২৪ অক্টোবর, ২০১৩। সে খবর জানিয়ে প্রথম ফোনটা যায় যার কাছে, তিনি সেই ওম সেগান।

মান্নাদার মানিয়ে নেওয়ার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল। পেশাগত ভাবে ধরলেও তিনি জানতেন একদিকে কিছুটা ছাড়লে অন্য দিকে কতটা পাওয়া যাবে। লিরিকের ক্ষেত্রে দেখেছি হয়তো মুখরার কিছুটা লাইন মান্নাদার খুব ভাল লাগল, তিনি গানটা তৈরি করার জন্য সিলেক্ট করলেন। গানের বাকি অংশটা যথাসম্ভব রি-রাইট করালেন। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে একজন অতি শিক্ষিত গায়ক। শাস্ত্রীয় রাগের ছোঁয়ায় যখন আধুনিক বা সিনেমার গান গেয়েছেন, কোনও রকম গোঁড়ামির প্রশ্রয় দেননি। ‘জীবন রহস্য’ ছবির জন্য সুরকার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় তৈরি করেছেন ‘কে তুমি, কে তুমি, শুধুই ডাকো ইশারায়’। গাইবেন মান্নাদা। একটু পরীক্ষা-নিরীক্ষা তো করাই যায়।। বৃন্দাবনী সারং-এ একটা তান তৈরি করলেন, এর পর গানটা বাঁধলেন ছায়ানট-এর ছোঁয়ায়। অভিজিৎবাবু যে একটু ভয়ে ভয়ে ছিলেন না তা নয়। মান্নাদার রি-অ্যাকশন কী হবে, কী বলবেন? মান্নাদা গানটা শুনলেন। তার পর একটু মুচকি হেসে বললেন, ‘ভালই কায়দাটা করেছেন দেখছি।’ মান্নাদা গাইলেন এবং গানটি চিরদিনের গান হয়ে রইল। অনেক ক্লাসিকাল গাইয়ে হয়তো গানটা গাইতে দ্বিধাগ্রস্ত হতেন। কিন্তু মান্নাদা বর্তমানের নির্মাণের রূপায়ণ এবং ভবিষ্যৎ দেখতে পেতেন। এই প্রসঙ্গ উঠলে অভিজিৎবাবু মান্নাদার মিল পান রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে। ওই যে কবিগুরু বলেছিলেন না ‘হিন্দুস্থানী সঙ্গীত ভাল করে শিখলে আমরা লাভ না করে পারব না। তবে এ লাভটা হবে তখনই যখন আমরা তাদের দানটা যথার্থ আত্নসাৎ করে তাকে আপন রূপ দিতে পারব’। এমনটাই ভাবতেন মান্নাদাও।

‘সেলাম মেমসাহেব’ ছবিতে মান্নাদা অসাধারণ দুটি গান গেয়েছিলেন। অভিজিৎবাবু অসাধারণ সুরে বাঁধলেন ‘ঝরনা জল ঝরিয়ে’। গানটিতে নোট কম্বিনেশন যা আছে তাতে ‘শুদ্ধ ধা’-ই আসে। অভিজিৎবাবু ব্যাকরণ না দেখে ব্যবহার করলেন ‘কোমল ধা’। নাটকটা যেন আরও খোলতাই হচ্ছে। শাস্ত্র-জানা মান্নাদা বদ্ধ ঘর থেকে একটু বেরিয়ে আসতে দ্বিধা বোধ করলেন না। শ্রোতারা বাংলা গানে একটা অসাধারণ গায়কি পেল। এই ছবিতে মান্নাদার গাওয়া আর একটা ভিন্ন ধরনের গান ছিল ‘দেখে এলেম রূপের আগুন’। এমনই রূপ, দেখলে গায়ে ‘ছ্যাঁকা’ লাগে। সুরকার বললেন গানের ‘স্ক্যান’ করতে। যাতে একটু গ্যাপ দিয়ে তার পর ‘ছ্যাঁকা’ কথাটা গাওয়া যায়। মান্নাদা শুধু বললেন, ‘ঠিক আছে’। এ বার গাওয়ার সময় করলেন কি ‘ছ্যাঁকা’ বলার আগে একটা ‘উঁ’ করে আওয়াজ করলেন। হঠাৎ গায়ে আগুনের ছ্যাঁকা লাগলে যেমন হয় আর কি। এমন তাৎক্ষণিক।

‘সেলাম মেমসাহেব’ ১৯৭৫ সালের ছবি। পঁচিশ বছর পরে প্রায় একই রকম ঘটনা ঘটল। দীনেন গুপ্ত ছবি করছেন ‘ঋণমুক্তি’। মাতালের লিপে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখছেন ‘পেটে পড়লে মাল’। জমিয়ে সুর করেছেন অভিজিৎবাবু। দীনেনবাবু ভাষণ ভাবে গান-বোঝা পরিচালক। যখন গানের সিচুয়েশন বলেন মোটামুটি ভাবে গানের সঙ্গে যে সিনগুলো যাবে তাও বলে দেন সুরকার, গীতিকার এবং গায়কের সুবিধার্থে। চরিত্রটি মাতাল হয়ে গাইছে। অভিজিৎবাবু দেখলেন একটা ডায়লগ যদি ঢুকিয়ে দেওয়া যায়, তাতে গানটা খেলে ভাল। মান্নাদাকে সাহস করে বললেন সে কথা। ‘দেখছি কি করা যায়’ বলে মান্নাদা গাইতে আরম্ভ করলেন। যখন সেই জায়গাটা এল মান্নাদা একটা অদ্ভুত মাতলামির বাচন-ভঙ্গিতে বললেন—‘এই, কাতুকুতু দিসনে, কাতুকুতু দিস নে।’ সবাইতো হেসে খুন। সিচুয়েশন এমনটাই চাইছে। এই গায়কটি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত গুলে খেয়েছেন। কিন্তু কোনও ইগো নেই। অসাধারণ সাধারণ তিনি।

আবার যেখানে শাস্ত্রের প্রয়োগ, সেখানে মান্নাদা অন্য রকম। রবীন্দ্রনাথ যেমন ‘শেষের কবিতা’য় বলেছিলেন ‘কমলহীরের পাথরকেই বলে বিদ্যে আর ওর থেকে যে আলো ঠিকরে পড়ে তাকেই বলে কালচার’। মান্নাদার সঙ্গীত-বিদ্যার ‘কমলহীরে’ থেকে ঠিকরে ঠিকরে পড়ছে অপূর্ব গায়কির ‘কালচার’—সুরে, বচনে অনির্বচনীয়। ‘তিলোত্তমা’ ছবিতে একটা অসাধারণ কম্পোজিশন করেছিলেন অভিজিৎবাবু ‘গোলাপের অলি আছে’। গানটা তৈরির সময় ‘সা’ ভেবেছিলেন বি-ফ্লাট-কে, কিন্তু গানটা শুরু ‘ধা’ থেকে। অভিজিৎবাবুর সঙ্গে কথা হচ্ছিল তাঁর গড়িয়ার বাড়িতে। এই গানের প্রসঙ্গ উঠতে অভিজিৎদা খুব এক্সসাইটেড হয়ে গেলেন। বললেন, ‘যে কথা বলছিলাম। ওপেন কর্ড বি ফ্লাট, না ও মাইনর। আমি বি ফ্লাট স্কেল ভাবছি। গানটির মিউজিক অ্যারেঞ্জার অলোকনাথ দে ‘সা’ করলেন ‘ডি’কে। কিন্তু মান্নাদা করলেন কি ‘ও’ কে গেঁথে নিলেন ‘সা’ কে। গানটাকে ভৈরবীর আশ্রয়ে এমন কাওয়ালির অঙ্গে গাইতে থাকলেন, এ গানের অন্য একটি রূপ খুলে গেল। বাংলায় জন্ম নিল অতি কোমল, অতি মিষ্টি, অতি রোমান্টিক একটি মধুর কাওয়ালি গান। বাংলায়। সত্যি কথা বলতে কি মান্নাদাই বাংলাতে দুটি শ্রেষ্ঠ কাওয়ালি গান উপহার দিয়েছেন। অন্য গানটিও পুলকবাবুর লেখা। নিজের সুরে সমস্ত প্রেমিক-মনকে ‘রসের অতলে’ তলিয়ে দিয়েছিলেন মান্নাদা সে গানে—‘যখন কেউ আমাকে পাগল বলে, তার প্রতিবাদ করি আমি।’

‘জাতিস্মর’ ছবিতে কবীর সুমন কথা-সুরে একটা গান বাঁধলেন। ‘এ তুমি কেমন তুমি’। এই গানটি গেয়ে রূপঙ্কর জাতীয় পুরস্কার পেলেন। মুগ্ধ অভিজিৎবাবু কবীর সুমনকে তাঁর ভাল লাগা জানিয়ে একটি চিঠি লিখলেন। উত্তরে পেলেন সুমনের ফোন। কথা বলে তিনি তো অবাক। সুমন বলল, ‘এই গানটা তৈরির পিছনে অভিজিৎদা আপনারও অনেক অবদান আছে। কী রকম। বহু যুগ আগে অভিজিৎবাবু একটা গান বেঁধেছিলেন—‘এ তুমি সেই তুমি’। গেয়েছিলেন বাণী ঘোষাল। গানটার কথা অভিজিৎবাবু প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন। সুমন হুবহু মিউজিক পার্টসমেত গানটি গেয়ে শোনালেন। অভিজিৎবাবুর গান থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে গানটা শুরু করে তার পর নিজস্ব পথে নিয়ে গেছেন সুমন।

স্ত্রীর স্মরণে মান্নাদা যে গানগুলো তৈরি করেছিলেন সেখানে আমার একটা গানের কথা ছিল ‘এই সেই ঘর’। মান্নাদা দারুণ সুর করলেন। লেখার সময় খেয়ালই করিনি গৌরীপ্রসন্নের লেখা একটা গান মান্নাদা গেয়েছিলেন যার প্রথম লাইন ছিল ‘এই সেই ঘর’। সর্বনাশ। একই কথা। তাও আবার প্রথম লাইনেই। মান্নাদাকে বলি কী করে? বিষয়টা আমার অজ্ঞাতেই হয়ে গেছে। কিন্তু বলতে তো হবেই। একদিন ঈশ্বরকে স্মরণ করে বলেও ফেললাম। উত্তরে মান্নাদা অনেক গানের রেফারেন্স দিলেন যেখানে এমন হয়েছে। আমাকে বললেন—‘অপনার যদি অসুবিধা না হয়, তবে আমারও কোনও প্রবলেম নেই।’

মানিয়ে নেওয়ার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল— লিখছেন দেবপ্রসাদ চক্রবর্তী

শান্তিভাই চলে গেছেন অনেক দিন। মান্নাদার আর এক প্রাণের বন্ধু ওম সেগান। এখনও আছেন তার প্রিয় শহর মুম্বইতে। মান্নাদা জন্মসূত্রে বাঙালি নিশ্চয়, কিন্তু তাঁর গান-বাজনা বলুন আর মেলামেশা বলুন, তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থে সর্বভারতীয়। প্রিয় দুই বন্ধু—শান্তিভাই গুজরাতের মানুষ আর ওম সেগান পঞ্জাবী। সেগানজি কাজ করতেন এয়ার ইন্ডিয়াতে। গান-পাগল মানুষ। বিশেষ করে মান্নাদার গানের অন্ধ ভক্ত। কপাল এমন ভাল যে একসময় সেগানজির উপর দায়িত্ব পড়ল এয়ার ইন্ডিয়ার গান সংক্রান্ত সমস্ত বিষয়ের দেখাশোনার। নেশা এবং পেশা একসময় এক হয়ে গেল। কর্মসূত্রেই তাবড় তাবড় সঙ্গীত শিল্পীদের সঙ্গে সেগানজির যোগাযোগ হতে থাকে। সবাইকে ছাপিয়ে মান্নাদার সঙ্গে সম্পর্কটা ব্যক্তিগত পর্যায়ে চলে যায়। একটা পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে দুটি পরিবারের মধ্যে। একটা অদ্ভুত ব্যাপার মান্নাদার জীবনে বারবার ঘটেছে— জীবনের সমস্ত সংকটকালে ত্রাতা হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে সেগানজি। এমন কখনও হয়নি মান্নাদা বিপদের মধ্যে আর কোনও কারে সেগানজিকে পাওয়া যায়নি। ভুল করে আততায়ীরা মান্নাদাকে ছুরি মারল—গুরুতর আহত হলেন। দৌড়ে এলেন সেগানজি। সব কিছু সামলালেন। মান্নাদার বাইপাশ সার্জারি। সত্তরের উপর বয়স। বেশ মেজর অপারেশন। সামলালেন সেগানজি। বন্ধু তো মুখের কথা নয়, জীবনই বারবার পরীক্ষা নেয় কে কার সত্যিকারের বন্ধু। মান্নাদা চলে গেলেন ২৪ অক্টোবর, ২০১৩। সে খবর জানিয়ে প্রথম ফোনটা যায় যার কাছে, তিনি সেই ওম সেগান।

মান্নাদার মানিয়ে নেওয়ার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল। পেশাগত ভাবে ধরলেও তিনি জানতেন একদিকে কিছুটা ছাড়লে অন্য দিকে কতটা পাওয়া যাবে। লিরিকের ক্ষেত্রে দেখেছি হয়তো মুখরার কিছুটা লাইন মান্নাদার খুব ভাল লাগল, তিনি গানটা তৈরি করার জন্য সিলেক্ট করলেন। গানের বাকি অংশটা যথাসম্ভব রি-রাইট করালেন। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে একজন অতি শিক্ষিত গায়ক। শাস্ত্রীয় রাগের ছোঁয়ায় যখন আধুনিক বা সিনেমার গান গেয়েছেন, কোনও রকম গোঁড়ামির প্রশ্রয় দেননি। ‘জীবন রহস্য’ ছবির জন্য সুরকার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় তৈরি করেছেন ‘কে তুমি, কে তুমি, শুধুই ডাকো ইশারায়’। গাইবেন মান্নাদা। একটু পরীক্ষা-নিরীক্ষা তো করাই যায়।। বৃন্দাবনী সারং-এ একটা তান তৈরি করলেন, এর পর গানটা বাঁধলেন ছায়ানট-এর ছোঁয়ায়। অভিজিৎবাবু যে একটু ভয়ে ভয়ে ছিলেন না তা নয়। মান্নাদার রি-অ্যাকশন কী হবে, কী বলবেন? মান্নাদা গানটা শুনলেন। তার পর একটু মুচকি হেসে বললেন, ‘ভালই কায়দাটা করেছেন দেখছি।’ মান্নাদা গাইলেন এবং গানটি চিরদিনের গান হয়ে রইল। অনেক ক্লাসিকাল গাইয়ে হয়তো গানটা গাইতে দ্বিধাগ্রস্ত হতেন। কিন্তু মান্নাদা বর্তমানের নির্মাণের রূপায়ণ এবং ভবিষ্যৎ দেখতে পেতেন। এই প্রসঙ্গ উঠলে অভিজিৎবাবু মান্নাদার মিল পান রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে। ওই যে কবিগুরু বলেছিলেন না ‘হিন্দুস্থানী সঙ্গীত ভাল করে শিখলে আমরা লাভ না করে পারব না। তবে এ লাভটা হবে তখনই যখন আমরা তাদের দানটা যথার্থ আত্নসাৎ করে তাকে আপন রূপ দিতে পারব’। এমনটাই ভাবতেন মান্নাদাও।

‘সেলাম মেমসাহেব’ ছবিতে মান্নাদা অসাধারণ দুটি গান গেয়েছিলেন। অভিজিৎবাবু অসাধারণ সুরে বাঁধলেন ‘ঝরনা জল ঝরিয়ে’। গানটিতে নোট কম্বিনেশন যা আছে তাতে ‘শুদ্ধ ধা’-ই আসে। অভিজিৎবাবু ব্যাকরণ না দেখে ব্যবহার করলেন ‘কোমল ধা’। নাটকটা যেন আরও খোলতাই হচ্ছে। শাস্ত্র-জানা মান্নাদা বদ্ধ ঘর থেকে একটু বেরিয়ে আসতে দ্বিধা বোধ করলেন না। শ্রোতারা বাংলা গানে একটা অসাধারণ গায়কি পেল। এই ছবিতে মান্নাদার গাওয়া আর একটা ভিন্ন ধরনের গান ছিল ‘দেখে এলেম রূপের আগুন’। এমনই রূপ, দেখলে গায়ে ‘ছ্যাঁকা’ লাগে। সুরকার বললেন গানের ‘স্ক্যান’ করতে। যাতে একটু গ্যাপ দিয়ে তার পর ‘ছ্যাঁকা’ কথাটা গাওয়া যায়। মান্নাদা শুধু বললেন, ‘ঠিক আছে’। এ বার গাওয়ার সময় করলেন কি ‘ছ্যাঁকা’ বলার আগে একটা ‘উঁ’ করে আওয়াজ করলেন। হঠাৎ গায়ে আগুনের ছ্যাঁকা লাগলে যেমন হয় আর কি। এমন তাৎক্ষণিক।

‘সেলাম মেমসাহেব’ ১৯৭৫ সালের ছবি। পঁচিশ বছর পরে প্রায় একই রকম ঘটনা ঘটল। দীনেন গুপ্ত ছবি করছেন ‘ঋণমুক্তি’। মাতালের লিপে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখছেন ‘পেটে পড়লে মাল’। জমিয়ে সুর করেছেন অভিজিৎবাবু। দীনেনবাবু ভাষণ ভাবে গান-বোঝা পরিচালক। যখন গানের সিচুয়েশন বলেন মোটামুটি ভাবে গানের সঙ্গে যে সিনগুলো যাবে তাও বলে দেন সুরকার, গীতিকার এবং গায়কের সুবিধার্থে। চরিত্রটি মাতাল হয়ে গাইছে। অভিজিৎবাবু দেখলেন একটা ডায়লগ যদি ঢুকিয়ে দেওয়া যায়, তাতে গানটা খেলে ভাল। মান্নাদাকে সাহস করে বললেন সে কথা। ‘দেখছি কি করা যায়’ বলে মান্নাদা গাইতে আরম্ভ করলেন। যখন সেই জায়গাটা এল মান্নাদা একটা অদ্ভুত মাতলামির বাচন-ভঙ্গিতে বললেন—‘এই, কাতুকুতু দিসনে, কাতুকুতু দিস নে।’ সবাইতো হেসে খুন। সিচুয়েশন এমনটাই চাইছে। এই গায়কটি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত গুলে খেয়েছেন। কিন্তু কোনও ইগো নেই। অসাধারণ সাধারণ তিনি।

আবার যেখানে শাস্ত্রের প্রয়োগ, সেখানে মান্নাদা অন্য রকম। রবীন্দ্রনাথ যেমন ‘শেষের কবিতা’য় বলেছিলেন ‘কমলহীরের পাথরকেই বলে বিদ্যে আর ওর থেকে যে আলো ঠিকরে পড়ে তাকেই বলে কালচার’। মান্নাদার সঙ্গীত-বিদ্যার ‘কমলহীরে’ থেকে ঠিকরে ঠিকরে পড়ছে অপূর্ব গায়কির ‘কালচার’—সুরে, বচনে অনির্বচনীয়। ‘তিলোত্তমা’ ছবিতে একটা অসাধারণ কম্পোজিশন করেছিলেন অভিজিৎবাবু ‘গোলাপের অলি আছে’। গানটা তৈরির সময় ‘সা’ ভেবেছিলেন বি-ফ্লাট-কে, কিন্তু গানটা শুরু ‘ধা’ থেকে। অভিজিৎবাবুর সঙ্গে কথা হচ্ছিল তাঁর গড়িয়ার বাড়িতে। এই গানের প্রসঙ্গ উঠতে অভিজিৎদা খুব এক্সসাইটেড হয়ে গেলেন। বললেন, ‘যে কথা বলছিলাম। ওপেন কর্ড বি ফ্লাট, না ও মাইনর। আমি বি ফ্লাট স্কেল ভাবছি। গানটির মিউজিক অ্যারেঞ্জার অলোকনাথ দে ‘সা’ করলেন ‘ডি’কে। কিন্তু মান্নাদা করলেন কি ‘ও’ কে গেঁথে নিলেন ‘সা’ কে। গানটাকে ভৈরবীর আশ্রয়ে এমন কাওয়ালির অঙ্গে গাইতে থাকলেন, এ গানের অন্য একটি রূপ খুলে গেল। বাংলায় জন্ম নিল অতি কোমল, অতি মিষ্টি, অতি রোমান্টিক একটি মধুর কাওয়ালি গান। বাংলায়। সত্যি কথা বলতে কি মান্নাদাই বাংলাতে দুটি শ্রেষ্ঠ কাওয়ালি গান উপহার দিয়েছেন। অন্য গানটিও পুলকবাবুর লেখা। নিজের সুরে সমস্ত প্রেমিক-মনকে ‘রসের অতলে’ তলিয়ে দিয়েছিলেন মান্নাদা সে গানে—‘যখন কেউ আমাকে পাগল বলে, তার প্রতিবাদ করি আমি।’

‘জাতিস্মর’ ছবিতে কবীর সুমন কথা-সুরে একটা গান বাঁধলেন। ‘এ তুমি কেমন তুমি’। এই গানটি গেয়ে রূপঙ্কর জাতীয় পুরস্কার পেলেন। মুগ্ধ অভিজিৎবাবু কবীর সুমনকে তাঁর ভাল লাগা জানিয়ে একটি চিঠি লিখলেন। উত্তরে পেলেন সুমনের ফোন। কথা বলে তিনি তো অবাক। সুমন বলল, ‘এই গানটা তৈরির পিছনে অভিজিৎদা আপনারও অনেক অবদান আছে। কী রকম। বহু যুগ আগে অভিজিৎবাবু একটা গান বেঁধেছিলেন—‘এ তুমি সেই তুমি’। গেয়েছিলেন বাণী ঘোষাল। গানটার কথা অভিজিৎবাবু প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন। সুমন হুবহু মিউজিক পার্টসমেত গানটি গেয়ে শোনালেন। অভিজিৎবাবুর গান থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে গানটা শুরু করে তার পর নিজস্ব পথে নিয়ে গেছেন সুমন।

স্ত্রীর স্মরণে মান্নাদা যে গানগুলো তৈরি করেছিলেন সেখানে আমার একটা গানের কথা ছিল ‘এই সেই ঘর’। মান্নাদা দারুণ সুর করলেন। লেখার সময় খেয়ালই করিনি গৌরীপ্রসন্নের লেখা একটা গান মান্নাদা গেয়েছিলেন যার প্রথম লাইন ছিল ‘এই সেই ঘর’। সর্বনাশ। একই কথা। তাও আবার প্রথম লাইনেই। মান্নাদাকে বলি কী করে? বিষয়টা আমার অজ্ঞাতেই হয়ে গেছে। কিন্তু বলতে তো হবেই। একদিন ঈশ্বরকে স্মরণ করে বলেও ফেললাম। উত্তরে মান্নাদা অনেক গানের রেফারেন্স দিলেন যেখানে এমন হয়েছে। আমাকে বললেন—‘অপনার যদি অসুবিধা না হয়, তবে আমারও কোনও প্রবলেম নেই।’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Manna Dey
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE