Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

নীরজা-কে ভাল না বেসে উপায় নেই

অসহিষ্ণুতার সময়ে সিনেমার এক উজ্জ্বল উদ্ধার। লিখছেন গৌতম চক্রবর্তীআত্মসম্মান খুইয়ে দেশপ্রেমের জিগির তুলে আইনজীবীরা যখন পাতিয়ালা হাউস কোর্টে অভিযুক্তের ওপর কিল-চড়-লাথি সহযোগে ঝাঁপিয়ে পড়েন, তখন ‘নীরজা’ যেন নিয়ে আসে টাটকা বাতাস ।

শেষ আপডেট: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০০:১০
Share: Save:

হিন্দুস্থান টাইমস পত্রিকার সাংবাদিক হরিশ ভানোট ও তাঁর স্ত্রী রমা জানতেন, ১৯৮৬ সালে তাঁদের মেয়ে নীরজা নিজের প্রাণের বিনিময়ে হাইজ্যাক হওয়া ৩৫৯ জন বিমানযাত্রীকে বাঁচিয়েছেন। জানতেন না, তিরিশ বছর পর সেই ঘটনা নিয়ে এক সিনেমা নিঃশব্দে কয়েক কোটি ভারতবাসীকে বাঁচাতে পারে। সিনেমার শেষ দৃশ্যে নীরজার নামে ট্রাস্ট ঘোষণা করছেন মা। সামনের সারিতে বাবা ও দুই ভাই। পাশে জাতীয় পতাকা এবং নীরজাবেশী সোনম কপূরের ছবি। এ দেশে বীরত্বের জন্য অশোকচক্র সম্মানে ভূষিত একমাত্র নারী নীরজা। সারা সিনেমার এই একটি দৃশ্যেই ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা। পর্দায় লেখা ফোটে, ট্রাস্ট দেড় লক্ষ টাকার দুটি পুরস্কার দেবে। শর্ত একটাই। তাঁদের মধ্যে থাকবে নীরজার দুটি গুণ:

১) যাবতীয় বাধা অতিক্রম করে যাঁরা নিজের কর্তব্যে অটল।

২) নিজেদের প্রতি অবিচার যারা সহ্য করবে না, আত্মসম্মানকে এতটুকু নুইয়ে দেবে না।

অসহিষ্ণু ভারতে এখানেই কি কাকতালীয় ভাবে ঘটে গেল না সিনেমার উজ্জ্বল উদ্ধার? নিজেদের কর্তব্যবোধ, আত্মসম্মান খুইয়ে দেশপ্রেমের জিগির তুলে আইনজীবীরা যখন পাতিয়ালা হাউস কোর্টে অভিযুক্তের ওপর কিল-চড়-লাথি সহযোগে ঝাঁপিয়ে পড়েন, দেশের মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রীর পৌরোহিত্যে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা সবাই পড়াশোনার আসল কাজটা শিকেয় তুলে রোজ ৩৫ কেজির জাতীয় পতাকা তোলার পরিকল্পনা করেন, তখন ‘নীরজা’র এই দৃশ্য যেন নিয়ে আসে টাটকা বাতাস। যাবতীয় ভয়কে হারিয়ে নিঃশব্দে নিজের কাজে অটল থাকো, সারা দেশ তোমার জন্য গর্ব বোধ করবে।

‘নীরজা’ ছবির আসল বৈশিষ্ট্য নিচু তারে বাঁধা এই আলাপনে। দেশপ্রেমের নামে পাকিস্তানবিরোধী জিগির নেই। উল্টে করাচি বিমানবন্দরের অফিসার সহকর্মীকে ধমকান, ‘পাকিস্তানি পাসপোর্টের কত জন ছিনতাই হওয়া বিমানে আছেন মানে? অন্যদের মৃত্যুর মুখে ছেডে আসবে?’ নীরজা ভানোট শুধু অশোকচক্রে সম্মানিত হননি। অবিশ্বাস্য করুণার কথা মনে রেখে মৃত্যুর পর পাকিস্তান তাঁকে ‘তমঘা ই ইনসানিয়ৎ’ পদকে সম্মানিত করেছিল। আমেরিকা দিয়েছিল ‘ফ্লাইট সেফটি ফাউন্ডেশন হিরোইজম অ্যাওয়ার্ড’।

বাস্তবের এই বীরাঙ্গনাকে নিয়ে ছবি করতে গেলে মারকাটারি সংলাপ ও গানের দৃশ্য দিয়ে অতিনাটকীয়তা বলিউডের চেনা রোগ। কয়েক সপ্তাহ আগে ‘এয়ারলিফ্ট’ ছবিতেই দেখা গিয়েছিল, উপসাগরীয় যুদ্ধে কুয়েতের ভারতীয় দূতাবাস ছেড়ে কর্মীরা পালিয়ে গিয়েছেন।

বাস্তবে এমনটা আদতে ঘটেনি। তার পর অক্ষয়কুমারের চেষ্টায় আটকে-পড়া ভারতীয়দের উদ্ধার করতে এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান আকাশে দেখা দেয়, জাতীয় সঙ্গীতের সুরে তেরঙা পতাকা আকাশে উড়তে থাকে। রাম মাধবানির এই ছবিতে কিন্তু সেই মেলোড্রামা নেই। এখানে নীরজা আদ্যন্ত স্বাভাবিক মেয়ে, ছিনতাইকারীদের দেখে ভয় পায়, তাদের শাসানিতে ‘মেরে সপনোকি রানি’ গাইতে গাইতে চোখে জলের ধারা নামে। প্রেমিক তাকে বিয়ে করতে চায়, কিন্তু ভাঙা বিয়ের অভিজ্ঞতায় ক্লিন্ন নীরজা সাহস পায় না। সে সুপারউওম্যান নয়, মা-বাবার আদরের লাডু। আপনার-আমার চেনা আর পাঁচজন সাধারণ মেয়ের মতো। সেই সাধারণ মেয়ে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা রেখে কী ভাবে অসাধারণ হয়ে উঠতে পারে, নীরজা তারই ছবি।

সেখানেই সোনম কপূরের এ যাবৎকালের সেরা পারফরম্যান্স। পর্দায় তখন হাইজ্যাকারদের উন্মত্ততা। প্লেনের সিটে যাত্রীরা ভয়ে কুঁকড়ে, বিমানসেবিকারাও আতঙ্কিত। হাইজ্যাকাররা তাঁদের সামনেই গুলি করে এক জনকে টারম্যাকে ছুড়ে দিয়েছে। নীরজার মুখে রক্তের ছিটে, ওয়াশরুমে ভয়ে কাঁদছে। কান্নাই বোধ হয় তাকে অতীত অভিজ্ঞতার সামনে দাঁড় করাল।

অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ, বিয়ের পর বিদেশে স্বামীর ঘর করতে গিয়েছিল সে। মাত্র দুই মাসের বিবাহিত জীবনের অভিজ্ঞতায় তখন বারংবার সহ্য করতে হয়েছে পণের জন্য স্বামীর অত্যাচার। স্বামী খেতে দেয় না, মডেলিং-এ তার শখ দেখে তাকে অকথা-কুকথা বলে। নীরজা মুম্বইয়ে মা-বাবার কাছে চলে আসে। ফ্ল্যাশব্যাক শেষ, বিমানবালা চোখের জল মুছে তার পরিচিত হাসি নিয়ে উঠে দাঁড়ায়।

এ কে ৪৭ হাতে জঙ্গি আটকে দেয়, ‘কোথায়? সিটে গিয়ে বোস।’ নীরজা যাত্রীদের জন্য গ্লাসে জল ভরতে ভরতে হাসিমুখে জবাব দেয়, ‘আমার কাজ করছি স্যার। এঁদের সবাইকে খাবার, জল দেওয়া আমার কাজ।’ সোনম এই বদলটি কোনও সংলাপ ছাড়াই নীরব অভিব্যক্তিতে বিশ্বাস্য ভঙ্গিতে ফুটিয়ে তুলেছেন। সেই বিশ্বস্ততাই পরিচালকের কাজ অর্ধেক হাসিল করে দিয়েছে। নারী-স্বাধীনতার বুকনি নেই। কিন্তু দর্শকের মনে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য, পণের জন্য বা বিভিন্ন কারণে স্ত্রীর ওপর অত্যাচার চালায় যারা, সেই স্বামীরাও কি সন্ত্রাসবাদীদের মতোই ভয়ঙ্কর নয়? বাস্তব এই সন্ত্রাসই নীরজাকে প্রথম আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছিল। মাধবানির ছবিতে নীরজাকে লেখা তার স্বামীর চিঠির দৃশ্য আছে ঠিকই, কিন্তু শেষ চিঠিটাই নেই। সেই চিঠিতে স্বামী নীরজাকে লিখেছিল, ‘তুমি কী? সামান্য একটা গ্র্যাজুয়েট ছাড়া আর কিছুই তো নও।’ ঘটনা, নীরজা সেই চিঠি পেয়ে প্যান অ্যাম এয়ারলাইন্সে এয়ারহোস্টেস হওয়ার জন্য আবেদন করে। দশ হাজার আবেদনকারিণীর মধ্যে থেকে ৮০ জন নির্বাচিত হয়। মায়ামিতে ট্রেনিং-এর জন্য তাদের যেতে হয়। এবং ট্রেনিং শেষে এয়ারহোস্টেস নয়, প্যান অ্যাম তাকে ‘ফ্লাইট পারসার’ পদে নিয়োগ করে।

বিমানসেবিকাদের মধ্যে যিনি প্রধান, তিনিই ফ্লাইট পারসার। হরিশ ভানোট মেয়ের মৃত্যুর পর একটি লেখায় লিখেছিলেন, ‘মেয়েটা ইস্পাতকঠিন স্নায়ু দিয়ে ওই প্রশ্নটার মোকাবিলা করেছিল। বুঝিয়ে দিয়েছিল সে কে!’ তিরিশ বছর পর আজ সিনেমার সঙ্গে বাস্তব মেলাতে বসলে মনে হয়, আত্মবিশ্বাসী নীরজা সে দিন বিশেষ এক জনকে নয়, আধিপত্যবাদী পুরুষতন্ত্রকেই চ্যালেঞ্জ করেছিল। বক্তৃতা নয়, নিজের জীবন আর কাজ দিয়ে যে এ ভাবে চ্যালেঞ্জ নিতে পারে, পরবর্তী প্রজন্ম তাকেই মনে রাখে। জঙ্গিরা বিমানে গুলি ছুড়তে আরম্ভ করলে নীরজা এমারজেন্সি এগজিট খুলে যাত্রীদের আগে বের করে দেয়।

সহকর্মীদের বার হতে বলে, তিনটি বাচ্চাকে গুলি থেকে বাঁচাতে গিয়ে নিজে গুলিবিদ্ধ হয়। এখানে সেই সব দৃশ্য আছে, পরের কথা নেই। ওই তিন শিশুর এক জন বড় হয়ে আজ পাইলট, বলেছে, ‘নীরজা তার আদর্শ। তার জন্যই সে আজ বেঁচে আছে।’ এই ছবিতে দু’জনের কথা আলাদা ভাবে না বললে নয়। নীরজার বাবার চরিত্রে যোগেন্দ্র টিক্কু ও মা শাবানা আজমি। নীরজা যে উড়ানে প্রথম ফ্লাইট পারসার, প্যান অ্যামের সেই উড়ান হাইজ্যাকারদের কবলে। মা-বাবা কেউই একে অন্যের সামনে চোখের জল ফেলছেন না, উল্টে পরস্পরকে বিশ্বাস জোগাচ্ছেন। জাতীয় পতাকার সামনে ‘নীরজা ভানোট ট্রাস্ট’ তৈরির বক্তৃতায় শাবানা এক বারও বলছেন না, তাঁর মেয়ে বীর ছিল।

বরং বলছেন, ‘মেয়েটা তো বাচ্চা ছিল। জানতাম, জন্মদিনে আব্দার করে, রাজেশ খন্নার ছবি দেখতে ভালবাসে। কী ভাবে জঙ্গিদের হাত থেকে মানুষকে বাঁচাল, আজও বুঝতে পারিনি।’ ট্রাস্ট ঘোষণা, অতঃপর শেষ দৃশ্যে মৃত নীরজা এসে জড়িয়ে ধরে মাকে। রাম মাধবানি কোনও বীরাঙ্গনার গল্প বলেননি, বলেছেন একটি পরিবারের কাহিনি। বাচ্চাটা বাইরে বেরিয়ে কফিনবন্দি হয়ে পরিবারে ফিরে এলে সেই পরিবারের কী ঘটে, তার কাহিনি। সেখানেই এই ছবি জিতছে, দর্শকের মনে দাগ কাটছে। নীরজার পরিবার তো শুধু মুম্বইয়ের ফ্ল্যাটবাড়িতে ছিল না, ছিল প্যান অ্যামের ওই অভিশপ্ত উড়ানে। জলের গ্লাস এনে তাই সে প্রথমেই পুত্রহারা মাকে জড়িয়ে ধরে, বাচ্চাদের জড়িয়ে ধরে সাহস জোগায়।

নীরজা তাই অসমসাহসী কোনও বীরবালার কাহিনি নয়, পাশের বাড়ির আদুরে মেয়েটাকে নিয়ে তৈরি সিনেমা। সে যে কখন কী ভাবে চমকে দেয় কে জানে! ফ্ল্যাশব্যাকে একটা অহেতুক গান থাকা সত্ত্বেও ছবিটাকে তাই ভাল না বেসে উপায় নেই!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

movie neerja review
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE