রাখি ও শশী
তাঁরা একসঙ্গে প্রায় বারোটি ছবিতে অভিনয় করেছেন। আন্তর্জাল সেটাই বলছে। অতএব সদ্যপ্রয়াত অভিনেতা সম্পর্কে বলার জন্য রাখির চেয়ে ভাল আর কে-ই বা হতে পারেন। কিন্তু বিগত সময়ের এই অভিনেত্রীকে ফোনে পাওয়া দুরূহ। তিনি অসুস্থও। তাও ফোনটা করেই ফেললাম। এবং জ্যাকপট পাওয়ার মতো তিনি ফোন তুললেনও। শশী কপূর সম্পর্কে তাঁর স্মৃতির কথা বলতেই, প্রতিবেদককে প্রশ্ন করলেন রাখি, ‘‘খুব কাছের কেউ চলে গেলে, তখন কি কথা বলা যায়?’’ পেশাদারি মনের মধ্যে ফুলতে থাকা ফানুসে কেউ পিন ফুটিয়ে দিল। চুপ করে রইলাম। নীরবতা ভঙ্গ করলেন, ‘‘কষ্ট থেকে মুক্তি পেয়েছেন। যাঁরা ওঁকে ভালবাসতেন, তাঁদের কাছে আছেন। কাল থেকে উনি আমার কাছে আছেন। অনেক কিছু শিখেছি ওঁর কাছে। বারোর চেয়ে বেশি ছবি করেছি আমরা। চারটে ছবি মুক্তিই পায়নি। ‘শর্মিলি’ থেকে শুরু। ‘বসেরা’য় শেষ। উনি ছিলেন আমার পরিবারের একজন। ওঁর বাচ্চাদের দেখেছি ছোট থেকে। জেনিফারজিকে। আমাকে শশীজি কী বলে ডাকত জানো?’’ এতক্ষণ পর হাসলেন। আমার মনের ভার খানিক লাঘব হল। ‘‘মা কালী!’’ আবার হেসে উঠলেন। ‘‘আমি রেগে যেতাম। উনি খেপাতেন, ‘দেখো মা কালী আয়ি হ্যায়।’ আবদার করতাম ওঁর কাছে। হাত পা বেঁধে পকেট থেকে টাকা নিয়ে শপিং করতে যেতাম। উনি ছিলেন ভীষণ ডিসেন্ট। রেগে গেলে চুপ করে যেতেন। চোখ লাল হয়ে যেত...’’ চুপ করে গেলেন।
স্মৃতির কথায় উনি আনমনা, ‘‘কাল থেকে একা বসে শুধু ভাবছি। জানতাম উনি অসুস্থ। শুনলাম, সারা শরীরে টিউব লাগানো... কষ্ট হচ্ছিল...’’ মাঝে মাঝেই কথা কেটে যাচ্ছে রাখির। পেশাদার সম্পর্কে এমন গভীরতা আগে বোধহয় এ ভাবে অনুভব করিনি।
আরও পড়ুন: শশীকে চিরবিদায়, অমিতাভ, শাহরুখ-সহ উপস্থিত অনেকেই
‘‘জেনিফারজি শশীজির খাওয়া কন্ট্রোল করতেন। উনি ফ্লাস্কে ব্ল্যাক কফি আর স্যালাড পাঠাতেন। শশীজি বলতেন ‘ঘাসফুস’। জেনিফারজি চলে যাওয়ার পর শশীজির জীবন থেকে কন্ট্রোলটাই চলে গেল।’’ একটা প্রশ্ন করেই ফেললাম, ‘‘শেষ কবে দেখা হয়েছিল আপনাদের?’’ ‘‘আমার সঙ্গে ওঁর বহু বছর দেখা হয়নি। শশীজি বাইরে বেরোতেন না। আমিও না। ওঁর সঙ্গে শেষ দেখা বম্বে এয়ারপোর্টে। বললাম, কী ব্যাপার, এত মোটা হয়ে যাচ্ছেন? বললেন, ‘মুঝে জো করনা হ্যায় করনে দো।’ আমার হাতে একটা ব্যাগ ছিল, সেটা হাতে তুলে বাস অবধি পৌঁছে দিলেন। সেটা সব সময় করতেন উনি।’’ বলতে বলতে গলা ধরে আসে রাখির... ‘‘যা চাইতাম, কিনে আনতেন আমার জন্য।’’ কান্নার দমকে কথা বন্ধ হয়ে গেল তঁার... আমার কি ফোন রেখে দেওয়া উচিত? দ্বিধান্বিত আমি। কয়েক সেকেন্ড পর ধরা গলায় বললেন, ‘‘একবার কাঠের বাঁদর কিনে এনেছিলেন আমার জন্য। সেটা দেওয়ালে টাঙিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এটা দেখে আমার কথা মনে কোরো।’ আমাদের বাড়িতে আসতেন মায়ের কাছে চিংড়ি খেতে। জন্মের পর আমার মেয়ে বসকিকে হসপিটালে দেখতে প্রথম এসেছিলেন শশীজি।’’
শর্মিলি
‘শর্মিলি’র কথা মনে পড়ে? ‘‘ওটাই আমাদের প্রথম কাজ। মালাডে শ্যুটিং হচ্ছিল। সকাল সকাল শ্যুটিং। আমাকে বলতেন, ‘পাঁচটার সময় বাড়ি থেকে বেরোবে। যদি সেটে পৌঁছে দেখি, তুমি আসোনি, তা হলে ছবি থেকে বের করে দেব।’ এ ভাবে ধমকাতেন। কী ভাবে সিগারেটের রিং বানাতে হয় শিখিয়েছিলেন। আমি তো মডার্ন কস্টিউমের মধ্যে ছিলাম না। উনি আমাকে সুইমিং কস্টিউম এনে দিয়েছিলেন। ‘শর্মিলি’তে সেটা পরে একটা দৃশ্য ছিল। আমি বললাম, ওই পোশাক পরে জল থেকে উঠব না। বললেন, ‘ঠিক আছে টাওয়েল জড়িয়ে এসো।’ ’’ হেসে ফেললেন রাখি। ‘‘এ সব ক্ষেত্রে কেউ যদি হেল্প না করে, তা হলে কী হয়?’’ তিনি প্রশ্ন করলেন প্রতিবেদককে। ভয়ে ভয়ে উত্তর দিলাম, আপনি যে ভাবে চান, সে ভাবে দৃশ্যটা বেরিয়ে আসে না। একটু চুপ থেকে বললেন, ‘‘হুম। ডাবল রোলে কী ভাবে অপোজিশনে বসতে হয় শিখিয়েছিলেন। ক্লোজআপ শটে পাশে দাঁড়িয়ে থাকতেন কিউ বলে দেওয়ার জন্য। খুব কম লোক এ সব করেন।
কভি কভি
‘‘ওঁর সঙ্গে ঝগড়া হত। কথা বন্ধ করে দিতাম। ওঁর মেকআপ ম্যান শামকে বলে দিতেন, ‘রাখির মেকআপ করবে না কাল থেকে।’ ও আমার, শশীজির দু’জনের মেকআপ করত। রাতে খাওয়ার পর আমি শামকে ডেকে নিতাম, ‘চল একটু হেঁটে আসি।’ শশীজি তখন ওকে বারণ করত।’’ অনেকক্ষণ পর হাসির দমক রাখির গলায়, ‘‘বাচ্চাদের মতো ঝগড়া করতাম। অভিনয়ের জন্য রিহার্সাল করতাম। কিন্তু কাজ করতাম, যে যার মতো। কোনও ইন্টারফেয়ারেন্স ছিল না, ফলে কাজটা হত এফর্টলেস।’’
শশী কপূরের যে স্মৃতি, বন্ধুতা রাখিকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে, তাতে আর ইন্টারফেয়ার করলাম না। যেটুকু স্মৃতিমাণিক্য তিনি আমাদের হাতে তুলে দিলেন, আমরা তাতেই বিভোর!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy