Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
লিখছেন দেবপ্রসাদ চক্রবর্তী

মান্নাদার জন্য রেকর্ডিং বন্ধ করে দিতে হল

মান্নাদার জন্য রেকর্ডিং বন্ধ করতে হল কয়েকবার। লতাজির সঙ্গে ডুয়েট গান। যেখানে গানটা ধরার কথা, সেখানে মান্নাদা ধরতে পারছেন না। তখন তো লাইভ রেকর্ডিং। একবার ভুল হলে বাজনাসমেত আবার প্রথম থেকে শুরু করতে হয়।

শেষ আপডেট: ২৭ অক্টোবর ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

মান্নাদার জন্য রেকর্ডিং বন্ধ করতে হল কয়েকবার। লতাজির সঙ্গে ডুয়েট গান। যেখানে গানটা ধরার কথা, সেখানে মান্নাদা ধরতে পারছেন না। তখন তো লাইভ রেকর্ডিং। একবার ভুল হলে বাজনাসমেত আবার প্রথম থেকে শুরু করতে হয়। প্রত্যেকে অবাক হয়ে যাচ্ছেন। বিমল রায়, সলিল চৌধুরী, স্বয়ং রেকর্ডিস্টও। মান্নাদার ক্ষেত্রে এমনটা হওয়া একেবারে অসম্ভব। তাঁর টেকনিক্যাল জ্ঞান মারাত্মক। রেকর্ডিঙের আগে পুরোপুরি হোমওয়ার্ক করে আসেন। আজ এমন হচ্ছে কেন? সবাই ভাবছেন। মান্নাদা মুগ্ধতা মাখানো একটা হাসি নিয়ে বললেন, ‘‘লতা! তুমি জানো না কী গাইছ তুমি? আমি গাইব কী! তোমার গাওয়া থেকে আমি তো মনটাই সরাতে পারছি না। ওখানেই আটকে যাচ্ছি।’’

‘মধুমতী’ ছবির ‘দইয়া, দইয়া রে বিছুয়া’ গানটার রেকর্ডিং চলছিল। ১৯৫৮। শৈলেন্দ্রর লেখা। সলিল চৌধুরীর সুর। গানের মধ্যে একটা হামিং ছিল— উই-উই-উই-উই। লতাজির হামিঙের পরে মান্নাদা গানটা ধরবেন। সলিলবাবু হামিঙের প্যাটার্নটা করে দিয়েছেন। পৃথিবীর সব থেকে স্বাদু মধুমাখা কণ্ঠে লতাজি যখন অপূর্ব গায়কিতে ওই অংশটি গাইছেন, মুগ্ধ মান্নাদা পৃথিবীর সব কিছু ভুলে যাচ্ছেন। নিজে গাইবেন কী!

মান্নাদা বহু বার বলেছেন, ‘‘সারা জীবন লতা আমাকে অবাক করেছে। হবে নাই বা কেন? স্বয়ং ঈশ্বর ওকে গান শিখিয়েছেন।’’ আরও বলতেন, ‘‘আপনারা হিন্দি গানটা তো ওপর ওপর শোনেন। ভাষাটা যদি ঠিকঠাক জানতেন, লতার গানের আরও অনেক কিছু বুঝতে পারতেন। প্রতিটি শব্দের অর্থ বুঝে নিয়ে কী ভাবে যে লতা সুর লাগায়! ভাবলে অবাক হয়ে যাই। কোনও হিসেবই মাথায় আসে না।’’

মান্নাদাকে সরাসরি কিছু লিখতে বললে ‘না’ ‘না’ করতেন। অবশ্য তাঁকে লেখা ভক্তদের প্রায় সমস্ত চিঠির উত্তর নিজের হাতে লিখতেন। একটা ঘটনার কথা বলি। মান্নাদার এক ভক্ত প্রতিবছর ১ মে, মান্নাদার জন্মদিনে কার্ড পাঠাতেন। উত্তরে অনেক বার সেই ভক্ত মান্নাদার কাছ থেকে তিন-চার পাতার চিঠি পেয়েছেন। অবিশ্বাস্য ব্যাপার। ২০১২-তে যখন কার্ড গেল, মান্নাদার কোনও উত্তর এল না। বিনিময়ে কী এল জানেন? মান্নাদার ফোন। খুব ধরা গলায় তাঁর লক্ষ লক্ষ ভক্তের একজন সেই ভক্তকে বললেন, ‘‘এখন আর বেশি লিখতে পারি না। কষ্ট হয়। তাই ফোন করলাম। আপনার কার্ডটি পেয়ে খুব ভাল লাগল। ধন্যবাদ।’’

শ্রীরামপুরের স্নেহাশিস চট্টোপাধ্যায় বহু দিন থেকে লতাজির গান নিয়ে কাজ করছেন। লতাজির গাওয়া রেকর্ডের বিশাল ভাণ্ডার তাঁর সংগ্রহে তো আছেই, তার সঙ্গে রচনা করেছেন ‘লতা গীতিকোষ’। প্রথম খণ্ডে আছে ১৯৫৩ সাল থেকে এখনও পর্যন্ত লতাজির গাওয়া সমস্ত বাংলা গানের ডিটেলস। উল্লেখ্য, এই অবধি লতাজির গাওয়া শেষ গানটা লেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। আশা করি, তাঁর কাছ থেকে আমরা আরও বহু নতুন গান উপহার পাব।

‘লতা গীতিকোষ’ দ্বিতীয় খণ্ডের কাজও শেষ। ১৯৪৫ থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত লতাজির হিন্দি গানের বিস্তারিত বিবরণ নিয়ে এই খণ্ড। প্রথম থেকেই স্নেহাশিসের স্বপ্ন ছিল, এই বইয়ের ভূমিকা লিখবেন মান্না দে। কিন্তু সেটি বাস্তবায়িত হবে কী করে? কলকাতায় পূর্বনির্দিষ্ট শিডিউল নিয়ে খুবই অল্প সময়ের জন্য আসেন মান্নাদা। প্রয়োজনীয় অ্যাপয়েন্টমেন্টগুলো আগেই হয়ে থাকে। বোম্বেতে এক বাঙালি কর্নেল ছিলেন মান্নাদার প্রতিবেশী এবং বিশেষ পরিচিত। তাঁকে ধরেই মান্নাদার সঙ্গে যোগাযোগ। প্রস্তাব শুনে মান্নাদা যথারীতি ‘না’ বললেন। লতাজির গানের বইয়ের ভূমিকা মান্নাদা ছাড়া আর কে লিখবেন? স্নেহাশিস ধৈর্য ধরে থাকল। ওর স্থির বিশ্বাস ছিল, কাজটা যখন লতাজিকে নিয়ে, বরফ গলবেই। হলও তাই। ‘লতা গীতিকোষ’-এর জন্য মান্নাদা লিখে দিলেন একটি অমূল্য ভূমিকা। স্নেহাশিসের কাজের প্রভূত প্রশংসা করে লিখলেন, ‘‘লতাজিকে নিয়ে এই কাজ পরবর্তী প্রজন্মের ভীষণ কাজে লাগবে।’’

মালয়ালম ছবি ‘চেম্মিল’ ছবিতে মান্নাদার গাওয়া ‘মানস ম্যয়নে ভরু’ গানের কাহিনি তো এখন ইতিহাস হয়ে গেছে। অদম্য ইচ্ছাশক্তি নিয়ে ওই কঠিন ভাষাটি শিখেছিলেন। ১৯৬৫ সালের গান। তখন মালয়ালম ছবিতে মান্নাদার গান কোথায়? তখন থেকে আজ অবধি অনেক সাধারণ মালয়ালি মানুষ ভাবেন গানটি তাদের অঞ্চলের কারও গাওয়া। অন্য ভাষায় যখন মান্নাদা গান গেয়েছেন, সব সময় এমনই ঘটনা ঘটেছে। অসমিয়া ছবি ‘অরণ্য’তে মান্নাদা গাইলেন ‘দিনের পহর রঙ চাঙিয়া ভাল মানুহর হঙ্গু’—সে গান অসমে ‘চিরকালের গান’-এর মর্যাদা পেয়েছে। বাংলা ছবিতে মান্নাদাকে সঠিক ভাবে ব্যবহারের উদ্যোগ প্রথমে নিয়েছিলেন সুধীন দাশগুপ্ত (ডাক হরকরা, গলি থেকে রাজপথ, পঙ্কতিলক, শঙ্খবেলা ছায়াছবিতে)। ‘অরণ্য’র সঙ্গীত পরিচালকও ছিলেন সুধীন দাশগুপ্ত। অসমের গুণমুগ্ধ শ্রোতারা বিশ্বাস করেন যে, অসমিয়া ভাষাটা মান্নাদা মাতৃভাষার মতোই জানেন। নইলে এমন সঠিক উচ্চারণে অন্য ভাষায় গাওয়া যায় না।

উচ্চারণ প্রসঙ্গে একটা মজার গল্প মনে পড়ে গেল। মান্নাদা হাসতে হাসতে বলতেন, ‘‘আপনারা তো শচীনদার হিন্দি বলা শোনেননি। বাংলা ও ত্রিপুরা-কুমিল্লার বাঙাল ভাষা, সঙ্গে কিছু ঠিক কিছু ভুল হিন্দি শব্দ নিয়ে সে এক অদ্ভুত উচ্চারণ’’। শচীনকর্তা গানের সুর তৈরি করবেন। সামনে গানের গীতিকার মজরুহ সুলতানপুরী। অপূর্ব একটা সুর তৈরি হচ্ছে। শচীনকর্তা গাইছেন। মজরুহ একটু ইতস্তত করে বললেন, ‘‘দাদা! আপনে যো গায়া—দিলকি মিতুয়া— উয়ো গলৎ হ্যায়। ও হোগা ‘দিলকা মিতুয়া’’’। শচীনকর্তা একটু মিইয়ে গিয়ে বললেন, ‘‘ও! দিলকি মিতুয়া হইবো না, হইবো দিলকা মিতুয়া। ঠিক হ্যায়। ফির শুনো।’’

শচীনকর্তা আবার গাইতে থাকলেন। অপূর্ব। বিভোর হয়ে শুনছেন মজরুহ। হঠাৎ মজরুহ তাল ভঙ্গ করে বলে উঠলেন, ‘‘দাদা! মাফ কিজিয়ে।’’ গান থামিয়ে কর্তা বললেন, ‘‘কেঁও? আবার কী হুয়া?’’ মজরুহ করুণ মুখে বললেন, ‘‘আপনে গায়া ‘মন কী মিতুয়া’। হোগা মন কা মিতুয়া।’’ কর্তা অতিশয় বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘‘তোমাগো উর্দু আর হিন্দির ‘কা’ ‘কী’র অত্যাচারে আমি আর পারি না। তুম লোগোকা লিঙ্গজ্ঞান ইতনা সজাগ হ্যায়, আভিসে তুম বাংলামে গান লিখো। ‘কী’ আর ‘কা’র ঝামেলা থাকবো না।’’ বলেই শচীনকর্তা হা হা করে হাসতে থাকলেন।

শুধু গান দিয়ে মান্নাদা অনেকের ধারণা বদলে দিয়েছেন। ১৯৭৯-তে দিলীপ রায়ের ‘দেবদাস’ ছবিতে মান্নাদা দুটি নজরুলগীতি গেয়েছিলেন— ‘শাওন রাতে যদি’, আর ‘যেদিন লব বিদায়’। একজন বিশিষ্ট সঙ্গীত-সমালোচককে কেউ এই গানের রেকর্ডটি দিয়েছিল গানগুলো শোনার জন্য। তাঁর কিন্তু গান শুনতে মন চাইল না, যখন রেকর্ডে লেখা দেখলেন, ‘শাওন রাতে যদি’ গানটি গেয়েছেন মান্না দে। আসলে জগন্ময় মিত্রের গাওয়া (শোনা যায় এই গানের সুর জগন্ময়বাবুই করেছিলেন) এই গানটির তিনি এত ভক্ত ছিলেন যে, অন্য কারও কণ্ঠে গানটি শুনতে চাইতেন না। তাঁর ধারণা ছিল, অন্য কোনও শিল্পীই জগন্ময় মিত্রের গায়কির ধারে-কাছে আসতে পারবেন না। খামখা ‘কান’ নষ্ট করে লাভ কী!

একদিন তাঁর কী মনে হল মান্নাদার রেকর্ডটি চালালেন। এবং গান শুনতে শুনতে মুগ্ধতার শেষ সীমায় পৌঁছে গেলেন তিনি। কী অপূর্বই না গেয়েছেন মান্নাদা। ‘শাওন’ তাঁর দু’চোখে বাসা বাঁধল। মনে মনে বললেন, ‘‘ক’জনা তোমার মতো গাইতে জানে!’’

ভাগ্যের কল্যাণে মান্নাদা পাননি কিছুই। সমস্তটা যোগ্যতা দিয়ে লড়ে পেয়েছেন। ১৯৪৩ সালে ‘রামরাজ্য’ ছবিতে তাঁর প্রথম প্লে-ব্যাক খুব সহজে হয়নি। সঙ্গীত-পরিচালক শঙ্কর রাও ব্যাস চেয়েছিলেন গানগুলি গাইবেন কৃষ্ণচন্দ্র দে। কিন্তু নিজে অভিনয় না করলে গাইবেন না কৃষ্ণচন্দ্র। তিনিই মান্নাদার কথা বললেন। কিন্তু প্রযোজক বললেন রফি-কে দিয়ে গাওয়াতে। তখন ব্যাসজি বললেন, মান্না দে-কে নিয়ে ট্রাই করা যাক। খারাপ লাগলে রফিকে দিয়েই গাওয়ানো হবে। মান্নাদা গাইলেন, ‘চল তু দূর নগরিয়া’। গান শুনে প্রযোজকমশায় বললেন, ‘‘বাকি তিনটি গানই যেন মান্না দে-কে দিয়ে গাওয়ানো হয়।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Manna dey Blog
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE